শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


আরবি সাহিত্যচর্চা: অতি প্রয়োজনীয় কিছু কথা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা মুহিউদ্দিন ফারুকী
গবেবেষক, আরবী ভাষা ও সাহিত্য

[সাহিত্যচর্চা খুবই ভাল কাজ এবং তালিবুল ইলমদের জন্য প্রয়োজনীয়ও বটে। কিন্তু এই প্রবন্ধে উল্লেখিত ইবনে কুতাইবা রাহ.-এর কথা-

أن يؤدب نفسه قبل أن يؤدب لسانه، ويهذب أخلاقه قبل أن يهذب ألفاظه
(ভাষার পরিশুদ্ধির পূর্বে আত্মার শুদ্ধি জরুরি এবং আলফাযের পরিচর্যার আগে আখলাকের পরিচর্যা আবশ্যক।)-এর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।

দ্বিতীয় কথা - যা তিনি বলেননি- আকীদা ও আফকার-এর হেফাযত ওগুলোর চেয়েও অগ্রগণ্য এবং ওগুলোর চেয়ে বেশি জরুরি। আর তালিবুল ইলমগণের প্রথম কাজ হল কিতাবী ইস্তি‘দাদ অর্জন করা এবং মাদরাসার পক্ষ থেকে দেওয়া নেযামুল আওকাত পুরা করা।

বেরাদারে আযীয মুহতারাম মুহিউদ্দিন ফারুকী -যীদা মাজদুহুম-এর এই প্রবন্ধে আরবী সাহিত্যচর্চার জন্য কিছু বুনিয়াদি মাসাদিরের আলোচনা এসেছে, কিন্তু এগুলোর মধ্যে কোন্ কিতাব কোন্ স্তরের তালিবুল ইলমের জন্য, এবং কোন কিতাব কোন্ ধরনের ইস্তি‘দাদ ও মেযাজের তালিবুল ইলমের উপযোগী তার উল্লেখ আসেনি।

এবং এসকল কিতাবের প্রতিটিই নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত কি না - সে আলোচনাও আসেনি। সুতরাং এ প্রবন্ধ থেকে আরবী সাহিত্যচর্চার একটি ধারণা পাওয়া যাবে মাত্র, কিন্তু আমলীভাবে আরবী সাহিত্যচর্চার পূর্বে প্রবন্ধের শেষে উল্লেখিত নসীহত স্মরণ রাখা চাই।

তা হল, আমার অধ্যয়ন, আমার সাহিত্যচর্চা স্বাধীনভাবে নিজ খেয়াল-খুশি মত নয়, বরং আমার অবস্থা সম্পর্কে পূর্ণ অবগত এমন একজন মুশফিক উসতাযের নেগরানীতে হওয়া চাই। - মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক]

সাহিত্য এবং জীবনঘনিষ্ঠ যে কোনো বিষয়ে সুন্দর ও সাবলীল প্রকাশ আল্লাহ তাআলার এক বিরাট নিয়ামত। নিঃসন্দেহে এই নিয়ামত যার ভাগ্যে জুটেছে সে অনেক উত্তম জিনিস পেয়েছে।

সাহিত্যের আকর্ষণ সব কিছুকে ছাড়িয়ে যায়। সুন্দর ও উত্তম সাহিত্য মনকে আকৃষ্ট করে খুব সহজেই। হৃদয়কে জাগিয়ে তোলে খুব অল্পতেই।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
"إن من البيان لسحرا"
“নিশ্চয় সুন্দর ও সাবলীল প্রকাশ ভঙ্গিতে যাদু রয়েছে।” এই যাদুকে অনেকে বলেছেন, "السحر الحلال" বা হালাল যাদু।

তাই কবি-সাহিত্যিকরা তাদের এই মোহনীয় শক্তি আর হালাল যাদু দিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন মানুষের হৃদয়ে। তাইতো কবি সাহিত্যিকদের সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে সকলের কাছেই। মরে যাওয়ার পরও তারা বেঁচে থাকেন যুগ যুগ ধরে।

