সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
চিকিৎসকরা বছরে দুইবারের বেশি বিদেশ যেতে পারবেন না ঢাকা থেকে ভাঙ্গা হয়ে খুলনায় গেলো পরীক্ষামূলক ট্রেন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন প্রধান উপদেষ্টা: প্রেস উইং ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সাম্যের ভিত্তিতে সংবিধান রচনার আহ্বান নেপালে ফের কুরআন প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে সৌদি আগামীকাল সংবিধান সংস্কার কমিশনে প্রস্তাবনা পেশ করবে ইসলামী আন্দোলন ‘আল্লামা আতহার আলী রহ. জীবন, কর্ম, অবদান’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন আগামীকাল হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. : কে এই মহান ব্যক্তি হাজিদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ : ধর্ম উপদেষ্টা মহানবীকে সা. নিয়ে কটূক্তি করলে সংবিধানে শাস্তির বিধান রাখার প্রস্তাব পার্থের

আরাকানের মুসলমান : ইতিহাস ও ঐতিহ্য

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক
অতিথি লেখক, আওয়ার ইসলাম

আরাকানে ইসলামের প্রবেশ: বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চল ও মিয়ানমারের আরাকান সীমান্তগত দিক থেকে শুধু প্রতিবেশীই নয় বরং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের কোনো কোনো অঞ্চল বিচ্ছিন্নভাবে প্রায় ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত বেশিরভাগ সময় আরাকানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে বাংলায় ইসলাম প্রচারের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে যেমন চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারকে আলোচনা করা হয় তেমনি আরাকানে ইসলামের আগমন আলোচনা করতে হলেও চট্টগ্রামের আলোচনা অপরিহার্য। সার কথা- চট্টগ্রামে ইসলামের আগমন অর্থই হলো আরাকানে ইসলাম প্রচারের সূচনা।

আরাকান বা বর্তমান রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে মিয়ানমার সরকার বিদেশী আখ্যা দিলেও ঐতিহাসিক সত্য হলো- আরাকান অতি প্রাচীনকাল থেকেই ছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। মিয়ানমারই বরং আগ্রাসন চালিয়ে আরাকান জবর দখল করেছে। আরাকানে ইসলামের আগমনও ঘটেছে রাসূল সা.-এর সময়েই।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক বিশিষ্ট গবেষক ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দের মতে- ‘হিজরি প্রথম শতকের শেষ দিকে (৯৬ হিজরি) ৭১২ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া শাসনামলে মুসলিম সেনাপতি মুহাম্মাদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে সিন্ধু অঞ্চলে ইসলামের বিজয় নিশ্চিত হওয়ার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজনৈতিকভাবে ইসলামের প্রতিষ্ঠা শুরু হলেও মূলত পবিত্র মক্কায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রায় সমসাময়িক কালে মহানবী সা.-এর জীবদ্দশাতেই ভারতীয় উপমহাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশেষত আরাকান অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো হয়।

কেননা খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর পূর্ব থেকে আরব বণিকরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক পথে ভারত, বার্মা ও চীনের ক্যান্টন বন্দরে বাণিজ্যিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে সূত্রেই আরবের কুরাইশরাও ইসলামপূর্ব যুগেই এ বাণিজ্যপথে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেন।

Image result for Arab trade caravan

আরব বণিক কাফেলা

বিশেষত পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে পারস্য (ইরান) ও রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে অব্যাহত যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে আরবদের স্থলবাণিজ্যপথ মারাত্মকভাবে বিপদসঙ্কুল হয়ে পড়েছিলো। ইয়েমেন ও হাজরা মাউতের আরব বণিকদের নৌবানিজ্যের পূর্ব অভিজ্ঞতার সুবাদে আরবের কুরাইশরাও নৌবাণিজ্যে আগ্রহী হয়ে পড়ে। সে সূত্রেই মহানবী সা.-এর আগমনের আগেই তারা ভারতীয় উপমহাদেশ, বার্মা, কম্বোডিয়া ও চীনের ক্যান্টন পর্যন্ত বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীর সূচনালগ্নেই তারা দক্ষিণ ভারতের মালাবার, কালিকট, চেররবন্দর, তৎকালীন আরাকানের চট্টগ্রাম ও আকিয়াবের সমুদ্রোপক‚লে স্থায়ী বাণিজ্যিক উপনিবেশও গড়ে তোলেন।

পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার সমসাময়িক কালের মুসলমানরাও বাণিজ্যিক কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য করতে আসে এবং সপ্তম শতাব্দী থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত চীনা বাণিজ্যে মুসলিম প্রভাব অব্যাহত রাখে। তৎকালীন দক্ষিণ চীনের ক্যান্টন বন্দর ‘খানফু’ নামে পরিচিত ছিল। মুসলিম বণিকরা এ সময় ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল বিশেষত মালাবার এবং চট্টগ্রাম থেকে কাঠ, মসলা, সুগন্ধিদ্রব্য ও ওষুধি গাছ-গাছড়া সংগ্রহ করতেন। বাণিজ্যিক কারণে মুসলমানরা এসব অঞ্চল সফর করলেও মূলত ইসলাম প্রচার তাদের মুখ্য বিষয় ছিল। ( ابى معاذاحمد عبد الرحمن - مسلمواراكان و ستون عاما من الاضطهاد (مكة مكرمة : شبكة الالوكة ১৪৩৪ ه – ص ৫৪)

চীনের কোয়াংটা শহরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন কাদেসিয়া যুদ্ধের বিজয়ী সেনাপতি হযরত সাআদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা.-এর পিতা আবু ওয়াক্কাস মালিক ইবনে ওয়াইব রা.। এরই অদূরে তাঁর মাজার এখনো বিদ্যমান। আবু ওয়াক্কাস রা. মহানবী সা.-এর নবুওয়তের সপ্তম বছরে হযরত কায়স ইবনে হুযায়ফা (রা), হযরত ওরওয়াহ ইবনে আসাসা রা. এবং হযরত আবু কায়স ইবনে হারেস রা.-কে সঙ্গে নিয়ে একটি সমুদ্র জাহাজে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক পথে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন বলে জানা যায়। তারা উক্ত জাহাজে প্রথমত ভারতের মালাবারে এসে উপস্থিত হন এবং সেখানকার রাজা চেরুমল পেরুমলসহ বহুসংখ্যক লোককে ইসলামে দীক্ষিত করে চট্টগ্রামে এসে যাত্রা বিরতি করেন। অতঃপর তিনি ৬২৬ খ্রিস্টাব্দে চীনের ক্যান্টন বন্দরে গিয়ে উপস্থিত হন।

আবু ওয়াক্কাস রা.-এর দলটি ৬১৭ খ্রিস্টাব্দে রওয়ানা দিয়ে প্রায় নয় বছর পর চীনে পৌঁছান। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, এ ৯ বছর তারা পথিমধ্যে বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোতে ইসলাম প্রচারের কাজে ব্যয় করেছেন। কারণ চীনে আগমনের জন্য আরব দেশ থেকে রওনা করলে বাতাসের গতিবেগের কারণে বিভিন্ন স্থানে নোঙর করতে হতো।

Image result for rohingya muslims

বিশেষত বণিকেরা এ ক্ষেত্রে মালাবার, চেরর, চট্টগ্রাম, আকিয়াব, চীনের ক্যান্টন প্রভৃতি স্থানে জাহাজ নোঙর করতো। অতএব, অনুমান করা যায়- তিনি মালাবারের পর চট্টগ্রাম ও আকিয়াবেও জাহাজ নোঙর করে ইসলাম প্রচারের কাজ করেছেন এবং সে সূত্রেই হিন্দের (বৃহত্তর ভারতের কোনো অঞ্চলের) জনৈক রাজা কর্তৃক মহানবী সা.-এর কাছে তোহফা পাঠানোর উল্লেখ পাওয়া যায়। হযরত আবু সাঈদ খুদুরী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হিন্দের জনৈক শাসক মহানবী সা.-এর কাছে এক পোঁটলা হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন যার মধ্যে আদাও ছিল। মহানবী সা. সাহাবীদেরকে তার (আদার) এক টুকরা করে খেতে দিয়েছিলেন এবং (রাবি বলেন) আমাকেও এক টুকরা খেতে দেয়া হয়েছিলো। (হাকীম আবু আবদুল্লাহ, আল মুসতাদরাক, ১/৩৫)।

হিন্দের কোন শাসক মহানবী সা.-এর কাছে হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। তবে, রুহমি রাজ্যের শাসকরা বহুকাল আগে থেকেই পারস্যের শাসকদের কাছে মূল্যবান হাদিয়া-তোহফা পাঠাতো। সম্ভবত এ রুহমি রাজাদেরই কোনো রাজা মহানবী সা.-এর কাছে হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন। (আরব ওয়া হিন্দ আহদে রেসালত মে : পৃষ্ঠা ১৬০)

স্থলপথ জলপথ উভয় পথেই আরবগণ তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতো। উটের সাহায্যে স্থলপথে এবং নৌযানের সাহায্যে তারা বাণিজ্য-উদ্দেশ্যে দেশ থেকে দেশান্তরে ভ্রমণ করতো। প্রাক ইসলামী যুগেই তারা একদিকে সমুদ্র পথে আবিসিনিয়া এবং অপরদিকে সুদূর প্রাচ্য চীন পর্যন্ত তাদের ব্যবসায় ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করেছিলো।

