মাওলানা ইউসুফ নূর। কাতারে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পরিচিত মুখ। ১৯৯৬ সালে কাতার সরকারের নিয়োগ পেয়ে ইমাম হিসেবে সেদেশে যান তিনি। এরপর তিনি আপন মেধা ও প্রতিভায় কাতারে নিজেকে অনন্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দায়িত্বপালন করেছেন একাধিক সরকারি ও ধর্মীয় পদে। নোয়াখালির মাইজদির এ কৃতি সন্তান বর্তমানে কাতারের একজন প্রসিদ্ধ ইমাম ও খতিব। পাশাপাশি ওয়ায়েজ ও ইসলামিক স্কলার হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন।
কাতারে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান আল নূর কালচারাল সেন্টারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালকও তিনি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বাংলাদেশিকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে আল নূর। সম্প্রতি মানবীয় ভ্রাতৃত্ববোধ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।
বর্তমানে তিনি বাংলাদেশে রয়েছেন। তার সোনালি শৈশব ও সফল কর্মজীবন, আল নূর ও তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য, মধ্যপ্রাচ্যে কওমি শিক্ষার্থীদের বিপুল সম্ভবনা নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। ঢাকার বায়তুল মোকাররমে এক অনুষ্ঠানের ফাঁকে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রোকন রাইয়ান ও আতাউর রহমান খসরু।
আওয়ার ইসলাম : আপনার জন্ম ও শিক্ষা জীবন সম্পর্কে জানার আগ্রহ ছিল...
মাওলানা ইউসুফ নূর : আমার জন্ম ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে। বিজয়ের মাসে। নোয়াখালী শহরের মাইজদিতে। আমার দাদা হাজি সেকান্দার ছিলেন তাবলিগ জামাতের সাবেক আমির। আমার আব্বা ছিলেন নোয়াখালী জেলার একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।
আমার লেখাপড়া শুরু হয় নোয়াখালী জেলার দত্তরহাট দারুস সুন্নাহ মাদরাসায়। এখানে আমি মক্তব ও হিফজ বিভাগে পড়ি। প্রাথমিক শিক্ষা তথা নাহবেমির পর্যন্ত হামিউস সুন্নাহ মেখল মাদরাসায় পড়ি।
মাধ্যমিক স্তর চট্টগ্রামের বিখ্যাত লালখান বাজার মাদরাসায় পড়ি মেশকাত ও দাওরা পড়েছি হাটহাজারি মাদরাসায়। ১৯৯৪ সালে আমি দাওরা হাদিস সম্পন্ন করি।
আওয়ার ইসলাম : শিক্ষা জীবনে শেষ করে কর্মজীবনের প্রবেশ হয়েছিলো কিসের মাধ্যমে?
মাওলানা ইউসুফ নূর : ছাত্র জীবন থেকে আরবির প্রতি আমার বিপুল আগ্রহ ছিলো। আরবি চর্চায় আনন্দ পেতাম। ভালো লাগতো। তাই দাওরা হাদিসের পর উচ্চতর আরবি শিক্ষার জন্য আমি ভারতের নদওয়াতুল উলামাতে যাই কিন্তু ভিসা জটিলতার কারণে বছরের শেষ দিকে চলে আসতে হয়।
অবসর সময় কাটাতে তৎকালীন সৌদি সরকারের আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা পরিচালিত ইমাম আবু হানিফা ইনস্টিটিউট অনুষ্ঠিত দাওয়াহ কোর্সে অংশ গ্রহণ করি। আমরা প্রায় ৬০ জন তাতে অংশগ্রহণ করি। সমাপণী পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হই। ফলে তারা আমাকে সমাপণী অনুষ্ঠানে ছাত্রদের পক্ষ থেকে বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ দেন।
অনুষ্ঠানটি আমার জীবনের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিলো। সেখানে অনেক শীর্ষ ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন। সৌদির রাষ্ট্রদূত, কাতারের রাষ্ট্রদুত এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সকল ইসলামিক কূটনৈতিকগণ।
বাংলাদেশের শীর্ষ আলেমদের মধ্যে শায়খুল হাদিস আল্লামা আজীজুল হক রহ.সহ আরও অনেকে ছিলেন। আমার আরবি বক্তৃতা শুনে সৌদির বিখ্যাত আল হারামাইন ফাউন্ডেশন তাদের সেন্টারে আরবি ও কুরআন প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। আমি তাদের রংপুর ও কিশোরগঞ্জ সেন্টারে বছর খানিক দায়িত্ব পালন করি।
আওয়ার ইসলাম : আর কাতার...