আমাদের তালিবুল ইলম ভাইদের অনেকেরই মনের ইচ্ছা ও বাসনা আরবী ভাষায় সাহিত্য চর্চা করা। সে ভাষায় কিছু রচনা করা। মনের ভাবটাকে আরবীতে সুন্দর ও সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তোলা। কিন্তু কীভাবে সম্ভব আরবী সাহিত্য রচনা করা? লেখার কৌশলটা রপ্ত করা? মনের ভাবগুলো লেখায় ফুটিয়ে তোলা? ভাষার গাঁথুনী মজবুত করা?

এই প্রশ্নের উত্তর সত্যিই দীর্ঘ। প্রয়োজন অনেক সময় ও দীর্ঘ আলোচনার। তবে কবি-সাহিত্যিক সকলের সর্বসম্মত কথা হচ্ছে, সাহিত্যরুচি তৈরীর জন্য প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে অধ্যয়ন এবং লেখালেখির চর্চা। সাথে সাথে প্রতিষ্ঠিত ও প্রসিদ্ধ লেখক সাহিত্যিকদের রচনাশৈলীর অনুসরণ করা।

তাদের জীবনী অধ্যয়নের মাধ্যমে তাদের লেখার কৌশলগুলোকে ভালভাবে আয়ত্ত করা। এভাবে পর্যাপ্ত পড়াশোনা আর আন্তরিক প্রচেষ্টায় এক সময় নিজের মাঝে চলে আসবে সাহিত্যরুচি, পাকা হবে সাহিত্যের বুনিয়াদ।

তৈরী হবে সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় ভাব প্রকাশের অভিনব ও সৃষ্টিশীল কৌশল। আমি হয়ে উঠব পরিশীলিত ভাষার অধিকারি। আমার লেখায় ফুটে উঠবে ভাব ও মর্মের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।

এক্ষেত্রে সকলের জানতে ইচ্ছে করে কোন্ ধরনের বই পড়বো, এবং কোন্ কোন্ সাহিত্যিকের বই অধ্যয়ন করবো? মূলত বিশেষজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের আলোচনা ও গবেষণায় সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্যরুচি তৈরীর জন্য কিছু প্রাচীন ও আধুনিক গ্রন্থ অধ্যয়নের পরামর্শ পাওয়া যায়।

সাথে সাথে আমার নিজস্ব অধ্যয়ন থেকেও কিছু গ্রন্থ আমি এক্ষেত্রে যথেষ্ট মুফীদ ও উপকারী পেয়েছি। এই ছোট্ট প্রবন্ধে সেই প্রাচীন ও আধুনিক আরবী সাহিত্য-গ্রন্থসমূহের পরিচিতিসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার প্রয়াস পেয়েছি।

শুরুতেই কিছু প্রাচীন গ্রন্থের কথা বলি, যার প্রচুর অধ্যয়নেই তৈরী হয়েছে আধুনিক সাহিত্যিকদের সাহিত্য রুচি। শক্তিশালী হয়েছে তাঁদের ভাষার গাঁথুনী। যার উপর ভিত্তি করে তাঁরা পরবর্তীতে তৈরী করেছেন আধুনিক, সৃষ্টিশীল ও সৃজনশীল সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার। সৃষ্টি করেছেন উত্তম থেকে উত্তম সাহিত্য-সমাহার।

তাই শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধকরণ, বাক্যশৈলী আত্মস্থকরণসহ সাহিত্যরুচি তৈরিতে প্রাচীন গ্রন্থগুলোকেই অগ্রাধিকার দেয়া একান্ত কর্তব্য।

প্রাচীন গ্রন্থগুলোর মধ্যে সেই চারটি গ্রন্থ আমি আগে উল্লেখ করব, যার ব্যপারে "ابن خلدون" তার "مقدمة" -এ বলেছেন-

"و سمعنا من مشايخنا في مجالس التعليم أن أصول هذا الفن و أركانه أربعة دواوين، و هي : أدب الكاتب لابن قتيبة، و كتاب الكامل للمبرد، وكتاب البيان و التبيين للجاحظ، و كتاب النوادر لأبي علي القالي، وما سوى هذه الأربعة فتوابع لها، و فروع عنها."