তৎকালীন ভারত উপমহাদেশে বহির্জগত থেকে যেসব মুসলমান আগমন করেছিলেন, তাদেরকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এক শ্রেণির মুসলমান ব্যবসা-বাণিজ্য করার উদ্দ্যেশ্যে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আগমন করে ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার করেন। কতিপয় ওলী দরবেশ ফকীহ শুধুমাত্র ইসলামের দাওয়াত ও তবলীগের জন্যে আগমন করেন এবং এ মহান কাজে সারা জীবন অতিবাহিত করে এখানেই দেহত্যাগ করেন।

আর এক শ্রেণির মুসলমান এসেছিলেন- বিজয়ীর বেশে দেশজয়ের অভিযানে। তাঁদের বিজয়ের ফলে এ দেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ হয়। বলা বাহুল্য- ৭১২ খৃষ্টাব্দে ভারতের সিন্ধু প্রদেশে সর্বপ্রথম মুহাম্মাদ বিন কাসিম আগমন করেন বিজয়ীর বেশে এবং এটা ছিল ইসলামের বিরাট রাজনৈতিক বিজয়। কিন্তু পবিত্র মক্কায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রায় সমসাময়িককালে রাসূলুল্লাহ সা.-এর জীবদ্দশাতেই ভারতীয় উপমহাদেশসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিশেষত আরাকান অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে।

কেননা খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর পূর্ব থেকেই আরব বণিকেরা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক পথে ভারত, বার্মা ও চীনের ক্যাপ্টেন বন্দরে বাণিজ্যিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলো। সেই সূত্রেই আরবের কুরাইশরাও ইসলামপূর্ব যুগেই এ বাণিজ্যিক পথে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে।

কারণ আমরা জানি- ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে আরববাসী শুধু বর্বর, কলহপ্রিয় ও রক্তপিপাসু জাতিই ছিল না; বরং তাদের মধ্যে যারা ছিল অভিজাত ও বিত্তশালী, তারা জীবিকার্জনের জন্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করতো।

মরুময় দেশে জীবন ধারণের জন্যে খাদ্য এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাদেরকে আবহমান কাল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হতো। যে বণিক দল হযরত ইউসূফ আ.-কে ক‚প থেকে উদ্ধার করে মিশরের জনৈক অভিজাত রাজকর্মচারীর কাছে বিক্রয় করে, তারা ছিল আরববাসী। অতএব আরববাসীদের ব্যবসায় পেশা ছিল অত্যন্ত প্রাচীন এবং বিস্তৃত ছিল দেশ-দেশান্তর পর্যন্ত।

আরাকানের চন্দ্র-সূর্য বংশের প্রথম রাজা মহৎ ইঙ্গ চন্দ্র (৭৮৮-৮১০ খ্রি.) ৭৮৮ খিস্টাব্দে বৈশালীতে রাজধানী স্থাপন করে শাসনকার্য পরিচালনা শুরু করেন। তার উদারনীতির কারণে মুসলমানরা ইসলাম প্রচারের ব্যাপক সুযোগ পায় এবং সেই সূত্রেই আরব মুসলিম বণিকগণ রুহমি বন্দরসহ আরাকানের নৌবন্দরসমূহে ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক ও ইসলাম প্রচার মিশন পরিচালনা করতে থাকে।

Related image

রামব্রি দ্বীপ

এ রাজার শাসনামলেই কয়েকটি আরব মুসলিম বাণিজ্যবহর রামব্রি দ্বীপের পাশে বিধ্বস্ত হলে জাহাজের আরবীয় অরোহীরা তীরে এসে ভিড়লে পর রাজা তাদের উন্নততর আচরণে সন্তষ্ট হয়ে আরাকানে বসতি স্থাপন করার অনুমতি দেন। আরবীয় মুসলমানগণ স্থানীয় রমণীদের বিয়ে করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। (তাওয়ারীখে ইসলাম : বার্মা ওয়া আরাকান : ২৪)

রোহিঙ্গারা আরাকানের অন্যতম আদিবাসী

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যে আরাকানের (বর্তমান রাখাইন প্রদেশ) অন্যতম আদিবাসী, সে ব্যাপারে ইতিহাস সাক্ষী। ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুসারে হাজার বছর ধরে আরাকানে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে। (দি রোহিঙ্গা : অ্যা শর্ট অ্যাকাউন্ট অব দেয়ার হিস্টরি অ্যান্ড কালচার (আরাকান হিস্টরিক্যাল সোসাইটি জুন ২০০০), পৃ. ১১৮-১১৯)।

ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিল্টনের মতে- ‘আরাকানে দীর্ঘকাল ধরে মুসলিমরা বসবাস করে আসছে এবং তারা নিজেদের রোহিঙ্গা বা আরাকানের আদিবাসী বলে মনে করে’। (বার্মিজ এম্পায়ার, প্রথম সংস্করণ, ১৭৯৯)।

মুসলমানরা প্রথম আরাকান গিয়েছিল খ্রিষ্টীয় অস্টম শতকে। যে কারণে সৈয়দ জুবায়ের আহমেদ লিখেছেন-

