মুফতি মুহাম্মাদ রাশিদুল হক
অতিথি লেখক
'ব্লু হোয়েল' একটি অনলাইন প্রতিযোগিতামূলক খেলার নাম। নাম থেকে ধারণা করা হয় ব্লু হোয়েল একটি রাশিয়ান অনলাইন গেম। সোশ্যাল গেমিং পেজের অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের নির্দেশ মোতাবেক ৫০ (পঞ্চাশ) দিন ধরে বিভিন্ন টাস্ক পূরণ এবং সর্বশেষ চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্লেয়ারকে আত্মহত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়।
বিশ্বে এখন পর্যন্ত ব্লু হোয়েল খেলতে গিয়ে ১৩০ জনেরও বেশি কিশোর-কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবী করা হয়।
নীল তিমি নিজেই জীবনের একটি পর্যায়ে চলে আসে সমুদ্র তীরে, শুকনা ভূমিতে ধীরে ধীরে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায় ২০০৮ সালে ৫৫টি নীল তিমি একযোগে সমুদ্র সৈকতে চলে আসে, উদ্ধারকারীরা তাদের সাগরে ফেরত পাঠালেও তারা তীরের দিকে বারবার চলে আসে।
আপাতভাবে মনে হয় আত্মহত্যাই যেন তাদের উদ্দেশ্য। ধাপে ধাপে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া এই গেমটির নাম তাই ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ বেছে নেওয়া হয়েছে বলে অনেকে ধারণা করেন।
ব্লু হোয়েল গেমটি রাশিয়ায় ২০১৩ সালে শুরু হয়, ফিলিপ বুদেইকিন নামে সাইকোলজির এক প্রাক্তন ছাত্র নিজেকে ওই গেমের আবিষ্কারক বলে দাবি করে। একুশ বছরের ওই রুশ যুবকের দাবি, যারা মানসিক অবসাদে ভোগে, প্রতিনিয়ত আত্মহত্যার কথা ভাবে, তাঁদের আত্মহত্যার জন্য মজাদার পথ তৈরি করাই এই গেমের উদ্দেশ্য।
ব্লু হোয়েল গেমটি ২০১৬ সালের মে মাসে রাশিয়ান পত্রিকা ন্যভায়া গ্যাজেটা মাধ্যমে প্রথমবারের মতো আলোচনায় আসে। সেখানে ভিকোন্তাকে নামের সামাজিক মাধ্যমের এফ৫৭ নামের একটি গোষ্ঠীর অনুসারী কমপক্ষে ১৬ জন কিশোর-কিশোরীর আত্মহত্যাকে এই গেমটির সাথে সম্পৃক্ততা তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনটি রাশিয়ার উপর একটি নৈতিক ভীতির ঝড় তোলে। অসংখ্য প্রতিবেদন তৈরি হয় কিন্তু এখনও এর কোনটিই সরাসরি আত্মহত্যার সাথে নিদৃষ্ট গোষ্ঠীর কার্যক্রমকে কে দায়ী করার মতো যথেষ্ট মজবুত নয়।
এই গেমের সবচেয়ে আলোচিত দুই ভিকটিম হলেন, ইউলিয়া কোন্সটান্টিনোভা (১৫) ও ভেরোনিকা ভলকোভা (১৬)। তারা দুই জন একই সঙ্গে আত্মহত্যা করেন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাশিয়া ছাড়াও আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, চীন, পাকিস্তান, ইতালিস সহ আরও ১৪টি দেশে বিভিন্ন নামে এই গেমটি চলছে।
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে দেখা যায়, প্রশাসকরা অংশগ্রহণকারীদের ৫০ (পঞ্চাশ) দিনের জন্য পঞ্চাশটি ঝুঁকিপূর্ণ টাস্ক বা কাজ দিয়ে থাকেন। অংশগ্রহণকারীরা সেই সব টাস্ক সম্পন্ন করে নির্দৃষ্ট গোষ্ঠীকে প্রমাণস্বরূপ ছবি বা ভিডিও পাঠায় বা নিজেদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিডিয়ায় সেগুলি পোস্ট করে।
সর্বশেষ, পঞ্চাশতম টাস্ক বা চ্যালেঞ্জটি হলো আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যা করতে পারলেই খেলোয়াড় বিজয়ী।
খেলাটির অন্যতম বিশেষ দিক হল একবার খেলায় অংশগ্রহণ করলে খেলাটি কোনোভাবেই বন্ধ (আনইন্সটল) করা যায় না। এমনকি কেউ বন্ধ করলে তাকে অনবরত নিজের এবং তার পরিবারের মৃত্যুর ভয় দেখানো হয়।