এবং যাকে ড. ইযযুদ্দীন ইসমাঈল তার গ্রন্থ "المصادر الأدبية واللغوية في التراث العربي"-এ أمهات المصادر الأدبية
বলে উল্লেখ করেছেন। সাথে সাথে ব্যাপকার্থে এই গ্রন্থগুলোকে موسوعات في الثقافة الأدبية العربية বা আরবী সাহিত্য সংস্কৃতির বিশ্বকোষ বলে অবিহিত করেছেন।

এক. "البيان والتبيين" লেখক আবু উছমান আল জাহেয। আরবী সাহিত্যের ময়দানে এক অনন্য গ্রন্থ। বয়ান-বক্তৃতা, অলংকার শাস্ত্র ও লেখনী-কৌশলসহ অসংখ্য বিষয় তিনি এ গ্রন্থে একত্রিত করেছেন।

ভাষা-বিজ্ঞানের অনেক বিষয়, যা নিয়ে আজ আধুনিক বিশ্বে নতুনভাবে গবেষণার সূত্রপাত ঘটেছে, তা তিনি এই গ্রন্থে সুন্দর ও সাবলীলভাবে আলোচনা করার প্রয়াস পেয়েছেন। তবে এই গ্রন্থের একটি সমস্যাও রয়েছে, আর তা হচ্ছে গ্রন্থটির বিষয়বস্তু আগোছালো। তবে এতদ¦সত্তে¡ও সাহিত্যরুচির ভিত গড়তে এর ভ‚মিকা অনন্য।

দুই. ইবনে মুবাররদ এর الكامل বা الكامل في اللغة والأدب। গদ্য ও পদ্য, প্রবাদ-প্রবচন আর অসংখ্য বিষয়ের অনবদ্য আলোচনা রয়েছে এই গ্রন্থে। আরবের সবচেয়ে বিশুদ্ধভাষীর কথা অর্থাৎ হাদীসের শব্দ অবলম্বন করে কবিতা, প্রবাদ প্রবচনের মাধ্যমে সে শব্দের ব্যবহার দেখাতে দেখাতে তিনি সামনে অগ্রসর হয়েছেন।

পাঠককে আনন্দ দিতে কখনও কখনও বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকদের ঘটনার অবতারণা করেছেন। কঠিন শব্দের অর্থ না বুঝে হয়ত পাঠক এক পর্যায়ে থেমে যেতে পারে, সে দিকটিও তিনি লক্ষ্য রেখেছেন। তাই কোনো দূর্বোধ্য শব্দ এলেই সাথে সাথে তার অর্থ ও সুন্দর ব্যখ্যা দিয়েছেন।

তার এই গ্রন্থের ব্যাপারে তিনি নিজেই ভ‚মিকায় বলেন- "هذا كتاب يجمع ضروبا من الآداب، ما بين كلام منثور، وشعر مرصوف، و مثل سائر، وموعظة بالغة، واختيار من خطبة شريفة، ورسالة بليغة."