The history of Rohingya community in Burma goes back to 8th century as they claim to be original settlers of Rakhine (Arakan) province the country while tracing their ancestry to Arab traders. (Syed Zubair Ahmad, Rohingya Muslims: A brief history of centuries-long persecution, http://twocircles.net/2012 jul 29)

এই আরবরাই রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষ কিনা সে বিষয়ে কে. এম মহিউদ্দীন দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি লিখেছেন-

pinions vary as to the ethnic origin of the Rohingyas. An assumption goes that they are the progeny of persons migrating from the Chittagong region and marrying Arakanese women. (বাংলাপিডিয়া : লিংক http://www.banglapedia.org/HT/R_0217.HTM)

‘রোহিঙ্গা’ শব্দটির উৎপত্তি সর্ম্পকে এন. এম. হাবিব উল্লাহ লিখেছেন- ‘জনশ্রুতি আছে- আরবীয় মুসলমানেরা ভাসতে ভাসতে কুলে ভিড়লে পর ‘রহম’ ‘রহম’ ধ্বনি দিয়ে স্থানীয় (আরাকানি) জনগণের সাহায্য কামনা করতে থাকে। বলা বাহুল্য- ‘রহম’ একটি আরবি শব্দ- যার অর্থ দয়া করা। কিন্তু (আরাকানি) জনগণ মনে করে এরা রহম জাতীয় লোক। রহম শব্দই বিকৃত হয়ে রোয়াং হয়েছে বলে রোহিঙ্গারা মনে করে থাকেন।’ (রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস (চট্টগ্রাম: বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লি. ১৯৯৫ খ্রি.), পৃষ্ঠা ১৭)

বঙ্গোপসাগরের উপক‚লের দ্বীপসমূহে মুসলমানেরা আলাদা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলো বলে অনেক গবেষকদের ধারণা। অনুমান করা হয়- এই রাজ্যের শাসকের উপাধি ছিল ‘সুরতান’। ৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানের চন্দ্রবংশীয় রাজা ষোলচন্দ্র সুলতান অভিযানে বের হন। চন্দ্রবংশীয় রাজবংশের ঐতিহাসিক উপাখ্যান ‘রাদজাতুয়ে’-এর বর্ণনা মতে- রাজা ষোলচন্দ্র ‘সুরতান’ অধিকার করে সেখানে একটি বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করেন এবং বিজয়স্তম্ভের গায় লিখে দেন- ‘চেত্তাগৌং’।

যার অর্থ যুদ্ধ করা সমীচীন নয়। পরবর্তীতে চেত্তাগৌং শব্দটি বিকৃত হয়ে চট্টগ্রাম হয়েছে বলে ঐতিহাসিকদের ধারণা। সে যাই হোক- বঙ্গোপসাগরের উপক‚লের দ্বীপসমূহে মুসলমানদের যে প্রতিপত্তি ছিল সেটি বুঝা যায়।
এ বিষয়ে মোটাদাগে একটি ধারণা দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ।

তিনি তাঁর বইয়ে লিখেন- “মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে একচক্ষুনীতি অবলম্বন করে নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করলেও মূলত রোহিঙ্গারাই আরাকানের প্রথম বসতি স্থাপনকারী আরব মুসলমান। অর্থাৎ অষ্টম শতাব্দীতে আরাকানে চন্দ্রবংশীয় রাজা মহৎ-ইঙ্গ-চন্দ্রের রাজত্বকালে (৭৮৮-৮১০ খ্রি.) কয়েকটি আরব মুসলিম বাণিজ্য বহর রামব্রি দ্বীপের পার্শ্বে বিধ্বস্ত হলে জাহাজের আরোহীরা রহম (দয়া) রহম বলে চিৎকার করে। এ সময় স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে আরাকানের রাজার কাছে নিয়ে যায়।

আরাকানরাজ তাদের বুদ্ধিমত্তা ও উন্নত আচরণে মুগ্ধ হয়ে আরাকানে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনের অনুমতি দান করেন। আরবি ভাষায় অনভিজ্ঞ স্থানীয় লোকজন তাদেরকে ‘রহম’ গোত্রের লোক মনে করে ‘রহম’ বলে ডাকতো। ক্রমশ শব্দটি বিকৃত হয়ে রহম>রোঁয়াই>রোয়াই> রোয়াইঙ্গা বা রোহিঙ্গা নামে খ্যাত হয়। (আরাকানের মুসলমানদের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ১৫৫-১৫৭)

কেউ কেউ মনে করেন, রোহিঙ্গারা আফগানিস্তানের অন্তর্গত ‘ঘোর’ প্রদেশের রোহা জেলার অধিবাসীদের বংশধর। মূলত তারা তুর্কী কিংবা আফগানী। কেননা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খল্জীসহ বাংলার মুসলমান বিজেতা ও শাসকগণ ইসলাম প্রচার ও প্রসারের নিমিত্তে আফগানিস্তানের রোহার অঞ্চলের কিছু ব্যক্তিকে আরাকানে প্রেরণ করেছিলেন।

