শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


নিউইয়র্কে রোহিঙ্গা বিষয়ক সেমিনার; মিয়ানমারে মুসলিম নিধনের শেষ কোথায়?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

রশীদ আহমদ: মিয়ানমার সরকার উত্তর আরাকান (রাখাইন) রাজ্যে সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে সংখ্যালঘুদের নিধনযজ্ঞে লিপ্ত হয়েছে। সেখানে তারা রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিবির্চারে গণহত্যা করছে। নারী ও শিশুদের গণধর্ষণ, হত্যা নিপীড়নসহ রোহিঙ্গাদের হাজার হাজার বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে, এখনও দিচ্ছে।

মিয়ানমারে মুসলিম নিধনের শেষ কোথায়? রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধের পাশাপাশি তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিন।

গত ১৯ নভেম্বর, রবিবার, স্থানীয় সময় নিউইয়র্কের সকাল সাড়ে দশটায় ‘রোহিঙ্গা সংকটের কারণ, উদ্বেগ এবং এর সমাধান শীর্ষক’ সেমিনারে এ দাবি জানানো হয়।

নিউইয়র্ক সিটির ইয়র্ক কলেজ মিলনয়াতনে মানবাধিকার সংগঠন, “হিউমেন রাইটস এন্ড ডেভলাপমেন্ট ফর বাংলাদেশ (এইচআরডিবি)”র আয়োজনে সেমিনার আলোচকরা বলেন, ১৭৮৫ সালে বার্মিজরা আরাকান দখল করে।

এরপরই মুসলমানদের পাশাপাশি হিন্দুদের উপর নির্যাতন শুরু হয়। তবে শুরু থেকে মুসলমানদের প্রতি নির্যাতন ছিল বেশী। তাদেরকে বাধ্যতামূলক শ্রম প্রদান করতে হয়।

এছাড়া হত্যা আর ধর্ষণের শিকার হতে হয় নিত্য নৈমিত্তিক। রোহিঙ্গাদের কোনো প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়াই কাজ করতে বাধ্য করায় সে দেশের সরকার। শত নির্যাতনের পরও ১৯৮২ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা মুসলিমরা বার্মার পূর্ণ নাগরিক ছিলেন। সেই বছর সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিলের ষড়যন্ত্র স্বরুপ একটি নতুন আইন পাশ করে।

১৯৯১-৯২ সালে একটি নতুন দাঙ্গায় প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়। বার্মার শাসকেরা আরাকানের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে এবং একটা বড় অংশকে আরাকান থেকে বিতাড়িত করে মধ্য বার্মায় পাঠায়। যখন আরাকান দখল করে তখনও এটা ছিল একটি মৃত্যুপূরী।

আর একবিংশ শতাব্দিতে এর আরো ভয়াবহ রূপ ধারন করে, যার মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্ববাসী জানতে সক্ষম হয়। বীভৎস মৃত্যুর মহোৎসব থেকে বাঁচতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শরণার্থী হয়েছেন বাংলাদেশে।

জাতিসংঘের হিসাব মতে, এ পর্যন্ত তাদের সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আরো বিপলু সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রবেশের অপেক্ষায় সীমান্ত ও পাশের পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান করছেন। আলোচকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মিয়ানমার সরকার সন্ত্রাসীদের পরিচয় দিতে গিয়ে সরকারি বিবৃতিতে মুসলিমদের পরিবর্তে ‘বাঙালি’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। এটা পরিকল্পিত একটা ষড়যন্ত্র।

সচেতন বিশ্ববাসীর মূল রহস্য বুঝতে মোটেও দেরী হয়নি। এ ঘটনার পর থেকেই সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে এ জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ শুরু করে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধ যুবকরা। এতে নির্বিচারে নিরীহ রোহিঙ্গা নাগরিকদের গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়।

বিশ্ব গণমাধ্যমগুলো বলছে, এ পর্যন্ত ৩ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর জীবন বাঁচাতে দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করে। জাতিসংঘ পরিসংখ্যান অনুযায়ী এর সংখ্যা এরই মধ্যে তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, পুলিশ, বর্ডার গার্ড ও বৌদ্ধ যুবকরা সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা নারী ও মেয়েদের ওপর যৌন সহিংসতা চালিয়েছে এটা সরাসরি মানবাধিকার লঙ্গন।

রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ করে তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার আহবান জানিয়ে তারা বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে অবৈধ হলে শতাব্দিব্যাপী কীভাবে সেখানে তারা রয়েছে ?

‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ নামে মুসলমানদের হত্যা বন্ধ করুন। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের ফলে রোহিঙ্গা মুসলিমরা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হন। তারা সরকারি অনুমতি ছাড়া ভ্রমণ করতে পারে না, জমির মালিক হতে পারে না এবং পারেনা দুইটির বেশি সন্তান নিতে। যতরকম বঞ্চনা আছে তার সবই তাদের জীবনের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে।

বৌদ্ধরা রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিকৃষ্ট জাতের মানুষ মনে করে। তারা সরকারী চাকুরী করতে পারে না, সরকারী কোন দপ্তরে রোহিঙ্গা কোন সেবা পায় না, ব্যাংকে লেনদেন করতে পারে না, সরকারী চিকিৎসা কেন্দ্রের সেবা গ্রহণ করতে পারে না, উপযোগ সেবার (বিদ্যুত, পানি, জ্বালানী) জন্য আবেদন করতে পারে না, স্বপরিচয়ে শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে ভর্তি হতে পারে না। এজন্য প্রায় ৯০% রোহিঙ্গা বাস্তবিক অর্থে অশিক্ষিত।