মাওলানা ইউসুফ নূর : এরপর কাতার থেকে ইমাম পদে সার্কুলার আসে। কিছু আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের অনুরোধে সেখানে ইন্টারভিউ দেই কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই। সৌভাগ্যক্রমে আামি টিকে যাই। ১৯৯৬ সনের ৪ এপ্রিল আমি সেখানে ইামামতির জন্য যাই।
আওয়ার ইসলাম : কাতারে গিয়ে নিজেকে কিভাবে মেলে ধরলেন?
মাওলানা ইউসুফ নূর : কাতারে যাওয়ার দুই বছর পর আমি সেখানে কুরআন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাই। তিন বছর পর আমি সেখানে খতীর হিসেবে নিয়োগ পাই। এজন্য অবশ্য আমাকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও পরীক্ষা দিতে হয়েছে।
ছয় বছর পর আমি সেখানে কাতার সরকারের দাওয়াহ প্রতিষ্ঠান ইসলাম পরিচিতি কেন্দ্র যা কাতার সরকার কর্তৃক অনারব ভাষায় পরিচালিত একটি আন্তর্জাতিক দাওয়াহ প্রতিষ্ঠান সেখানে আমি বাংলাদেশি দায়ী হিসেবে নিয়োগ পাই।
২০০৪ সালে এ প্রতিষ্ঠানটিই কাতার ইসলামিক কালচারাল সেন্টার বা ফানার নাম ধারণ করে নতুন ভবনে স্থানান্তরিত হয়। কাতারের দৃষ্টিনন্দন ভবনগুলোর মধ্যে এটি একটি। বর্তমানে এটি পৃথিবীর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বৃহত্তম দাওয়া প্রতিষ্ঠান। এখানেই আমি ১৩ বছর যাবত খেদমতে আছি।
এ সেন্টারের অধীনে আমি বিভিন্ন মসজিদে ওয়ায়েজ ও দায়ি হিসেবে কাজ করছি। এ সেন্টার কর্তৃক পরিচালিত আরবি ভাষা প্রশিক্ষণ কোর্সে একমাত্র অনারব শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাই।
ইসলামিক কালচারাল সেন্টারে আমার কাছে কাতারে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের শীর্ষ কর্মকর্তাগণ ও কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আরবি ভাষা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
আওয়ার ইসলাম : কাতারে সম্ভবত আপনি সৌভাগ্যবান বাংলাদেশি যিনি একসঙ্গে এতোগুলো দায়িত্ব পালন করেছেন এবং করছেন। কোন দায়িত্বটি বেশি আনন্দের মনে হয়?
মাওলানা ইউসুফ নূর : সব দায়িত্ব ও স্বীকৃতিই আনন্দের। তবে একটি বিষয় আমাকে আনন্দ দেয়। তাহলো, আলহামদুলিল্লাহ কাতার সরকারের পক্ষ থেকে সরকারি মুয়াল্লিম হিসেবে সাতবার হজ করার সুযোগ পেয়েছি।
কাতারে হজ এজেন্সিগুলো নিজে থেকে মুয়াল্লিম নিতে পারে না। সরকার দিয়ে দেন। সেখানে আমাকে সরকার সাতবার নির্বাচন করেন। আমার সেখানে দায়িত্ব ছিলো, হাজিদের আরবি বাংলা ও উর্দু ভাষায় হজের নিয়মাবলি বুঝা নো।
কাতারে আমি বিশিষ্ট হজ মুয়াল্লিম বা প্রশিক্ষক হিসেবে সম্মাননা সনদ ও সংবর্ধনা পেয়েছি কাতারের সরকারি হজ মিশনের পক্ষ থেকে।
আওয়ার ইসলাম : আল নূর কালচারাল সেন্টার আপনার বিশেষ কৃতিত্ব। প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার গল্পটা যদি বলতেন?