উক্ত রোহার অঞ্চলের মুসলমানরা আরাকানের নামকরণ করেছিলেন রোহাং। এ রোহা ও রোহাং শব্দ থেকেই রোহিঙ্গা নামকরণ হয়েছে বলে তারা মনে করেন। তারা আরও উল্লেখ করেন যে, আরাকান ও চট্টগ্রামে প্রচলিত আঞ্চলিক ভাষায় সাধু ভাষার শ,ষ,স, মৌখিক উচ্চারণে ‘হ’ উচ্চারণ শোনা যায় এবং ‘হ’ কে শ, ষ, স, উচ্চারণ করে থাকে। এ পদ্ধতিতে হয়তো রোহাং>রোসাঙ্গ হয়েছে। রোহার অঞ্চলের মুসলমানরা যেহেতু নিজেদের রোহাইন বলে পরিচয় দেয় সেহেতু আরাকানে এ রোহাইন শব্দ থেকেই রোহিঙ্গা হয়েছে বলে তারা মনে করেন।

ষোলো শতক থেকে পর্তুগিজরা বাংলায় বাণিজ্য করার অজুহাতে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। বাংলায় খুব বেশী সুবিধা করতে না পেরে সপ্তদশ শতকে আরাকানকে তাদের কেন্দ্রস্থল হিসেবে মনে করে। আরাকানীরাও নৌবিদ্যা শিক্ষার প্রয়োজনে পর্তুগিজদেরকে ঠাঁই দেয়।

পর্তুগিজদের সংস্পর্শে ক্রমশ তারা নৌবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে আরাকানী রাজার মৌন সম্মতিতে আরাকানী স্বার্থান্বেষী কিছু ব্যক্তি পর্তুগিজদের সাথে আঁতাত করে দক্ষিণ ও পূর্ব বাংলার নদী এবং সমুদ্রোপক‚লবর্তী অঞ্চলে দস্যুবৃত্তি ও মানুষ অপহরণের ব্যবসা শুরু করে। তারা প্রতি বছর জল পথে এ সব অঞ্চলে ডাকাতি করতে আসতো এবং মুসলিম, হিন্দু, নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র যাকেই পেতো বন্দী করে নিয়ে যেতো।

তারা স্বীয় কাক্সিক্ষত স্থানে পৌঁছার জন্য নৌকা ব্যবহার করতো। বন্দীরা যাতে বিদ্রোহ করতে না পারে কিংবা পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য তারা বন্দীদের হাতের তালু ছিদ্র করে তার মধ্যে পাতলা বেত চালিয়ে তাদেরকে নৌকার ডেকের নীচে বেঁধে রাখতো। এতে অনেকেই মৃত্যু বরণ করতো।

তদুপরি যারা বেঁচে থাকতো সে সব শক্তপ্রাণ মানুষকে কৃষি কাজসহ অন্যান্য কঠিন কাজ করার জন্য প্রেরণ করা হতো আর কাউকে ইংরেজ, ফরাসি ও ওলন্দাজ বণিকদের নিকট দাক্ষিণাত্যের বন্দরসমূহে দাস হিসেবে বিক্রি করতো। এমন কোনো অপকর্ম ছিল না যা মগ-পর্তুগিজ জলদস্যুরা করতে পারতো না। পর্তুগিজরা ও মগরা নামেই শুধু খৃস্টান এবং বৌদ্ধ ছিল।

খুন, জখম, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অপহরণ প্রভৃতি পৈশাচিক ও জঘন্য কর্মকান্ডের ব্যাপারে তাদের কেউ সমকক্ষ ছিল না। তারা হাট-বাজারের দিন কিংবা ধর্মীয় ও অন্যান্য উৎসব-অনুষ্ঠানের দিনসহ যে কোনো দিন তারা গ্রামে হানা দিয়ে ইচ্ছেমত লুণ্ঠন, খুন, ধর্ষণ কিংবা অপহরণ কর্মকান্ড পরিচালিত করতো। অনেক সময় তারা গ্রামের পর গ্রাম আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতো।

উল্লেখ্য- প্রত্যক্ষদর্শী বাংলার সুবেদার ও ঐতিহাসিক মীর্জা নাথান এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন- শ্রীপুর অঞ্চলে রাজকীয় শক্তির দূর্বলতার সুযোগে মগেরা শত শত নৌকা নিয়ে ঘুরে অসংখ্য গ্রাম লুণ্ঠন করে এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে গ্রামবাসীকে বন্দী করে নিয়ে যায়। মগ-ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের অত্যাচারে বাংলার অনেক অঞ্চল জনশূন্য হয়ে পড়েছিলো। মূলত পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার হাজার হাজার নারী-পুরুষকে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুরা অপহরণ করে নিয়ে আরাকানে দাস হিসেবে বিক্রি করেছে।