সবসময় মায়ানমার সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গা নিপীড়নের খবর পাওয়া যায়। প্রায়শ স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন লোকালয়ে হানা দেয়। শহরের সৌন্দর্য্য বর্ধন, সরকারী জমি অধিগ্রহণের নামে রোহিঙ্গাদের অনেকগুলো মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়। এর মধ্যে প্রাচীন অনেক মসজিদও আছে। অনেক রোহিঙ্গাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

এ কথায় বলা যায়, "বিশ্বের সবচেয়ে অন্যতম নিগৃহীত ভাগ্যবঞ্চিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হলো রোহিঙ্গা মুসলমান।

আলোচকবৃন্দ বলেন, আরাকান রাজ দরবারে অনেক বাঙালি মুসলমান কাজ করতেন। বাংলাদেশের সাথে আরাকানের গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল রোসাং বা আরাকন রাজ দরবার।

মহাকবি আলাওল রোসাং দরবারের রাজ কবি ছিলেন। প্রাচীন কালের শত সমৃদ্ধ ইতিহাস আর ঐতিহ্য থাকার পরও বর্তমান পরিস্থিতিতে রাখাইন মুসলিমদের কার্যত কোনও বন্ধু নেই! বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ায় তাদের সাময়িক আশ্রয় হলেও কোথাও নেই নাগরিকত্ব। নেই শিক্ষা বা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। অন্যের দয়ায় এভাবে কতদিন টিকে থাকতে পারবেন রোহিঙ্গা নামের ইতিহাসের চরম নির্যাতিত নৃজাতিগোষ্ঠীটি।

এখন প্রতিনিয়ত সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিশ্বের প্রতিটি বিবেবকান মানুষের মাথায়। রোহিঙ্গা নিধন জাতিসংঘের হাতে যদি থাকে নিয়ন্ত্রণ? তবে কেন এমন করে চলছে রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধন? নিরাপত্তা কাউন্সিলে রুদ্ধদার বৈঠক বসছে আর বসছে, বৈঠকে কি বিবৃতি আসছে-শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সুচি কি ফাঁসছে?

জঘণ্য গণহত্যা, ধর্ষণ চলছে,বাড়িঘর জ্বলছে-নাফ নদীতে লাশ ভাসছে,স্রোতের  মত মানুষ বাংলাদেশে আসছে,আকাশ সীমাহীন সহিংসতা কতভাবেই না চলছে-চলছে।

তারা বলেন, "বুদ্ধং স্মরণং গচ্ছামি" "জীব হত্যা মহাপাপ" "অহিংসা পরম ধর্ম তবে কি গৌতম বুদ্ধের সেই ত্যাগ বিনয় আর কিছুই কি নেই সেথা ? অসহায় মানুষ আর কত হবে এই অমানুষিক নির্মমতার শিকার।

রোহিঙ্গাদের উপর অমানবিক নির্যাতন বাংলাদেশের জন্যও হুমকি উল্লেখ করে তারা বলেন, দেশে অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার ফলে মিয়ানমার বাংলাদেশের প্রতি চোখ তুলে কথা বলতে সাহস পাচ্ছে। তারা ইষ্ট-সাউথ এশিয়ার গুরুত্বপূণ স্থান চিটাগাংকে দখল করতে চায়।

শেখ হাসিনা সরকারের ভঙ্গুর পররাষ্ট্রনীতি মাধ্যমে এর সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব নয়। বর্তমান সরকার দলীয় লোক নিয়োগ দিয়ে দেশের সেনাবাহিনীকে শেষ করে দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সরকারকে আরো শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে। যেভাবে ১৯৭৮ তৎকালিন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ভূমিকা রেখেছেন। সেমিনারে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে চলাচলের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত এবং বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবী জানান হয়।

এইচআরডিবি’র প্রেসিডেন্ট মাহতাবউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে সেমিনারে বক্তব্য রাখেন, কানাডা ডসন কলেজের অধ্যাপক ড. আবিদ বাহার, মায়ানমার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা বিশেষজ্ঞ ড. হাবীব সিদ্দিকী, বার্মিজ রোহিঙ্গা অ্যাসোসিয়েশন অফ নর্থ আমেরিকা এর নেতা রেজা উদ্দীন, বার্মা টাস্কফোর্স নেতা অ্যাডাম ক্যারল, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আবুসামীহাহ সিরাজুল ইসলাম, প্রফেসর নকিবুর রহমান,

সাংবাদিক ইমরান হোসেন আনসারী, কমিউনিটি এক্টিভিষ্ট বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলহাজ্ব সোলায়মান ভূইয়া, আব্দুল্লাহ আল আরিফ, সাইফুল্লাহ খান, ইঞ্জিনিয়ার কামাল ভূঁইয়া ,সুরেশ বরুয়া ও এ প্রজন্মের এটর্ণী ফারহাহ।প্রফেসর জাহিদ বিন জমির এর সঞ্চালনায় সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন সংগঠনের পরিচালক জিয়াউর রহমান শামীম, সেত্রেুটারী জেনারেল প্রফেসর দেলোয়ার হোসন মজুমদার, অন্যতম সদস্য মাহবুবুর রহমান প্রমুখ।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