তিন.  ইবনে কুতাইবা রচিত أدب الكاتب। লেখালেখি আত্মস্থ করার কৌশলসহ অসংখ্য দিকনির্দেশনা তিনি এ কিতাবে দিয়েছেন। শব্দসম্ভার তৈরি, শব্দের সঠিক প্রয়োগ, সঠিক বাক্যগঠন পদ্বতি এবং বিশেষত আরবী বানানের রীতি বা ইমলার বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি চমৎকার আলোচনা করেছেন।

লেখালেখিতে হাত পোক্ত করা আর বয়ানে মুখ পাকা করতে তিনি তার কিতাবে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অংশে সুন্দর আলোচনা করেছেন। তবে সবচেয়ে চমৎকার ও আনন্দের বিষয় হচ্ছে, তিনি লেখক ও বক্তার বাহ্যিক দিকের চেয়ে নৈতিক, চারিত্রিক ও আত্মিক দিকের সচ্ছতার দিকে নযর রাখার প্রতি তাকিদ দিয়েছেন।

বুঝাতে চেয়েছেন যে সাহিত্যিক যদি নৈতিকতার প্রশ্নে উত্তীর্ণ না হতে পারে, তাহলে তার সাহিত্য সুসাহিত্য হতে পারে না। তিনি তার কিতাবের ভ‚মিকায় বলেন-
"ونحن نستحب لمن قبل عنا وائتم بكتبنا أن يؤدب نفسه قبل أن يؤدب لسانه، ويهذب أخلاقه قبل أن يهذب ألفاظه، ويصون مروءته عن دناءة الغيبة، وصناعته عن شين الكذب، ويجانب – قبل مجانبة اللحن وخطل القول- شنيع الكلام ورفث المزاح."

চার.  আবু আলী আল-ক্বালি রচিত النوادر, যাকে أمالي القالي -ও বলা হয়। আরবী সাহিত্যের ময়দানে এক অমূল্য সংযোজন। যাকে আরবী সাহিত্যের ভাণ্ডার বলা চলে। এ কিতাবে আরবদের প্রবাদ-প্রবচন ও বাগধারার ব্যবহার বেশি লক্ষ করা যায়।

এছাড়াও গদ্য-পদ্যের বিশাল সমাহার রয়েছে এতে। তবে এ কিতাবের একটি বিশেষ সমস্যা হচ্ছে, এর বর্ণনায় বিক্ষিপ্ততা রয়েছে। সময় ও কালের ধারা এতে রক্ষা করা হয়নি।

এছাড়াও এতে কবিতার কবির নাম উল্লেখের ক্ষেত্রে কিছুটা অসচেতনতার ছাপ লক্ষ করা যায়। এ মত বিজ্ঞজনের।

এছাড়াও কবিতা এবং গদ্য লেখার প্রতিভাকে আরো শাণিত ও শক্তিশালী করতে একটি চমৎকার গ্রন্থ المثل السائر في أدب الكاتب و الشاعر। রচনা করেছেন ইবনুল আছীর রাহ.।

সাহিত্যরুচি তৈরিতে যথেষ্ট উপকারী গ্রন্থ । বিশেষ একটি ভালো দিক হচ্ছে গ্রন্থটি সাজানো গোছানো ও চমৎকার শৈলীতে রচিত। তাই অনেকটা সুখপাঠ্য। পাঠককে সহজেই সামনে অগ্রসর হতে সাহায্য করে। তরতর করে পড়ে ফেলা যায়।

আর অনেক আধুনিক সাহিত্যিক তো এমনও বলেছেন যে, এই দৃষ্টিকোণ থেকে এই গ্রন্থটি একক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বললেও অতিশয়োক্তি হবে না।

এই বইটি অধ্যয়ন করে যদি কেউ আত্মস্থ করতে পারে, তাহলে বলা যেতে পারে, সাহিত্য তথা গদ্য ও পদ্য এবং সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে তার এক বিশাল সম্ভার তৈরি হবে। এই ময়দানে সামনে বাড়ার জন্য তাকে সাহস যোগাবে।

এ ক্ষেত্রে আরেকটি গ্রন্থالصناعتين , যা রচনা করেছেন أبو هلال العسكري। এ গ্রন্থটি থেকে পাঠক আরবী শব্দের অর্থ কীভাবে বের করতে হয়, সাহিত্য সমালোচনা কীভাবে করতে হয় তার দিকনিদের্শনা পাবে।