এমনকি ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে আরাকান রাজা থিরি থু ধম্মা ও তৎপুত্র মিনসানিকে বিধবা রানী নাৎসিনমের প্রণয়ী নরপদিগ্যী আরাকানের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলে নিহত আরাকান রাজের পিতৃব্য ও চট্টগ্রামের আরাকানী শাসনকর্তা মঙ্গতরি নিজেকে স্বাধীন শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন।

কিন্তু অবশেষে ক্ষমতার জবরদখলকারী নরপদিগ্যীর কাছে তিনি পরাজিত হয়ে মোগলদের সাহায্য নিয়ে ঢাকায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। আরাকানের এই গৃহযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে বাংলার প্রায় দশ সহস্রাধিক লোক মগ-পর্তুগিজদের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে তাদের জন্মস্থানে ফিরে আসে। (চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা : ১৫৫)।

সুতরাং এ ধরনের বিশাল অংকের দাসদের বিষয় অনুমান করে কোনো কোনো গবেষক মনে করেন যে, বাংলা থেকে অপহৃত দাসগণ স্থানীয় মগ রমনী বিয়ে করে আরাকানে বসবাস করে এবং তাদের ঔরসে ও মগ মহিলাদের গর্ভজাত বর্ণসংকর জনগোষ্ঠীও রোহিঙ্গা।

স্থানীয় ইতিহাস বিশারদ আবদুল হক চৌধুরী মনে করেন যে, প্রধানত আরাকানে বসতি স্থাপনকারী চট্টগ্রামী পিতার ঔরসে ও আরাকানী মগ মাতার গর্ভে জন্মগ্রহণকারী আরাকানী ও চট্টগ্রামী উপভাষী মুসলমান বর্ণসংকর জনগোষ্ঠীই হল আরাকানের রোহিঙ্গা গোত্র। কালক্রমে আরাকানের রোহিঙ্গা গোত্রের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ও পরবর্তীতে নতুন নতুন চট্টগ্রামী বসতি স্থাপনকারীদের আগমনের ফলে তাদের সংখ্যা অধিক হয়। তখন নিজেদের গোত্রের মধ্যে মুখ্যত বিয়ে-শাদী সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে তারা চট্টগ্রামী উপ-ভাষাকে আরাকানের রোহিঙ্গা গোত্রের পারিবারিক ভাষা হিসেবে চালু রাখতে সক্ষম হয়। আরাকানে রোহিঙ্গাদের উদ্ভব সম্পর্কে তিনি তিনটি পর্বের উল্লেখ করেন।

প্রথমত- আরাকানের রাজা নরমিখলা দীর্ঘ ২৪ বছর (১৪০৬-১৪৩০ খ্রি.) বাংলার সুলতানদের আশ্রয়ে গৌড়ে অবস্থান করেন। এ বিষয়ে পরবর্তীতে আমরা বিশদ আলোচনা করবো। তার সময়ে আসতো মুসলিম সৈনিকদের পাশাপাশি পরবর্তীতে তাদের আত্মীয় স্বজন এবং বিভিন্ন পেশার শ্রমিকগণ আরাকানে বসতি স্থাপন করেন। এ শ্রমিক শ্রেণির বেশীরভাগ লোকই ছিল চট্টগ্রামের অধিবাসী। সুতরাং তাদের বংশধরগণই রোহিঙ্গা নামে খ্যাত হয়।

দ্বিতীয়ত- ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় পঁচাশি বছরব্যাপী চট্টগ্রাম একাধিকক্রমে আরাকানের শাসনাধীনে ছিল। এ সময়টা ছিল পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার পর্তুগিজ ও আরাকানী মগ জলদস্যুদের দাস ব্যবসার কালো যুগ। তখন চট্টগ্রাম ছিল আরাকানীদের শাসনাধীন এবং আরাকান রাজসভায় বড় ঠাকুর, মাগন ঠাকুর, আশরাফ খান, সোলায়মান, নবরাজ মজলিশ, সৈয়দ মুহাম্মদ প্রমুখ বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। আরাকানের বিচারকের আসনেও অধিষ্ঠিত ছিল মুসলমান কাজী।

এমনকি সেনা বিভাগেও ছিল মুসলমান সৈনিক। আরাকান রাজসভায় দায়িত্ব পালনকারী এ সকল মুসলমানগণের অধিকাংশই ছিলেন চট্টগ্রামী। সুতরাং এ সময়ে চট্টগ্রাম থেকে মানুষ চুরি করার চেয়ে তারা বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে অপহরণকার্য বেশি চালিয়েছে। পক্ষান্তরে চট্টগ্রাম-আরাকানে চাকরি ও ব্যবসার উদ্দেশ্যে আরাকান যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। আরাকানে অবস্থানরত গৌড়ীয় দাসগণও এদের সাথে যুক্ত হতে পারে। সুতরাং এ পর্বেও রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

