আতাউর রহমান খসরু
বার্তা সম্পাদক
কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা এখন আর কোনো স্বপ্ন বা রূপকথা নয়। বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে তা। কাতালান সংসদের ভোটাভুটির মাধ্যমে স্বাধীনতার চূড়ান্ত সিন্ধান্তে উপনীত হয়েছে স্পেন থেকে সদ্য স্বাধীনতা ঘোষণাকারী অঞ্চলটি।
কাতালোনিয়ার আজকের স্বাধীনতার গর্বিত অংশিদার অঞ্চলটির মুসলিম জনগণ। কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার জন্য কাতালোন মুসলিমদের দোষারোপও করা হয়। কারণ, স্বাধীনতার প্রশ্নে কাতালোনের অধিকাংশ মুসলিমই সরব।
স্পেনের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলিম বসবাস করতো কাতালোনে। কাতালোনের মোট জনসংখ্যার (৫.৪ মিলিয়ন) ২০ ভাগ মুসলিম। কাতালোনের প্রধান শহর বার্সালোনার ৪০ ভাগ নাগরিক মুসলিম।
স্বাধীনতার প্রশ্নে অনড় কাতালোনের মুসলিম ইতিহাস অবশ্য খুব সুখকর নয়। স্পেনে মুসলিম শাসনের সুদীর্ঘ ৮ শ’ বছর (৭১১-১৪৯২ খ্রি.) কাতালোন ছিলো মুসলিম ও খ্রিস্টান শক্তিগুলোর যুদ্ধ ক্ষেত্রে।
বার্সেলোনার মসজিদ
কাতালোনের কোনো না কোনো অংশ সব সময় মুসলিম শাসনাধীন থাকলেও সম্পূর্ণ কাতালোন মুসলিম শাসনাধীন ছিলো খুব অল্প সময়। মুসলিম শাসকদের কাছ থেকে সর্বপ্রথম ছিনিয়ে নেয়া হয় বার্সালোনা শহরটি।
মুসলিম শাসনাধীন হওয়ার মাত্র ৯০ বছরের মাথায় (৮০১ খ্রি.) তা হাতছাড়া হয় স্পেনীয় উমাইয়া শাসকদের।
কাতালোন মুসলিম শাসনকে বিনা প্রশ্নে মেনে না নিলেও কাতালোন মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে এড়িয়ে যেতে পারে নি। গ্রানাডায় মুসলিম শাসনের পতনের পূর্ব পর্যন্ত স্পেনের অন্যান্য অঞ্চলের মতো কাতালোন ছিলো মুসলিম প্রভাবাধীন। কাতালোনের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ভাষায় এখনো সে প্রভাব দৃশ্যমান।
কাতালোনীয় সমাজেই শুধু মুসলিম সংস্কৃতির ও আরবি ভাষার প্রভাব পড়েনি; বরং কাতালোন তখন ছিলো ফ্রান্সের সঙ্গে মুসলিম স্পেনের যোগাযোগ সূত্র।
বার বার এ সূত্র কাটা পড়েছে ঠিক কিন্তু মুসলিম সভ্যতার প্রভাব ফ্রান্সের সমাজেও পড়েছে এবং তা কালক্রমে এখনো টিকে আছে। গ্রানাডায় মুসলিম শাসনের পতন হলে স্পেনের অন্যান্য অঞ্চলের মতো কাতালোন থেকেও মুসলিম জনগোষ্ঠিকে নির্মূল করা হয়।
আধুনিক কাতালোনে মুসলিম সমাজের আগমন আঠারো শতকের শেষভাগে। ধীরে ধীরে মুসলিম জনসংখ্যার বাড়তে থাকে। কিন্তু তা ছিলো খুবই সামান্য। ১৯৮০ সালের শেষ ভাগ পর্যন্ত কাতালোনে মুসলিম সংখ্যা ছিলো মাত্র ৩০ হাজার।
গত শতকের আশির দশকে কাতালোনে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জোরালো হলে মুসলমানের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়। মূলত ১৯৮০ সালে কাতালোন কৃষি উন্নয়নে মনোযোগ দেয় এবং সেজন্য তারা বিদেশি শ্রমিক নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
এ সময় মরক্কো, আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়া থেকে বিপুল সংখ্যক মুসলিম কাতালোনে পাড়ি জমায়। এশীয় অঞ্চল থেকে বহু সংখ্যক পাকিস্তানি কাতালোনে যান সে সময়।
বলা যায়, কাতালোনের কৃষি বিপ্লব সংঘটিত হয় অভিবাসী মুসলিম শ্রমিকদের মাধ্যমেই। কৃষি বিপ্লব আধুনিক কাতালোনের ভিত্তি প্রস্তর হিসেবে কাজ করেছে বলে অনেক গবেষকের মত।
১৯৯০ সালে কাতালোনের জাতীয়তাবাদী সরকার গঠিত হলে নতুন অভিবাসী আইন প্রণয়ন করে। এ আইনের ফলে মুসলিম অভিবাসীদের জন্য নাগরিকত্ব লাভের সুযোগ তৈরি হয়।
১৯৯০ থেকে বিগত ৩০ বছরে কাতালোনের মুসলিম জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় পাঁচ লাখে। মুসলিম অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে অতি ডানপন্থী কাতালোনীয়রা সরকারের সমালোচনাও শুরু করেছে।
ফলে কাতালোন সরকার এখন মুসলিম অভিবাসীদের নাগরিকত্বের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। কাতালোনে নাগরিকত্বহীন মুসলিম অভিবাসীদের সংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার।
বর্তমানে কাতালোনে শতাধিক মুসলিম কমিউনিটির অধীনে পরিচালিত হচ্ছে দুই শতাধিক মসজিদ ও ১৬ টি মাদরাসা।
স্বাধীনতার প্রশ্নে কাতালোন মুসলিমদের অধিকাংশই স্পেনে থেকে পৃথক হওয়ার পক্ষে। তারা মনে করে, কাতালোন স্বাধীন হলে সমাজে তাদের স্বাধীনতা ও অধিকার বৃদ্ধি পাবে। বাড়বে জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ। কেননা স্বাধীন কাতালোনের ২০% জনগণই মুসলিম।
আরব বিশ্বের জনপ্রিয় সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুট প্রকাশ্যে কাতালোনের স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়ার আহবান জানায়। তাতে সংহতি প্রকাশ করে অন্যান্য মুসলিম সংগঠনগুলো।
মরক্কো বিতাড়িত স্পেনীয় মুর মুসলিমরাও কাতালোনের স্বাধীনতার পক্ষে গণমিছিল করে।
সদ্য স্বাধীনতা ঘোষণাকারী কাতালোনের মতোই অনিশ্চিত কাতালোন মুসলিমদের ভবিষ্যত। কাতালোনের স্বাধীনতা বিপন্ন হলে আরও কঠোরতার মধ্যে পড়তে পারে কাতালোন মুসলিমরা। স্পেন সরকারের মনোভবে আপাতত তাই বোঝা যাচ্ছে।
কাতালোনিয়াকে স্বীকৃতি দেবে না ইউরোপ-আমেরিকা