শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
কাল যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইজতেমা শেখ হাসিনা ভারতে বসে দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন: মজলিস মহাসচিব ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহে ৩১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৬২৩০ মসজিদে নববীর আদলে হবে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ: ধর্ম উপদেষ্টা খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিগত কমিশন থেকে শিক্ষা নিতে হবে: মুফতী ফয়জুল করীম লালপুরে যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে জমি দখল ও বাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ জনতার চেয়ারম্যান সৈয়দ তালহাকে সুনামগঞ্জ ৩ আসনে জমিয়তের প্রার্থী ঘোষণা কুরআন-হাদিসের ভিত্তিতেই হতে হবে সংস্কার: বায়তুল মোকাররমের খতিব ইসলামী সঙ্গীত সম্রাট আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ.-এর বাবার ইন্তেকাল

বেফাককে ঢেলে সাজানো হচ্ছে; ময়মনসিংহে বেফাকের নেতৃবৃন্দ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সাজ্জাদ শরিফ: আপনি বাসট্যান্ডে নেমেই যখন দেখবেন, একজন বিনয়ী স্বরে সালাম দিয়ে বলছে, ‘আপনি কি বেফাকের প্রোগ্রামে এসেছেন? আমাদের অটো কিংবা সিএনজি প্রস্তুত রয়েছে আপনাকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।’

স্বাভাবিকভাবেই একটু অবাক হবেন। গতকাল এমনই দৃশ্য দেখা গেছে ময়মনসিংহের মাসকান্দা, টেকনিক্যাল মোড় ও বাইপাস মোড়সহ জেলা সদরের প্রবেশপথের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে। আগত মেহমানরা এমন আয়োজন দেখে যতোটুকু বিস্মিত হয়েছেন তার চেয়ে বেশি আনন্দিত হয়েছেন আয়োজকদের বিশেষ এই ব্যবস্থাপনায়।

হ্যাঁ, ময়মনসিংহের আলোচিত দীনি প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম নিযামিয়া মোমেনশাহী গতকাল আগত মেহমানদের স্বাগত জানানোর জন্য এমনই আয়োজন করেছিলো।

গতকাল বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে ময়মনসিংহ জেলা শাখা কর্তৃক আয়োজিত ‘তালিম-তরবিয়তের মানোন্নয়ন’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় দারুল উলূম নিযামিয়ায়। উক্ত অনুষ্ঠানে ময়মনসিংহ জেলার বেফাক্তভুক্ত মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও শিক্ষাসচিবদের আমন্ত্রণ জানানো হয়।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই কুরআনের সুরে মুর্ছনায় সবাইকে মোহিত করেন নন্দিত ক্বারী আবু সালেহ মুহাম্মদ মুসা।

এরপর স্বাগত বক্তব্য দেন বেফাকের ময়মনসিংহ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মুফতি আহমদ আলী।

স্বাগত বক্তব্যের শুরুতে তিনি প্রতিবেশী দেশে নীপিড়ীত রোহিঙ্গা মুসলিম ভাইদের কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন। তাদের সহযোগিতার জন্য সবাইকে আহবান জানান। তিনি বর্তমান উম্মাহর ক্রান্তিলগ্নে উলামায়ে কেরামের করণীয় সম্পর্কেও সারগর্ভ আলোচনা করেন।

একইসঙ্গে বর্তমান মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় সমস্যা, সংকট ও সমাধান নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন। সকাল দশটা থেকে শুরু হয় এবং আসরের নামাযের সময় শেষ হয়।

প্রথম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ময়মনসিংহের নন্দিত ইসলামি বিদ্যাপীঠ জামিয়া আরাবিয়া আশরাফুল উলুম বালিয়া মাদরাসার স্বনামধন্য প্রিন্সিপাল হযরত মাওলানা আইনুদ্দীন। আলোচনা সভায় বক্তারা মাদরাসা শিক্ষাকে আরো বেগবান ও যুগোপযুগী করে তোলার ব্যাপারে সবার সহযোগিতা কামনা করেন।

স্বাগত বক্তব্যের পর লিখিত বক্তব্য পেশ করেন বেফাকের তালীম-তরবিয়ত বিষয়ক সম্পাদক মাওলানা মুফতি এনামুল হক।