তৃতীয়ত- ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধে আরাকান ইংরেজদের অধিভুক্ত হয়। তখন বাংলা-চট্টগ্রাম ও আরাকান একই শাসনভুক্ত হবার কারণে বাংলার অনেক জনগণ অস্থায়ী ও স্থায়ী ভিত্তিতে জীবিকার অন্বেষণে চট্টগ্রামে যায়।

এভাবে অনেক কৃষক-শ্রমিক আরাকানে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে। রাজা নরমিখলার মৃত্যুর পর ১৪৩৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা মিনখেরী ওরফে আলী শাহ আরাকানের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলে আরাকান গৌড়ের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়। ফলে তখন গৌড়ের কিছু সৈনিক ফিরে এলেও অধিকাংশ সৈনিক, ব্যবসায়ী, শ্রমিক আরাকানেই স্থায়ী আবাসন গড়ে তোলে।

Image result for arakan

আরাকানের একটি গ্রামের মক্তব

রাখাইং শব্দ থেকে রোহিঙ্গা নামের উৎপত্তি হয়েছে বলেও মন্তব্য পাওয়া যায়। তারা মনে করেন রাখাইং শব্দ থেকে রোয়াং হয়েছে এবং এ রোয়াং শব্দটি বিকৃত হয়ে রোয়াইঙ্গা শব্দের গঠন হয়েছে। তাদের মতে রোয়াং তিব্বতী বর্মী শব্দ যার অর্থ বুঝায় আরাকান। এ জন্য অদ্যাবধি চট্টগ্রাম জেলায় রোয়াং বলতে আরাকান এবং রোহিঙ্গা বলতে আরাকানের অধিবাসীকে বুঝায়। যদি এ মতকে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয় তবে রোঁয়াই-চাটি শব্দদ্বয়ের যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায়।

অর্থাৎ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দারা নিজেদের চাটি এবং আরাকান থেকে আসতো ও অত্র অঞ্চলে বসতি স্থাপনকারীদেরকে রোঁয়াই বলে সম্বোধন করে থাকেন। তবে রোহিঙ্গা শব্দটি রাখাইন শব্দ থেকে উৎপত্তি ধরা না হলেও রোঁয়াই বলতে আরাকান অঞ্চল বুঝায় এতে কোনো সন্দেহ নেই।

রোহিঙ্গা নামের উৎপত্তি ম্রোহং শব্দ থেকে হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আরাকানের বিতাড়িত রাজা নরমিখলা ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহের প্রত্যক্ষ সহায়তায় হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করে মুহাম্মদ সোলায়মান শাহ নাম নিয়ে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি রাজধানী লংগিয়েতের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দে রামু বা টেকনাফ থেকে শত মাইলের মধ্যে লেম্ব্রু নদীর তীরে ম্রোহং নামক স্থানে রাজধানী স্থানান্তর করেন।

এটাই ছিল আরাকানের শেষ অবধি (১৭৮৫ খ্রি. পর্যন্ত) রাজধানী। এ ম্রোহং শব্দটি মুসলমানদের মুখে এবং লেখায় রোহাং উচ্চারিত হয়। এভাবে রোয়াং> রোহাং> রোহিঙ্গা নামকরণ হয়েছে। (আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ সংকলিত ও আহমদ শরীফ সম্পাদিত পুঁথি পরিচিতি, (ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৮), পৃষ্ঠা ৩১৬)

উল্লেখ্য, সত্যেন্দ্রনাথ ঘোষাল এবং আহমদ শরীফ প্রমুখ মনে করেন যে, রাজধানীকে কেন্দ্র করে লেখকগণ রাজ্যের নাম লিখেছেন। যেমন রোমান সাম্রাজ্য, দিল্লি সাম্রাজ্য প্রভৃতির মতো রাজধানী ম্রোহংয়ের নামেই আরাকানকে চিহ্নিত করা হতো। তবে ম্রোহং শব্দটি সাধারণ উচ্চারণে রোহাং হয়েছে, আবার পূর্ব বাংলার কথ্য ভাষায় ‘স’ ‘হ’ উচ্চারণের রূপান্তরের কারণে রোহাং শব্দটিও রোসাঙ্গ হয়েছে।

যেমন ম্রোহং>রোয়াং>রোহাং>রোসাঙ্গ ইত্যাদি। এ কারণেই রোহাঙ্গ রাজ্যকে রোসাঙ্গ রাজ্য বলে লেখকরা অভিহিত করে থাকেন।

এক কথায় বলা যায়, আরাকানের শেষ রাজধানী ম্রোহং; এর সাধারণ উচ্চারণ রোহাং। এ রোহাং এর মুসলিম অধিবাসীদেরকে রোহিঙ্গা বলা হয়।

