শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৫ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিরোনাম :
শিক্ষক ও বাবুর্চি নিয়োগ দেবে রাজধানীর আল্লামা শামসুল হক রহ.মাদরাসা উপজেলা নির্বাচনে যাচ্ছে কি ইসলামি দলগুলো? পাঠ্যপুস্তকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে স্মার্ট জেনারেশন সৃষ্টি সম্ভব নয়: শিক্ষামন্ত্রী বিচ্ছিন্নভাবে দে‌শের স্বার্থ অর্জন করার সুযোগ নেই : সেনা প্রধান স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন সংসদে পাশ করব : স্বাস্থ্যমন্ত্রী যাত্রাবাড়ীতে দুই বাসের মাঝে পড়ে ট্রাফিক কনস্টেবল আহত আ.লীগের মন্ত্রী-এমপির আত্মীয়দের উপজেলা নির্বাচনে নিষেধাজ্ঞা; অমান্য করলে ব্যবস্থা ফকিহুল মিল্লাত রহ. এর পরামর্শ -‘ফারেগিন কার সঙ্গে পরামর্শ করবে’ ঢাকায় চালু হলো চীনা ভিসা সেন্টার ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য পদ দেওয়া নিয়ে ভোট শুক্রবার

রোহিঙ্গা শিবিরের হিরো ৪: মুফতি শামছুদ্দোহা আশরাফী

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

এ এস এম মাহমুদ হাসান
আওয়ার ইসলাম

‘মিয়ানমারের বিতর্কিত সেনা ও বৌদ্ধ মগ গোষ্ঠির লোমহর্ষক নির্যাতনের শিকার হয়ে মুসলিম রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিচ্ছে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে। তাদের অসহায়ত্ব দেখে হৃদয়ে কাঁপুনি সৃষ্টি হলো। তাদের নূন্যতম খাদ্য ও আশ্রয়ের প্রয়োজনীয়তায় আমি ব্যাকুল হয়ে উঠি।

এরই মাঝে আমার কয়েকজন বিদেশী শুভাকাঙ্ক্ষি রোহিঙ্গাদের সাহায্যে আমাকে অর্থ দিতে চাইলেন। আমি তখনই আল্লাহর উপর ভরসা করে মুফতি রেজওয়ান রফিকী, আবুল কালাম তৈয়িবীসহ দশ জনের টিম গঠন করলাম। আমাদের ব্যাক্তিগত অর্থ ছাড়াও অনলাইনে রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার জন্য আবেদন করলাম।

আলহামদুলিল্লাহ ব্যাপক সাড়া পেলাম। আমাদের মনোবল দৃঢ় হলো। অল্প সময়ের মধ্যে অসহায় মুসলিম রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার জন্য আমাদের টিম প্রস্তুত হয়ে গেল। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, মুসলিম রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাহায্যে আমাদের থাকা-খাওয়া, গাড়িভাড়াসহ ব্যাক্তিগত সকল খরচ নিজেদের টাকা দিয়েই করব।’

কথাগুলো ঢাকার তরুণ আলেম এবং ওয়ায়েজ মুফতি মুহাম্মদ শামসুদ্দোহা আশরাফী’র। যিনি রোহিঙ্গা নির্যাতনের করুন চিত্র দেখে বসে থাকতে পারেননি ছুটে গেছেন টেকনাফে।

মুফতি শামসুদ্দোহা আশরাফী জামিয়া ইসলামিয়া রওজাতুল উলুম ইসলামিয়া বাউনিয়াবাঁধ মিরপুর ঢাকার পরিচালক ও প্রধান মুফতি। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগার (সাইন্সল্যাবরেটরি) কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, ধানমন্ডির খতিব। তিনি দেশের শীর্ষ আলেম আল্লামা আশরাফ আলী’র খলিফা।

মুফতি মামসুদ্দোহা আশরাফী কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছিলেন চারদিন। অসহায় রোহিঙ্গাদের জন্য কষ্ট করেছেন। খাদ্যসামগ্রী ও অর্থ দেয়ার পাশাপাশি স্থায়ী কিছুও করেছেন। সেই গল্প শুনুন তার মুখ থেকেই-

টার্গেট ছিল নির্যাতিতদের নিরাপদে ক্যাম্পে নিয়ে আসা

‘আমরা প্রথমে অবর্ণনীয় নির্যাতিত হয়ে আসা মুসলিম রোহিঙ্গাদের উদ্ধার তৎপরতার জন্য মনস্থির করলাম। সোজা চলে গেলাম মিয়ানমার সিমান্তের পার্শবর্তী শাহপরীর দ্বীপে। সেখান থেকে শরণার্থীদের সরকারি ক্যাম্পগুলোতে প্রেরণের জন্য আমরাসহ শত শত আলেম প্রস্তুত ছিলাম।