তিনি বলেন, অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা গেছে যে, মাদরাসার মধ্যে দুইটি বস্তু সঠিকভাবে বিদ্যমান সেখানে আল্লাহর বরকত ও উন্নতি থাকে এর মধ্যে ১. মুসলমানদের দেয়া টাকা-পয়সার আমানত ২. মুসলমানদের সন্তানের আমানত এ দুটি আমানতের রক্ষা হলে অবশ্যই প্রতিষ্ঠানে বরকত হয়। অভাব দেখা দেয় না। উন্নতি কিভাবে হয় বলা যায় না, ছাত্র কিভাবে আসে চিন্তা করে পাওয়া যায় না।

বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ গঠনের মূল লক্ষ্যই হলো, দেশের মাদরাসা সমূহের তালীম ও তারবিয়াতের মানোন্নয়ন। একইসঙ্গে মাদরাসাসমূহের সমস্যাবলি দূরীকরণে মনোযোগী হয়ে একদল দক্ষ এবং দেশ-জাতির কল্যাণে নিবেদিত যুগ সচেতন নাগরিক গড়ে তোলা। সে লক্ষ্যেই আমাদের আজকের এই আয়োজন।

আপনারা সবাই এ ডাক দেয়াকে অন্তরের অন্তঃস্তল থেকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং স্বতঃস্ফুর্থভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে আমাদের বাধিত করেছেন।

এরপর বেফাকের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস তার বক্তব্যে বলেন, আমরা বেফাকের নতুন  দায়িত্ব পেয়েছি। নতুন করে পথযাত্রা শুরু করেছে বেফাক। আমাদের শুরু পর্যায়ের কারণে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। যা মাদরাসাগুলোর পরীক্ষা ও অন্যান্য শিক্ষা কার্যক্রমে প্রভাব পড়ছে। এক্ষেত্রেও আমরা আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করছি।

তিনি আরো বলেন, একটা বিষয় আপনাদের স্পষ্ট করে দেই, আমরা সরকারে কাছ থেকে স্বীকৃতি নেইনি। বরং দাওরা হাদিসের মানকে মাস্টার্সের সমমানের দাবি করেছি। যা সরকার প্রধান ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন। স্বীকৃতি নিলে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিতে হয়। যা আমরা কখনোই চাই না।

আমরা চাইনা, স্বীকৃতির দেয়ার দোহাই দিয়ে মাদরাসার স্বকীয়তার ওপর সরকার হস্তক্ষেপ করুক। যা হোক, আমরা নতুন করে বেফাককে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছি। আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করি।

এছাড়াও থানা প্রতিনিধি বিশিষ্ট আলেমগণ আলোচনা করেন প্রথম অধিবেশনে। থানা প্রতিনিধি হিসেবে আলোচনা পেশ করেন হযরত মাওলানা দিলাওয়ার হোসাইন সাহেব, মুহতামিম, জামিয়া আরাবিয়া মিফতাহুল উলূম, মাসকান্দা। মাওলানা মুহাম্মদ, নায়েবে মুহতামিম জামিয়া আরাবিয়া মাখযানুল উলূম, তালতলা। মাওলানা আজিজুল হক; মুহাদ্দিস, জামিয়া ফয়জুর রহমান রহ। মাওলানা শওকত আলী; মুহতামিম, জামিয়া ইসলামিয়া, সেহড়া, ময়মনসিংহ।মাওলানা আবুল কালাম; মুহতামিম, রাহাতুল জান্নাত মহিলা মাদরাসা, মাওলানা আবু হানিফা; মুহতামিম, ভালুকজান মাদরাসা, ফুলবাড়িয়া; মাওলানা সাইফুল ইসলাম, মুহতামিম, ফাতিমাতুয যাহরা, ত্রিশাল; হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান সালমানী, মুহতামিম, দুগাছিয়া মাদরাসা, গফরগাঁও; মাওলানা ইবরাহীম সাহেব মুহতামিম, জামিয়া আরাবিয়া আহাদিয়া বারইগ্রাম, নান্দাইল; মাওলানা নূরুল আলম, মুহতামিম, জামিয়া গাফুরিয়া, ঈশ্বরগঞ্জ।

প্রথম অধিবেশন শেষে বালিয়া মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা আইনুদ্দীন মোনাজাত করেন।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয় বিকাল ৩টা থেকে। দ্বিতীয় অধিবেশনে ময়মনসিংহ জেলার দায়িত্বশীলগণ এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যগণ আলোচনা করেন।

বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা আনোয়ার শাহ বেফাককে নতুন করে ঢেলে সাজানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।