সাথে সাথে এ গ্রন্থে রয়েছে লেখালেখি বিষয়ক অনেক আলোচনা। আরেকটি চমৎকার বিষয় এতে রয়েছে, তা হচ্ছে শব্দ ও অর্থ ব্যবহারের নিয়ম পদ্ধতি।

এছাড়াও আরো অনেক গ্রন্থ আরবী সাহিত্যের মাকতাবায় রয়েছে। যার অধিক পরিমাণে অধ্যয়ন পাঠকের হৃদয়ে তৈরী করবে সাহিত্যের প্রতি টান। যার মুতালাআয় জুড়াবে তার মন ও প্রাণ।

তাদের চিন্তার অনুসরণে তৈরী হবে নিজের মাঝেও সৃজনশীল চিন্তা। তাদের লেখার অনুসরণে তৈরী হবে সৃষ্টিশীল লেখা।

এজাতীয় গ্রন্থের মধ্যে আরো কিছু হচ্ছে أبو حيان التوحيدي ابن عبد ربه -এর العقد الفريد, ইবনে কুতাইবা রচিত عيون الأخبار, ইবনে হিব্বান আদ্দাবুসী রচিত روضة العقلاء ونزهة الفضلاء এবং جاحظ -এর অন্যান্য গ্রন্থ ।

উপরোল্লিখিত গ্রন্থগুলো সময়ের বিবেচনায় একটু আগের হওয়ায় এর ভাব, রচনাশৈলী, শব্দ ও গতিপ্রকৃতি বুঝতে একটু কষ্ট হবে। তবে কষ্টের কারণে খেই হারিয়ে ফেললে চলবে না। সাহিত্যচর্চা বলে কথা! একটু ধৈর্য্য আর অধ্যাবসায় তো লাগবেই। তবে এরপর অবশ্য পথ অনেকটা মসৃণ।

আধুনিক সাহিত্যিকদের মাঝে যাদের কিতাব অধ্যয়নে বেশি উপকৃত হওয়া যাবে এবং অনেকটা নিকট অতীতের হওয়ায় শব্দ, বাক্য ও ভাষা বুঝতে সহজ হবে তাদের যারা অন্যতম, এবার তাদের কিছু গ্রন্থের আলোচনা করছি।

বিশিষ্ট সাহিত্যিক مصطفى صادق الرافعي। আধুনিক সাহিত্যের ময়দানে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। একাডেমিক কোনো পরিচয় তার ছিল না। বড় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যে কোন ডিগ্রিও তার ছিল না।

তবে ছিল খোদা-প্রদত্ত প্রতিভা আর কঠিন অধ্যাবসায়। একাডেমিক সনদপ্রাপ্ত সাহিত্যিকরাও তার সাহিত্য প্রতিভার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। তার রচিত সাহিত্যের ভ‚য়সী প্রশংসা করেছেন।

তার রচিত وحي القلم এবং كتاب المساكين, সাহিত্যের ভিত গড়তে পাঠককে অনেকটা সহযোগিতা করবে। এছাড়াও তার অন্যান্য গ্রন্থ আরবী সাহিত্যের ময়দানে বিরাট ভূমিকা রাখছে। আর আরবী সাহিত্যের ইতিহাস জানতে তার রচিত تاريخ الأدب العربي -এর কোনো তুলনা নেই।

এই ময়দানে আরেক প্রসিদ্ধ নাম সাহিত্যিক مصطفى لطفي المنفلوطي গদ্য সাহিত্যে তিনি এক অনন্য প্রতিভা। তিনি যাই রচনা করেছেন জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

সমাজের খেটে খাওয়া গরীব-দুঃখীদের মনের ব্যথা আর অন্যান্য সকল অসংগতিগুলো কী চমৎকারভাবেই না তিনি তুলে ধরেছেন। আমি আশ্চর্য হই মানুষ এতো সুন্দর লিখতে পারে! আর অনুবাদ সাহিত্যেও তিনি অনন্য ভূমিকা রেখেছেন।