মাওলানা ইউসুফ নূর : গত আটবছর আগেও কাতারের বাংলাদেশি কমিউনিটিগুলোর কাতারের ভাষা বা সংস্কৃতি শিক্ষা দেয়ার জন্য কোনো সংস্থা ছিল না। অথচ ইন্ডিয়ান কমিউনিটি, পাকিস্তান কমিউনিটির লোকেরা তাদের নাগরিকদের সে দেশের কালচার বা সংস্কৃতি শেখানোর জন্য সংস্থা তৈরি করেছে।
আমাদের বাংলাদেশের যারা উচ্চ শিক্ষিত তারা তাদের বিভিন্ন কাজে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে পারলেও, কম শিক্ষিত লোকেরা সে দেশের কালচারের সাথে মিশে চলতে পারে না। কাতারিদের কথাও বুঝতে পারে না।
তাই আমরা বাংলাদেশিদের সে দেশের কালচার সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ দিতে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি যার নাম আল নূর কালচারাল সেন্টার। এতে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাটা এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে সব ধর্মের মানুষ দলমত নির্বিশেষে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। আমরা বিশ্বাস করি আমাদের কোনো কার্যক্রমই বিশেষ করে সেবামূলক কার্যক্রমগুলো সকল ধর্মের মানুষের জন্যই হওয়া দরকার । আর আমরা করেও থাকি এটা।
আওয়ার ইসলাম : আল নূরের প্রধান প্রধান কাজগুলো কী?
মাওলানা ইউসুফ নূর : আমাদের আল নূর কালচারাল সেন্টারে কয়েকটি বিভাগ রয়েছে। যেমন
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বিভাগ
এ বিভাগের আন্ডারে আরবি ও ইংরেজি ভাষা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছাড়াও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে বাংলা ভাষা প্রশিক্ষণ। এছাড়াও রয়েছে নারী পুরুষ উভয়ের জন্য কুরআন ও ইসলামী শিক্ষার ব্যবস্থা। রয়েছে হজ ওমরা ও রমজান প্রশিক্ষণ।
সংস্কৃতি বিভাগ
এতে সাপ্তাহিক পাক্ষিক ও মাসিক বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, কর্মশালা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ক্যাম্পেইন ও কাতার ও বাংলাদেশের জাতীয় দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির আয়োজন। আল নূরের অধীনেরই অনুষ্ঠিত হয়েছে আরব ও কাতারের বুকে প্রথম বাংলাভাষা সম্মেলন ও বৈশাখি সম্মেলন।
গত ৩ বছর ধরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য বিষয়ক কুইজ প্রতিযোগিতায় কয়েকশ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছে। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে এ প্রতিযোগিতাগুলো আরবি ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় আয়োজন করা হয়েছে।
কাতারের আর কোনো বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ৩ ভাষায় কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন এ পর্যন্ত করেনি।
আল নূর কালচারাল সেন্টারই কাতার সরকার অনুমদিত বাংলাভাষীদের জন্য একমাত্র প্রতিষ্ঠান। এর সব প্রশিক্ষক বিনা বেতনে স্বেচ্ছায় মানুষদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।
প্রকাশনা ও গবেষণা বিভাগ
এতে বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে আরবি ভাষায় রূপান্তরিত করে আরবদের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করা হয়। আমাদের সাহিত্য তাদের কাছে পৌঁছায়নি বলে তারা আমাদের বন্যাদুর্গত ও অভাবী জাতি হিসেবেই চেনে।
অন্যদিকে উর্দু ভাষাভাষীদের সাহিত্য তাদের কাছে পৌঁছেছে বলে তারা তাদের সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে থাকেন। যেমন আল্লামা ইকবালসহ আরো অনেককে তারা শ্রদ্ধার চোখে দেখে।
এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক সাহিত্য আরবি হয়েছে। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি সেভাবে আরবিতে তুলে ধরা হয় নি। আমাদের যে সুবিশাল অর্জন রয়েছে তা আরববিশ্বে তুলে ধরতে পারলে আমাদেরও সম্মানের চোখে দেখা হবে। নজরুল, ফররুখ, কায়কোবাদ থেকে শুরু করে সমকালীন কবি-সাহিত্যিকদের তুলে ধরা।
পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টাও চলছে। আমরা কাজও শুরু করেছি।
একইভাবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে কাতারকে তুলে ধরা, কাতারে যাওয়া নতুন শ্রমিকদের কাছে কাতারের নিয়ম-নীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি তুলে ধরা, তাদের আইনি সহায়তা দেয়া, গুরুত্বপূর্ণ আরবি সাহিত্য বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা, বাংলাদেশের তরুণ ও উদীয়মান লেখকদের সাহায্য করা, বাংলাদেশের মানুষের মাঝে কুরআন বিতরণ করা এবং কুরআন অনুবাদের কাজও এ বিভাগের আন্ডারে চলছে।
এছাড়াও এ বিভাগের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফ্রি কুরআন শরীফ বিতরণ করা হয়েছে। সম্প্রতি এ বিভাগ থেকে ড. ইউসুফ আল কারজাভি লেখিত ‘বুদ্ধিবৃত্ত জাগরণের প্রত্যাশায়’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে।
সমাজ কল্যাণ বিভাগ
সমাজকল্যাণ বিভাগের আওতায় আমরা কাতারে রক্তদান কর্মসূচি পরিচালনা করেছি। নবাগত শ্রমিকদের আইনি সহায়তা প্রদান এ বিভাগের অন্যতম লক্ষ্য।
বাংলাদেশে আমরা বিভিন্ন উপজেলায় কয়েকশ নলকূপ স্থাপন করেছি। রমজানে ইফতার বিতরণ, ঈদে উপহার বিতরণ, কুরবানির ঈদে পশু কুরবানি করে দরিদ্র মানুষের মাঝে গোশত বিতরণ করা হয়ে থাকে।
এছাড়াও এ বিভাগের অন্ডারে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুল-মাদরাসা ও কলেজে সর্বমোট ২৭৪ জন শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেয়া হচ্ছে।
গণসংযোগ বিভাগ
উপরের কাজগুলো সমাজের সব স্তরের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে এ বিভাগ কাজ করে। ঈদ উৎসব ও বছরে একাধিকবার বিনোদনমূলক বনভোজনের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এতে কমিউনিটির ব্যক্তিবর্গ স্বপরিবারে অংশ নিয়ে থাকে।
মহিলা বিভাগ
আমাদের সব কাজে মহিলাদেরও পৃথক অথচ সমান্তরাল অংশগ্রহণ রয়েছে। আল নূর কাতারে একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে নারী-পুরুষ উভয়কে নিয়ে কাজ করে থাকে।
আল নূর কালচারাল সেন্টার সব শ্রেণি, সব ধর্ম, মতবাদ ও মতাদর্শের মানুষের জন্য উন্মুক্ত। এটি একটি মুক্ত মঞ্চ। এখানে সব দল ও মতের মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারে। আমরা চাই বিশ্বের যেখানে যেখানে বাংলাদেশিরা রয়েছেন তারা আমাদের শাখা খুলতে পারেন। প্রয়োজনে অন্য নামেও খুলতে পারেন। আমরা তাদের সঙ্গে আমাদের আইডিয়া শেয়ার করবো এবং যথাসম্ভব সাহায্য করবো।
আজ থেকে ছয় বছর আগে নিউ ইয়র্কে আল নূর কালচারাল সেন্টারের শাখা খোলা হয়। দুই বছর আগে আমরা বাংলাদেশেও কার্যক্রম শুরু করেছি। ঢাকার মাতুয়াইলে নিজস্ব ভবন নির্মাণ হচ্ছে। ইতোমধ্যেই চারতলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
https://www.facebook.com/qataralnoor/videos/118450898891213/
আওয়ার ইসলাম : আরব ও অনারবের সভ্যতা সংস্কৃতির পারস্পারিক পরিচয় কেনো প্রয়োজন? আপনাদের বিভিন্ন কাযক্রমের মাধ্যমে আপনারা যা করতে চাচ্ছেন?