উপরোদ্ধৃত বিবরণে এ বিষয়টি গ্রহণযোগ্য হিসেবে উপস্থাপিত হয় যে, প্রথমত- রোহিঙ্গারা আরাকানের মূল ধারার সুন্নি মুসলমান। যদি রহম থেকে রোহিঙ্গা শব্দের উৎপত্তি ধরা হয়, তবে বলা যায় রোহিঙ্গারাই আরাকানে বসতি স্থাপনকারী প্রথম পর্যায়ের আরব মুসলিম নাবিক ও বনিক স¤প্রদায়। আরব বণিক হিসেবে এলেও তাদের বসতি নির্মাণ হয়েছে আজ থেকে প্রায় ১৩শত বছর পূর্বে।

দ্বিতীয়ত- মুসলমানগণ প্রচারধর্মী (মিশনারি) জাতি হিসেবে ইসলাম প্রচারের জন্য অনেক দূর-দূরান্ত ও শত্রুবেষ্টিত পথও অতিক্রম করতে পারে। এদিক বিবেচনায় বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বাংলা বিজয়ের পরে গৌড় থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য আরাকানের দাওয়াতি মিশন নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে।

এ রকম বিচ্ছিন্নভাবে কিছু তৌহিদবাদী মুসলিম দীন প্রচারে আরাকানে গেলে তারা আরাকানী মুসলমানদের পূর্ব পুরুষ কিংবা সহযাত্রী হবে। কিন্তু সুদূর আফগানিস্তানের রোহার অঞ্চল থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আরাকানে এবং এ রোহার থেকে রোহিঙ্গা নামকরণ হওয়া বিষয়টি সমর্থন যোগ্য নয়।

তৃতীয়ত- রোহিঙ্গারা বাংলা থেকে অপহৃত ও আরাকানে দাসরূপে ব্যবহৃত জনগোষ্ঠীর অধস্তন পুরুষ বিষয়টির সাথেও একমত হওয়া যায় না। যদি এরাই রোহিঙ্গা হয় তবে নরমিখলা কর্তৃক আরাকান রাজ্য পুনরুদ্ধার করার সময় বাংলা থেকে প্রেরিত ত্রিশ হাজারের অধিক মুসলিম সৈন্য এবং সমসাময়িককালে আসা ব্যবসায়ীগণ কোথায় গেলো? অথচ আরাকানের সমগ্র জনগোষ্ঠীর ৯০% রোহিঙ্গা।

সুতরাং সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ম্রোহংয়ের অধিবাসী হবার কারণে আরাকানের মুসলমানগণকে রোহিঙ্গা বলা হয়ে থাকে। অতএব আরব বণিক, নাবিক, ইসলাম প্রচারক, রোহার থেকে আসা ইসলাম প্রচারক, গৌড়ীয় মুসলিম সৈন্য, বাংলায় অপহৃত দাসগণসহ অধিকাংশ মুসলমানই রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তাহলে সমসাময়িক লেখকদের লেখায় রোহিঙ্গা শব্দটি পাওয়া যায় না কেনো?

উত্তরে বলা যেতে পারে- বাংলার অধিবাসী হবার কারণে যেমন বাঙ্গালি বলা হয় অথচ বাঙালির হাজার হাজার বছর পূর্বের ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে ধরা হলেও বাঙালি শব্দের প্রয়োগ সমসাময়িক লেখকদের লেখায় পাওয়া যায় না। বলা চলে বাঙালি কথাটিও আধুনিককালের প্রয়োগ।

অথচ আধুনিককালের প্রয়োগ হলেও যেমন বাঙালির ইতিহাস হাজার বছরের তেমনি রোহিঙ্গা শব্দটি আধুনিক কালের হলেও রোহিঙ্গাদের ইতিহাসও হাজার বছরের চেয়েও পুরনো। এরা পরিচয়হীনভাবে বেড়ে ওঠা কোনো জনগোষ্ঠী নয়। মূলত রোহিঙ্গারাই আরাকানের স্থায়ী ও আদি মুসলমান।”

পরবর্তী পর্বে আমরা ইতিহাসের পরম্পরায় আরাকানের মুসলমানদের বিষয়টিকে সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরবো, ইনশাআল্লাহ।

প্রথম পর্ব : আরাকান: পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্যি

আগামী পর্বে পড়বেন

আরাকানের মুসলমান : শিল্পকলা ও সংস্কৃতি
বাংলা সাহিত্যে আরাকান
রোহিঙ্গা মুসলিম : নিপীড়ন ও বঞ্চনার সাতকাহন
রোহিঙ্গা শরণার্থী ও বাংলাদেশ
মিয়ানমারের মুসলমানদের আন্দোলন ও সাংগঠনিক কর্মকান্ড
উম্মাহ ও বিশ্ব : ভূমিকা ও দায়


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