এডমিনদের সাথে অংশগ্রহণকারীদের যোগাযোগ করার উপায় সম্পর্কে কাউকে বলা নিষেধ। টাস্ক শেষ করার সমস্ত প্রমাণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে মুছে ফেলার নির্দেশনা থাকে।
শুরুর দিকের টাস্কগুলো বেশ সহজ এবং অন্যান্য গেমের চেয়ে আলাদা হওয়ায় অংশগ্রহণকারীরা মজা পেয়ে যায়।
২০১৫ সালে গেমটির জের ধরে প্রথম আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে এবং প্রতিদিন ইন্সটাগ্রামে ব্লু হোয়েল গেমটিতে কে কোন লেভেলে আছে তা পোস্ট করার রীতিমতো একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
ধারাবাহিকভাবে, প্রথমে সাদা কাগজে তিমি মাছের ছবি এঁকে শুরু হয় খেলা, ভোর চারটে কুড়ি মিনিটে ঘুম থেকে উঠতে হয়, অংশগ্রহণকারীকে নিজেরই হাতে পিন বা ধারালো কিছু ফুটিয়ে নিজের রক্ত দিয়ে আকঁতে হয় পুর্বের কাগজে আঁকা তিমির ছবি, একা ভূতের ছবি দেখতে হয়, চ্যালেঞ্জের মধ্যে অতিরিক্ত মাদকসেবনও রয়েছে।
এভাবেই প্রতিদিন একেকটি টাস্ক দেওয়া হয় এবং প্রতিটি দিনের মধ্যেই শেষ করার সময় সীমা বেঁধে দেওয়া থাকে।
২০১৬ সালে ফিলিপ বুদেইকিন নামে মনোবিজ্ঞানের এক প্রাক্তন ছাত্র (যাকে তার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত করা হয়েছিল) ব্লু হোয়েল গেমের আবিস্কারক হিসাবে গ্রেপ্তারকৃত হয়।
সে দাবী করে, তার উদ্দেশ্য মূল্যহীন মানুষদের আত্মহত্যায় উৎসাহিত করে সমাজকে পরিচ্ছন্ন করা। বুদেইকিন নির্দোষ এবং এটাকে নিছক মজা দাবী করলেও ২০১৬ এর মে মাসে সে নুন্যতম ১৬ জন কিশোর-কিশোরীর আত্মহত্যার উস্কানিদাতা হিসাবে গ্রেপ্তারকৃত হয় এবং সেন্ট পিটার্সবার্গ পরবর্তীতে সে দুইজন নাবালক আত্মহত্যার উস্কানির জন্যে দোষী প্রমানিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক তৌহিদুল হক বলেন, ‘বেশ কিছুদিন থেকে দেখছি বাংলাদেশ যত বেশি ইন্টারনেটের প্রসার বাড়ছে, তত বেশিই কিন্তু অনলাইনের আকর্ষণটা বাড়ছে। সেই অনলাইনের মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণই হচ্ছে আজকের এই ব্লু হোয়েল গেমস।
এই গেমসের সঙ্গে যারা আসক্ত, তাদের আত্মহত্যার সংখ্যা কিন্তু একেবারে কম না। বাংলাদেশেও এ ধরনের ঘটনার কথা শোনা যাচ্ছে। এ জায়গায় আমাদের অভিভাবকদের একটি শক্ত ভূমিকা পালন করার কথা রয়েছে। ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত বা কলেজ পাস না করা পর্যন্ত কোনো ইন্টারনেটযুক্ত মোবাইল যেন তাদের সন্তানদের না দেন।
ফোন করার জন্য কম দামি ফিচার ফোন ব্যবহার করতে পারে। আর আমাদের দেশের শহরে যে অভিভাবকরা থাকেন, তাদের সন্তানদের স্বাধীনতার নামে যেসব সুবিধা দেন, সেগুলো কিন্তু অনেক সময় কাল হয়ে দাঁড়ায়।’
যারা গেমস ব্যবহার করছে, সেই সন্তানদের সঙ্গে কিন্তু একটি বড় ধরনের গ্যাপ রয়েছে। আমাদের আইসিটি মন্ত্রণালয় আছে, তারা এ বিষয়টি নিয়ে একটি নীতিমালা করবে। আমাদের দেশের নাগরিকদের ইন্টারনেটের ব্যবহার বা এক্সেস কতটুকু হবে, এটা মনে হয় রাষ্ট্রের এখন বেঁধে দেওয়ার সময় হয়েছে।