মাওলানা ইউসুফ নূর : সভ্যতা-সংস্কৃতির পারস্পারিক পরিচয় না ঘটলে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে না। আমাদের এ কমিউনিকেশন গ্যাপের জন্য আরবরা আমাদের সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখলেও আমাদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ নেই। ইউরোপ আমেরিকার প্রতি যেমন রয়েছে। পরিচয় ও পরিচিতির জন্য সামগ্রিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে। সরকারের একার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়।
একইভাবে আমাদেরও আরব বিশ্ব সম্পর্কে জানতে হবে। কেননা আরব সভ্যতা মানে মুসলিম সভ্যতা, আরব সভ্যতা মানে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎসভূমি। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ইউরোপ আরবের কাছ থেকেই পেয়েছে।
আওয়ার ইসলাম : আল নূর কালচারাল সেন্টারের কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার চিন্তা মাথায় আসে কখন?
মাওলানা ইউসুফ নূর : আল নূর কালচারাল সেন্টার কাতারের কার্যক্রম দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে যখন নিউ ইয়র্কের প্রবাসী বাংলাদেশিরা এর শাখা খুলতে চাইলো এবং সফলভাবে তা বাস্তবায়ন করলো তারপর থেকে আমাদের কাযক্রম বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার অনুপ্রেরণা পাই এবং অগ্রসর হই।
আওয়ার ইসলাম : আল নূর কালচারাল সেন্টারের শাখা খুলতে চাইলে করণীয় কি?
মাওলানা ইউসুফ নূর : আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। যোগাযোগ করলে আমরা আমাদের আমাদের আইডিয়া শেয়ার করবো এবং সাধ্যানুযায়ী সাহায্য করবো।
আওয়ার ইসলাম : কওমি মাদরাসার একজন শিক্ষার্থীর জন্য আরববিশ্বে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এবং নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ কতটুকু এবং তা কিভাবে কাজে লাগাতে পারে?
মাওলানা ইউসুফ নূর : আপনি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন। আমি মনে করি, আরব বিশ্বে কাজ করার সুযোগ একজন কওমি আলেমের যতোটা রয়েছে অন্য কারো তা নেই। কওমি মাদরাসার মেধাবী তরুণদেরই সবচেয়ে বেশি সুযোগ রয়েছে।
আরব বিশ্বে তারা যতোটা সফল অন্য কোনো ধারার লোকজন ততোটা সফল নয়। মধ্যপ্রাচ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ছেন এবং যারা ভালো ফলাফল করছেন তাদের ৯০ ভাগই কওমিপড়ুয়া।
কাতারেও দাওয়াহ, শরিয়াহ, ফিকহ ইত্যাদি বিষয়ে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের ফলাফল ঈর্ষণীয়। এ ক্ষেত্রে মাদরাসাতুল মদিনার শিক্ষার্থীরাই বেশি অগ্রসর। আরবি ভাষায় তার এগিয়ে থাকার কারণে। সুলতান যওক নদভীর পরিচালিত দারুল মাআরিফের সাফল্যও চোখের পড়ার মতো।
কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীগণ আরবি ভাষার চর্চায় আরো মনোযোগী হলে তাদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। আমি মনে করি, এটা খুব কঠিন কিছু না।
সম্প্রতি সরকার কর্তৃক কওমি মাদরাসাকে স্বীকৃতি প্রদান কওমি শিক্ষার্থীদের জন্য আরও কাজের সুযোগ করে দেবে। এ জন্য কাতার আল নূর সেন্টারের পক্ষ থেকে মাননীয় সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলা ভাষা সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সনদ বিতরণ
আওয়ার ইসলাম : আপনি কাতারের মতো একটি দেশে নিজ অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত। দেশের মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ রয়েছে আপনার। এ ক্ষেত্রে দেশের মানুষের; বিশেষত আলেম সমাজের জন্য আপনার বিশেষ কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি?