তাঁর গ্রন্থগুলো অধ্যয়নের জন্য যদি তার গ্রন্থসমগ্র অর্থাৎ الأعمال الكاملة বা المجموعة الكاملة পাওয়া যায় তাহলে অনেক ভালো অন্যথায় النظرات والعبرات বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

আধুনিক আরবী সাহিত্যে আরেক নাম নাজীব কিলানী। তার লেখায় সাহিত্যের সাথে সাথে রয়েছে নৈতিকতার ছোঁয়া। ইসলামী ভাবধারার এক অনন্য সাহিত্যিক তিনি। উপন্যাস, ছোট গল্প এবং প্রবন্ধসহ অনেক গ্রন্থ রয়েছে তাঁর।

এর মধ্যে ছোট গল্প موعدنا غدا، عند الرحيل ,دموع الأمير উল্লেখযোগ্য। আর উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে
قاتل حمزة، حارة اليهود، اليوم الموعود، أرض الأنبياء.

রোযনামচা, সফরনামাসহ ঐতিহাসিক বিষয় এবং সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সাহিত্য রচনায় আরেক উল্লেখযোগ্য নাম علي الطنطاوي।

তাঁর লেখা থেকে পাঠক পাবেন সুন্দর বর্ণনা কৌশল এবং আরবী শব্দ ব্যবহারের সৌন্দর্য। তাঁর সমস্ত গ্রন্থগুলোই উপকৃত হওয়ার মত।

তবে বিশেষভাবে তার ذكريات উল্লেখযোগ্য। জিদ্দা থেকে প্রকাশিত مختارات সংগ্রহ করতে পারলে অনেক সহজ হবে। من روائع الطنطاوي -ও অনেক ভালো। অল্পতেই এখানে শায়খের চমৎকার লেখাগুলো একসাথে পাওয়া যাবে।

সবশেষে যার কথা বলবো তার সাহিত্য শুধু সাহিত্য নয় আমি বলি “জাগরণী সাহিত্য”। যিনি আরবী ভাষার জন্য নিবেদিত প্রাণ। যিনি আরবী সাহিত্য থেকে পেয়েছেন অনেক কিছু, আবার আধুনিক আরবী সাহিত্যকে দিয়েছেনও অনেক কিছু।

সাহিত্যকে ইসলামী সাহিত্যে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক ইসলামী সাহিত্য সংস্থা গঠনে রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। তিনি আর কেউ নন তিনি আমাদের ‘আলী মিয়া’, আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.।

তাঁর অনেক কিতাব উর্দূ থেকে আরবীতে অনুদিত হয়েছে। হয়েছে অনেক আলোচনার অনুবাদ। এসমস্ত কিতাবগুলো ছাড়া তাঁর নিজের লিখিত সমস্ত কিতাবগুলোই আরবী শেখা এবং লেখায় অনেক সহযোগিতা করবে।

তাঁর রচিত সাহিত্যের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। আরব আজম উভয় স্থানেই সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর লেখার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তা সুখপাঠ্য এবং সহজ ও সাবলীল।

সাথে সাথে এতো চমৎকারভাবে তিনি সমার্থক শব্দের সমাহার ঘটিয়েছেন যার নযীর অন্যান্যদের লেখায় বিলুপ্ত প্রায়।

তাঁর লিখিত গ্রন্থগুলোর মাঝে ماذا خسر العالم بانحطاط المسلمين، الطريق إلى المدينة، من نهر كابل إلى نهر اليرموك বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও শিশু সাহিত্যে القراءة الراشدة، قصص النبيين অনন্য।

তাঁর কিতাবগুলো একটু ভেবে চিন্তে আস্তে আস্তে (القراءة المتأنية) পড়ার অনুরোধ করছি। এতে করে শব্দভাণ্ডার তৈরি হবে আর সহজেই কীভাবে ভাব প্রকাশ করতে হয় তা শেখা যাবে।