সাধারণ জনগণ কোন কোন অ্যাপস, সফটওয়্যারগুলো ব্যবহার করতে পারবে, তার একটা নীতিমালা করতে হবে। এমন ঘটনার পরে সারা দেশে কিন্তু একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে যেতে পারে। কাজেই সরকার ও অভিভাবককে সচেতন হতে হবে। আর সারা দেশে স্থানীয় নেতা, ধর্মীয় নেতা ও শিক্ষকদের মাধ্যমে এই সচেতনতা বাড়াতে হবে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি মোস্তাফা বলেন, কোনো মানুষ এ ধরনের ঘটনার শিকার হোক বা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকুক, এটা কেউ চায় না। আমাদের এখানে যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি।
আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দিয়ে যদি এটি ঢুকে, তবে জাতীয়ভাবে এর গেটওয়ে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। ভারতে এরই মধ্যে যেসব এলাকায় এর লিংক আছে, তা মুছে দেওয়া হয়েছে বা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
সরকারের অবশ্যই এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা উচিত। কারণ, ইন্টারনেটের গেটওয়ে সরকারের হাতে। আমরা শুধু সচেতনতা বাড়াতে পারব। এটি ব্লক করে দেওয়ার চাবি সরকারের হাতে।’
সাধারণত অবসাদগ্রস্ত-বিষণ্ন কিশোর-কিশোরীদের আকৃষ্ট করে এই গেম। এখন পর্যন্ত সারাবিশ্বে এই গেমের ফাঁদে পড়ে যতজনের প্রাণ ঝরেছে, তার মধ্যেও বেশিরভাগই কিশোর-কিশোরী।
আসক্ত কিশোর-কিশোরীরা সাধারণত নিজেদের সবসময় লুকিয়ে রাখে। বেশিরভাগ সময়ই তারা থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। চুপচাপ থাকলেও মাঝেমধ্যে অপরিচিত কারো সঙ্গে যোগাযোগ করে। গভীর রাতে ছাদে বেড়াতে যায়। শরীরকে নানাভাবে আঘাত করে।
যে স্মার্ট ডিভাইস বা স্মার্টফোনে গেমটি খেলে, সেটি কেউ ধরলে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। আপনার সন্তান বা পরিচিত কেউ যেন এ ধরনের মারণনেশায় আসক্ত না হয়ে পড়ে, সেদিকে খেয়াল করুন। তাদের সময় দিন।
এই মরণ ফাঁদ থেকে বাঁচার জন্য মনোবিজ্ঞানীরা কিছু পরামর্শ দিচ্ছেন।
১. প্রথমতো আপনাকেই সচেতন হতে হবে। কেন আপনি অপরের নির্দেশনায় কাজ করবেন। আপনি যাকে কখনও দেখেননি, যার পরিচয় জানেন না, তার কথায় কেন চলবেন বা তার কথামতো কেন কাজ করবেন- সেটি নিজেকেই চিন্তা করতে হবে।
২. এরকম কোনো লিংক সামনে এলে তাকে এড়িয়ে চলতে হবে।
৩. সমাজের তরুণ-তরুণীদের কাছে এই গেমের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে।
৪. সন্তান, ভাই-বোন বা নিকটজনকে মোবাইলে ও কম্পিউটারে অধিক সময়ে একাকী বসে থাকতে দেখলে সে কী করছে, তার খোঁজ-খবর নিতে হবে। সন্তানকে কখনও একাকী বেশি সময় থাকতে না দেয়া এবং এসব গেমের কুফল সম্পর্কে বলা।
৫. সন্তানদের মাঝে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার মানসিকতা সৃষ্টি করা। যাতে তারা আত্মহত্যা করা বা নিজের শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করা অনেক বড় পাপ- এটা বুঝতে পারে।
৬. সন্তান ও পরিবারের অন্য কোনো সদস্য মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কিনা- সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখা। কেউ যদি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয় তাকে সঙ্গ দেয়া।
৭. কৌতূহলি মন নিয়ে এই গেমটি খেলার চেষ্টা না করা। কৌতূহল থেকে এটি নেশাতে পরিণত হয়। আর নেশাই হয়তো ডেকে আনতে পারে আপনার মৃত্যু।
লেখক: মুহাদ্দিস গবেষক