তিনি বলেন, এতোদিন বেফাক যেভাবে পরিচালিতি হয়েছে, তাতে মাদরাসা ও মাদরাসা শিক্ষার অনেক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে বলে মনে করি। এখন আর সেই সুযোগ নেই। এখন আমরা চাই বেফাক আরো গতিশীল হয়ে মাদরাসাসূহের হাল ধরবে। পতন্মোখ মাদরাসাগুলোর লেখাপড়ার মানোন্নয়নে মনোযোগী হবে। যেসব জায়গায় ত্রুটি রয়েছে সেগুলো দূর করার জন্য প্রচেষ্টা চালাবে।

বেফাকের সহ-সভাপতি মাওলানা মুসলেহ উদ্দীন রাজু পড়াশোনার মানোন্নয়নে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার জোর তাগিদ দিয়ে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আলোচনা করেন। শুরুতে তিনি ময়মনসিংহের মাাটি ও মানুষের সাথে তার আত্মিক সম্পর্কের কথা আবেগঘন ভাষায় তুলে ধরেন।

এরপর বলেন, একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আমি আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি। আপনারা জানেন, বেফাক আমাদের আকবিরদের রেখে যাওয়া আমানত। এর আগে অনেকবার বেফাককে কলুষিত করার জন্য একদল কুচক্রী মহল বার বার তাদের বিষাক্ত থাবা বসিয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এবারও একটি গ্রুপ আবারো চেষ্টা করেছে। আমাদের কাছে সংবাদ আছে, আপনাদের এই ময়মনসিংহে বসেই অনেকেই প্লাস-মাইনাসের খেলায় মেতে উঠেছে। অনেক মাদরাসার দায়িত্বশীলদের ‘নতুন কিছু করার’ প্রলোভন দেখিয়ে দিকভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারা তা পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না।

আমরা আশা করব, আপনারা বরাবর আমাদের সাথে ছিলেন এবং আগামীতেও থাকবেন। আমরা আপনাদেরকে সাথে নিয়েই ওইসব কুচক্রী মহলকে প্রতিহত করবো ইনশাআল্লাহ।

দারুল উলূম নিযামিয়া মোমেনশাহী’র মুহতামিম মাওলানা আমিনুল হক বলেন, আজ অত্যন্ত ব্যথিত হৃদয়ে বলতে হয়, আমরা আকাবিরে উম্মাহর দেখানো পথ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছি। এজন্যই আমাদের এত করুণ অবস্থা। আমি ধরে নিলাম, বেফাক একটি অযোগ্য প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সেটাও তো হয়েছে আমাদের দায়িত্ব অবহেলার কারণে। অসেচতনা-অমনোযোগিতার কারণে।

তিনি বরেন, আজ আমরা ভুলে গেছি, মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, ভুলে গেছি মাদরাসায় পড়া ও পড়ানোর লক্ষ্য। আজ আমাদের ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে বন্ধন হচ্ছে নিয়ম সর্বস্ব সম্পর্ক, শুধুই পড়া ও পড়ানোর সম্পর্ক। আমাদের মাঝে আত্মিক সেই সম্পর্ক আর নেই। আমাদের এই দুর্বলতাগুলো দূর করতে হবে। একইসঙ্গে আকাবিরের রেখে যাওয়া পথ অনুসরণ করে আমাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে।

উক্ত আলোচনা সভায় ময়মনসিংহ জেলা শাখার পক্ষ থেকে কতিপয় প্রস্তাবাবলি পেশ করেন জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মুফতি আহমাদ আলী।

বেফাককে রাজনৈতিক বলয়মুক্তকরণ, কাউন্সিলের সভা আহ্বান করা, ইফতা বিভাগকে বেফাকের নিয়ন্ত্রণাধীন করা, মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট গড়ে তেলা, বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ ও হিসাবের অডিট রিপোর্ট মাদরাসাগুলোতে প্রেরণ এবং বিভাগ কেন্দ্রিক বেফাকের অফিস চালুসহ বেশ কিছু দাবি তুলে ধরা হয় ওই প্রস্তাতাবলিতে।

দ্বিতীয় অধিবেশনে আরো বক্তব্য দেন বেফাকের মহাপরিচালক মাওলানা অধ্যাপক যুবায়ের আহমদ। সভাপতিত্ব ও আখেরী মুনাজাত পরিচালনা করেন পীরে কামেল মাওলানা আব্দুর রহমান হাফেজ্জী।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