অন্যদিকে তিনি যেহেতু একজন প্রসিদ্ধ চিন্তাবিদ ও মুফাক্কির, তাই তাঁর লেখা গ্রন্থ ও বক্তৃতা সংকলন অধ্যয়নে চিন্তার গভীরতা ও প্রখরতা আসবে এবং যেকোনো ক্ষেত্রে পরিশীলিত চিন্তা করার অভিজ্ঞতা তৈরী হবে।

সাহিত্যে নৈতিকতা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ বলে একটি বিষয় আছে, তা তিনি সকলের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন। অনারবদের মধ্য থেকে আরবী ভাষায় তার মত ভূমিকা আর কেউ রাখতে পারেনি। এ কথা পণ্ডিতজনের, এ কথা সকলের।

এবার কাব্য গ্রন্থ নিয়ে কিছু আলোচনা করছি।

উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ইবনে তাম্মাম এবং বাহতারী রচিত الحماسة। আবু হেলাল আছকারী রচিত ديوان المعاني আলী রা.-এর কাব্যসমগ্র ديوان علي ।

আরো আছে,  ইমাম শাফেয়ী রহ.-এর ديوان الشافعي কবিতার জন্য যেমন প্রসিদ্ধ, তেমনি আখলাক-চরিত্র, চিন্তা-চেতনার পরিশুদ্ধির ক্ষেত্রেও চমৎকার অবদান রাখে। আর কবির জন্য এ দু’টি জিনিস অর্থাৎ চরিত্র ও চিন্তার পরিশুদ্ধতা অত্যন্ত জরুরি।

কাব্যগ্রন্থের মাঝে আল-বারুদী এর নির্বাচিত কবিতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর প্রশংসা করেছেন অনেকেই। বিশেষত মুস্তফা সাদেক আররাফেয়ী এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

অন্যান্য সমস্ত مختارات বা নির্বাচিত কবিাতসমগ্র থেকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আধুনিক কাব্যগ্রন্থের মধ্যে شوقيات বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হাফেজ ইবরাহিম আরবী ভাষার স্বীকৃত পণ্ডিত।

ছোট সময় থেকেই আরবী ভাষার প্রতি ছিলেন প্রচণ্ড আগ্রহী। তার ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে যে আরবী ভাষা ও সাহিত্যে এমন কোনো কিতাব নেই যা তার পড়া হয়নি।

"فانه لم يوجد كتاب في اللغة أو الأدب ولا ديوان شعر إلا وقد طالعه. "
আবুল আলা এবং মুতানাব্বির মৃত্যুর পর তাদেরকেই আরবের সাহিত্যক বলা হতো। আর তাদের মৃত্যুতেই বলা হয়- আরবী সাহিত্যেরও মৃত্যু হয়েছে।

"إن هذين الشاعرين كانا أشعر أهل الشرق العربي، منذ مات المتنبي وأبو العلاء، وأنهما كانا ختام حياة أدبية طويلة باهرة، بدأت في نجد وانتهت في القاهرة."
তাই তার দিওয়ান অধ্যয়নে সমাজ, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি সব বিষয়ের ভাব প্রকাশের এবং নীরবে প্রতিবাদের কত সুন্দর ভাষা হতে পারে তা জানা যাবে।

উপরোল্লিখিত কিতাবসমূহ অধ্যয়নে পাঠকের একটি সাহিত্য রুচি তৈরি হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সাথে সাথে তাদের লেখার অনুকরণ করে লিখতে শুরু করলে লেখার প্রতি আরো সাহস বাড়বে।

এবং একসময় লেখালেখি ও সাহিত্যে নিজস্ব একটি অবস্থান, নিজস্ব ঢং তৈরি হবে। যদিও শুরুটা দেখা যাবে একটু কঠিন। আর সবকিছুর শুরুটা একটু কঠিনই হয়- এ কথা সকলেরই জানা।