এখানে এ কাজের জন্য যেহেতু অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী আলেমরা রয়েছেন। তাই আমরা এখানে আর বেশি সময় নষ্ট না করে দুর্গম পাহাড়ে যেয়ে বৌদ্ধদের নিপিড়নে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া শরণার্থীদের উদ্ধার ও সাহায্য করার জন্য রওনা হলাম। কেননা আমাদের কাছে তথ্য ছিল, বৃষ্টিভেজা কর্দমাক্ত পাহাড় থেকে শরণার্থীদের ক্যাম্পে আসা পুরোটাই রিস্ক হয়ে গেছে।

অনেক রোহিঙ্গা ভাইয়েরা সেখানে আটকা পড়ে আছেন। অনেকে শরীরের জখমের কারণে পায়ে হেঁটে ত্রাণ সহায়তার স্থানে আসতে পারছে না। সুস্থ্যতার সামান্যতম ওষুধের সন্ধন পাচ্ছে না। অনেকের শরীর পুড়ে মৃত্যুর পথে ঢলে পড়ছে। এ তথ্যের ভিত্তিতি স্থানীয় পথ প্রদর্শক নিয়ে দ্রুত রওনা হই দুর্গম পাহাড়ের দিকে।

যাদের চিকিৎসা জরুরি ছিল

দুর্গম পাহাড়ে শরণার্থীদের মানবেতর জীবন যাপন দেখে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। খাদ্য সঙ্কটের তীব্রতা দেখে তাদের জিজ্ঞেস করলাম, তারা কি খেয়ে বেঁচে আছে? তারা বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখতে পাহাড়ের পাদদেশে গর্তখুড়ে রেখেছিল। সেখানে জমানো কর্দমাক্ত পানি সামান্য পরিষ্কার হলে তা দিয়ে জীবণ ধারণ করছে। কোনো কোনো পরিবারের মহিলাদের শরীরে যে স্বর্ণালঙ্কার ছিল, তা খুবই স্বল্পমূল্যে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে সামান্য খাবার সংগ্রহ করেছে।

আমরা প্রথমেই তাদের মাঝে বর্মী হিংস্র বৌদ্ধদের আক্রমণে যারা শরীরের ক্ষত নিয়ে নিদারুন যন্ত্রণায় ভুগছে, তাদের ওষুধ দিলাম। আগুনে পোড়া অনেক অবুঝ শিশু ও সন্তান সম্ভবা নারীদের জন্য দ্রুত গতিতে চিকিৎসার ব্যবস্থ্যা করলাম। বৃষ্টির কারণে আমাদের কাজ ব্যহত হচ্ছিল। পাহাড়ি অঞ্চলে এমন বৃষ্টিপাতে পাহাড় টপকানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু মুসলিম শরণার্থীদের দুঃখ দুর্দশা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছিল।

বৃষ্টি আমাদের কাজে বাধা বৃষ্টি করতে পারল না। আমরা বৃষ্টি উপেক্ষা করে আর্থিক সাহায্যের পাশাপাশি এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে উদ্ধার তৎপরতা চালাতে থাকি।’

৪ ধরনের ব্যক্তিদের মধ্যে সহায়তা 

তাদের এমন অসহায়ত্ব ও নির্দয়ভাবে আত্মীয় স্বজন হারানোর বেদনা দেখে মনটা দুমড়ে কেঁদে উঠলো।
আমরা প্রথমত ৪ ধরনের ব্যক্তিদের বিষেশভাবে সাহায্য করালাম।

ক. ছোট্ট অবুঝ শিশুদের জন্য শিশু খাদ্য ও আর্থিক অনুদান খ. সদ্য ভূমিষ্ট শিশুর মা। যিনি বাচ্চাকে কোলে করে ছুটে ত্রাণ সহায়তা নিতে সক্ষম নন। গ. অতি বয়োজেষ্ঠ্য নারী পুরুষ। যারা বৃষ্টি ও রাস্তা পিচ্ছিল হওয়ায় সাহায্য নিতে পারছেন না। ঘ. পর্দানশীল যুবতী ও নারী।

এর পাশাপাশি তাদের তীব্র পানি সঙ্কট দেখে টিউবওয়েলের ব্যবস্থা করতে লাগলাম। বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলো টিউবওয়েলের ব্যবস্থা করেছি আমরা।