মাওলানা ইউসুফ নূর : সত্যি বলতে, আলেমদের জন্য আমার বিশেষ কোনো পরিকল্পনা নেই। তারা সত্যি অনেক সৌভাগ্যবান। আমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের জন্য।
সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদভি রহ. এর ভাষায় তারা ইরতিদাদি (নাস্তিক্যবাদী) শিক্ষা নিয়ে বড় হচ্ছে। তাদেরকে কিভাবে ইসলামমুখী করা যায় সেটাই আমি ভাবি।
আমি মনে করি, আমাদের সমাজের অমুসলিম নাগরিকদের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব থাকার কারণে তারা ইসলাম ও মুসলিম সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করছে না। স্বার্থান্বেষী মহল তাদের ভুল বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে। অমুসলিমদের মাঝে ইসলাম সম্পর্কে সু-ধারণা তৈরি করার ইচ্ছে আমার রয়েছে।
আল নূর কালচারাল সেন্টারের বাংলাদেশ শাখাকে আমি সেভাবেই গড়ে তুলতে চাই। যেনো সমাজের সর্বশ্রেণির মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
আওয়ার ইসলাম : আল নূরের কার্যক্রম নিয়ে আপনি কাতার ও বাংলাদেশের বাইরে কোথাও গিয়েছেন কি?
মাওলানা ইউসুফ নূর : আমি ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে আল নূর কালচারাল সেন্টার নিউ ইয়র্ক শাখার আমন্ত্রণে ২০ দিনের জন্য আমেরিকা যাই। সেখানে আমি আল নূর অন্যান্য সংগঠনের আয়োজিত প্রায় ২০টি সভা-সেমিনারে বক্তব্য রাখি। একাধিক মসজিদে জুমা পড়ানোর সুযোগ হয়েছে।
আল হামদুলিল্লাহ! আমি সেখানে আল নূর কালচারাল সেন্টার বাংলাদেশিদের নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছে।
২০১৬ সালের আমি আবার আমেরিকা যাই। সেখানে হজরত শাহজালাল রহ. ইসলামিক সেন্টারের তাবারির ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। সেবারও আল মদিনা মসজিদসহ বিভিন্ন মসজিদে জুমান নামাজ পড়াই। নিউ ইয়র্কের আইটিভিতে আলোচনায় অংশগ্রহণ করি।
এ সফরে আমি তুরস্কের দীনিয়াত সেন্টার পরিদর্শন করি এবং ব্যাপকভাবে উপকৃত হই।
আওয়ার ইসলাম : আমেরিকান প্রবাসী মুসলিমদের দীনচর্চার কি অবস্থা তখন দেখেছেন?
মাওলানা ইউসুফ নূর : এ সফরে আমি আমেরিকার বাফেলো শহরে যাই। এ শহরকে আপনি দ্বিতীয় ঢাকা বা করাচি বলতে পারেন। এ শহরের অসংখ্য মাদারাসা রয়েছে। মাদরাসাগুলো কওমি ধারার মাদরাসা। খুশির ব্যাপার হলো এক নিউ ইয়র্ক শহরে তিন শতাধিক মসজিদ রয়েছে। প্রত্যেক মসজিদে দীন শিক্ষার ন্যূনতম ব্যবস্থা হিসেবে মক্তব রয়েছে। এগুলোও কওমি ধারার আলেমগণ পরিচালনা করেন।
আওয়ার ইসলাম: ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের সময় দেয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
মাওলানা ইউসুফ নূর : আমার পক্ষ থেকেও আওয়ার ইসলামের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। এখানে একটি কথা না বললেই নয়, এ পোর্টালটি খুব স্বল্প সময়ে আমাদের পরিচিত গণমাধ্যম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বিশেষ করে আমরা প্রবাসীরা আওয়ার ইসলামকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে পাঠ করি। আপনাদের উত্তোরত্তর সাফল্য কামনা করছি।
বার্মায় মুসলমানদের করণীয় বিষয়ে ১৯৬১ সালে দেয়া আলি মিয়া নদভীর ভাষণ