তবে সাধনা ও অধ্যবসায় চেষ্টা-প্রচেষ্টার পর শুধু উন্নতি আর উন্নতি দেখতে পাবে। প্রতিভার বিকাশ ঘটতে থাকবে। এবং আল্লাহ চাহেন তো সাহিত্যের ময়দানে একটি দৃঢ় অবস্থান তৈরি হবে।

এক্ষেত্রে মুস্তফা সাদেক আররাফেয়ী-এর একটি নছীহত হলো “তোমার হাতের নীচে যা পাবে তাই পড়ে ফেলো।” অধিক পরিমাণ অধ্যয়নের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্যই তিনি একথা হয়তো বলেছেন।

তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই তা যেন সুসাহিত্য হয়। আর সাথে সাথে আদীব হুযুর দামাত বারকাতুহুম-এর নসীহত অনুযায়ী এ অধ্যয়ন একজন বিশেষজ্ঞ মুরব্বীর তত্ত্বাবধানে হওয়া অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় যে কোনো সময় হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এসমস্ত গ্রন্থ অধ্যয়নের সাথে সাথে কিছু আরবী প্রবাদ প্রবচন, কবিতা মুখস্থ করে নেয়া উচিত। আর কুরআনে কারীমের আয়াত ও হাদীছে রাসূল মুখস্থ করার কোনো বিকল্প আছে বলে আমার জানা নেই।

নিজের লেখাকে শক্তিশালী করার পেছনে আরেকটি চমৎকার পদ্ধতি রয়েছে। যার অনুস্মরণ করেছেন মুস্তফা সাদেক আররাফেয়ী এবং আলী তানতাবী-এর মত সাহিত্যিকরা।

আর তা হল, একটি ছোট অনুচ্ছেদ নির্বাচন করে তা কয়েকবার পড়া। একবার, দুবার এবং কয়েকবার। এরপর এর অনুকরণে লেখা। একবার, দুবার এবং কয়েকবার। এভাবে লিখতে লিখতে একসময় লেখা নিজের আয়ত্তে চলে আসবে।

তবে এক্ষেত্রে একটি বিষয় বলে রাখা প্রয়োজন, তা হচ্ছে সাহিত্যচর্চার পূর্বে ভাষাটা শিখতে হবে সঠিকভাবে, শুদ্ধভাবে। ভাষা শেখা ছাড়া সাহিত্যচর্চা করা যায় না।

এর গুরুত্ব বুঝাতে উস্তাযে মুহতারাম শায়েখ শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী দামাত বারাকাতুহুম মাসিক আলকাউসারেই একটি চমৎকার ও মুফীদ প্রবন্ধ লিখেছেন।
আসলে এ বিষয়ে আলোচনা অনেক দীর্ঘ। প্রয়োজন ধৈর্য, কঠিন অধ্যবসায়। তাহলেই সফলতা এক সময় হাতছানি দিবে।

বিশিষ্ট সাহিত্যিক মুস্তফা সাদেক রাফেয়ী তাঁর ঐতিহাসিক পত্রাবলিতে বলেন,
"و رأس هذا الأمر بل سر النجاح فيه أن تكون صبورا وأن تعرف أن ما تستطيع الرجل لا يستطيعه الطفل إلا متى صار رجلا، وبعبارة صريحة إلا من انتظر سنوات كثيرة"

আর কবির ভাষায়
"وقل من جد في أمر يحاوله
واستعمل الصبر إلا فاز بالظفر "

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কুরআন ও হাদীসের এই ভাষাকে সঠিকভাবে শেখা ও আত্মস্থ করার তাওফীক দান করুন। দ্বীন ও উম্মাহর কল্যাণে এই ভাষায় সাহিত্য চর্চা করার হিম্মত ও কুওয়ত দান করুন। আমীন।

লেখক: পরিচালক,  আরবী ভাষা ও সাহিত্য কেন্দ্র, বাংলাদেশ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