তাদের এই ভয়াবহ শোক আর কষ্টের মাঝেও তাদের আথিতিয়তা দেখে অভিভূত হলাম। নরাধম বর্মী সন্ত্রাসীদের হিংস্র তার চিত্র তারা এখনো ভুলতে পারেনি। তারপরও আমরা যখন তাদের কাছে সাহায্য নিয়ে গেলাম, তখন অনেক পরিবারই আমাদেরকে তাদের ঘরে উপস্থিত খাবার নাস্তা হিসেবে দিচ্ছিল। আমি তাদের এমন আচরণ দেখে কাঁদতে বাধ্য হলাম। এমন সভ্য ভদ্র অসহায় মানুষগুলোকে কোন অপরাধে বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা নির্যাতন করে তাড়িয়ে দিল, তা ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে পড়লাম।

Image may contain: 6 people, people standing

মসজিদ ও মক্তব নির্মাণ

দ্বীনের প্রতি তাদের অনেকের ভালোবাসা দেখে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। একদিকে শরীরের আঘাতের যন্ত্রণায় কাতরতা অন্যদিকে খাদ্য সঙ্কটে ভয়াবহ বিপদের সম্মুখিন তারা। এমনকি এখনো তাদের বিশ্রামের জন্য সামান্য খুপড়িরও ব্যবস্থা হয়নি।

তারা জামাতে নামাজ আদায়ের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ল। আমরা তাদের আবেগ দেখে বিভিন্ন পাহাড়ে অনেকগুলো মসজিদ তৈরির কাজে হাত দিলাম। মসজিদ তৈরি করলাম। তারা মসজিদে নামাজ পড়ে দোয়ায় আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করছিল। যে করুন আহাজারি দেখে চোখের পানি আটকাতে পারছিলাম না।

পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের জন্য মাদরাসাও তৈরি করলাম। আমাদের অর্থায়নে শিক্ষক নিয়োগ করলাম। আমাদের নির্মিত মাদরাসা পড়ুয়া মা-বাবা হারা অনেক শিশুদের যতটুকু সম্ভব সাহায্যের ব্যবস্থা করেছি।

এখানে আমাদের অর্থায়নে শিক্ষক নিয়োগও করা হবে ইন শা আল্লাহ। এভাবে লিখেলে ভাল হয়। কারণ কাজগুলো প্রক্রিয়াধীন।

Image may contain: one or more people, people standing, wedding, sky, outdoor and nature

মোটিভেশন

আমরা বৃষ্টিপাত উপেক্ষা করে পাহাড়ের পর পাহাড় হেঁটে এক ক্যাম্প হতে আরেক ক্যাম্প ঘুরে ঘুরে মা বাবা হারা শিশু, স্বামী হারা স্ত্রী, দিকছুটা অভিভাবকহারা যুবতী মেয়েদের কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করলাম। তাদের সান্ত্বনা দিয়ে, অভয় দিয়ে কৃত্রিমভাবে অভিভাবকের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করলাম। তারা ফ্যাল ফ্যাল চোখে বাকরুদ্ধ হয়ে শুধুই আমাদের কথা শুনছিল।

কিন্তু তাদের মনের কষ্টগুলো বলার মত শক্তি ছিল না। বৌদ্ধ সেনাদের নৃশংসতা ও নির্মমতা তাদের চোখে ভেসে উঠছিল। অসভ্য বর্মী সন্ত্রসীদের অত্যাচারের বিভৎসতার চিত্র অনেক রোহিঙ্গা মুহাজিরদের এতটাই মনোবল ভেঙ্গে দিয়েছে যে, তারা খাবার গ্রহনের প্রয়োজনীতাও ভুলে গেছে। স্বজনহারা শোকে এতটাই মুহ্যমান যে, তাদের শরীরের কাঁটা ছেড়া, পোড়া জখমের যন্ত্রনার অনুভুতিও টের পাচ্ছিল না।

তাদের জন্য জরুরি ছিল তাদের মনোবল ফেরানো। আমরা কিছু মানুষের মধ্যে হলেও সে চেষ্টা সফল করতে সক্ষম হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ।

মুফতি মুহাম্মদ শামসুদ্দোহা আশরাফী’র টিম তাৎক্ষণিক ৫ লাখ টাকার ত্রাণ বিতরণ করেছে। এছাড়াও পুরো চারদিন দিয়েছেন কায়িক শ্রম। সামনে আরও সহযোগিতার চেষ্টাও করে যাচ্ছেন। যারা ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন তাদের দিচ্ছেন সুপরামর্শ।

তিনিই আমাদের হিরো। আমাদের রিয়েল হিরো।

রোহিঙ্গা শিবিরের হিরো ৩ : দেলাওয়ার হোসাইন সাকী


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