শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫ ।। ৫ বৈশাখ ১৪৩২ ।। ২০ শাওয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
মুফতি ফয়জুল করীমকে মেয়র ঘোষণার দাবি বরিশালবাসীর এবার খুলনায় ‘মার্চ ফর গাজা’ শ্রমিক মজলিসের সভাপতি আবদুল করিম, সাধারণ সম্পাদক এরশাদ ‘নষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি দিয়ে দেশ ও মানুষের কল্যাণ সম্ভব নয়’ ৫ বছর আগের এই দিনে কী হয়েছিল মাওলানা আনসারীর জানাজায়? হজযাত্রীর জন্য চালু হচ্ছে হজ ম্যানেজমেন্ট সেন্টার, থাকবে অ্যাপ কুয়েট শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিন- ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ  আইন করে ভারতে মুসলিমদের অধিকার হরণ করা যাবে না: জমিয়ত করাচি-চট্টগ্রাম রুটে নৌযান চলাচলকে স্বাগত জানিয়েছে দুই পক্ষ: পাকিস্তান ২৬ এপ্রিল জমিয়তের কাউন্সিল, প্রাধান্য পেতে পারে তরুণ নেতৃত্ব

রোহিঙ্গা শিবিরের হিরো ৩ : দেলাওয়ার হোসাইন সাকী

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর
অতিথি লেখক; আওয়ার ইসলাম

প্রশ্ন করছিলাম- ‘যেসব রোহিঙ্গা পরিবার বাংলাদেশে আসছে, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই একাধিক সন্তান রয়েছে। কারো সঙ্গে তিন বা চারজন সন্তানও রয়েছে। রোহিঙ্গাদের এই অধিক সন্তান গ্রহণের কারণ কী?’

দেলাওয়ার সাকী ভাই বিষণ্ন হেসে যে উত্তর দিলেন, সেটা শুনে আমি পুরোপুরি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।

তিনি বলেছিলেন- ‘রোহিঙ্গাদের অধিক সন্তান হওয়ার বিষয়টি প্রথমদিকে আমাকেও ভাবিয়ে তুলেছিলো। রোহিঙ্গা পরিবারে এতো শিশু কেন? বরং তাদের পরিবারে তো শিশু আরও কম হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। যেখানে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু তাদের তাড়া করে ফিরছে, যখন তখন ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে, পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে বাকিদের তাড়িয়ে দিচ্ছে; এসব কারণে তো তারা চাইবে তাদের সন্তান যেন আরও কম হয়। যেন তাদের সন্তান পৃথিবীতে এসে এমন অসভ্য বর্বরতার মুখোমুখি না হয়।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সন্তান তো তাদের অবর্ণনীয় কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তারপরও কেন তারা অধিক সন্তান গ্রহণ করছেন?

যেসব রোহিঙ্গা পরিবার বাংলাদেশে আসছে, বিশেষ করে নারীরা, সবার কোলেই একটা-দুটো শিশু এবং আমি দেখেছি, প্রত্যেকটা শিশুই দীর্ঘ পথ হেঁটে আসার কারণে অসুস্থ, নানারকম রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত। অথবা এমন অনেক প্র্যাগনেন্ট নারীও রয়েছে যারা সীমান্ত পাড়ি দিতে দিতেই সন্তান প্রসব করেছেন। কেউ এখানে এসে সন্তান প্রসব করেছেন। তাদের দুর্দশা এককথায় ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই আমার মনেও প্রশ্ন জাগে- কেন এতো সন্তান তাদের?’

আমি কোতূহলী হয়ে প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলাম- ‘এটা তো সত্যিই, এতো নিপীড়ন-নির্যাতনের মধ্যে তাদের এতো সন্তান নেয়ার কারণ কী?’

সাকী ভাই বলতে লাগলেন- ‘বিষয়টি জানার জন্য আমি বিভিন্ন রোহিঙ্গা নারীর কাছে প্রশ্ন করেছি। তারা এমনিতেই পরপুরুষের সঙ্গে কথা কম বলেন। তাছাড়া অনেকেই নানা নির্যাতন সহ্য করে এখানে এসেছেন, মানসিকভাবে তারা বিপর্যস্ত। অবশেষে আমার উপর্যুপরি জিজ্ঞাসার কারণে এক রোহিঙ্গা নারী আমাকে যে তথ্য দিলেন, তা শুনে আমি পুরোপুরি লা-জবাব হয়ে গেলাম!

ওই নারী জানালেন, বার্মিজ সরকারের নাসাকা বাহিনী যখন তখন আমাদের গ্রামগুলোতে হামলা করে। হামলা করে লুটতরাজ চালায়, যুবকদের খুন করে এবং অস্ত্রের মুখে নারীদের ধর্ষণ করে। যেসব নারীকে সামনে পায় তাদেরই ধর্ষণ করে; কিশোরী, যুবতী, বিবাহিত সবাইকে। তবে কোনো নারী ‘হামেলা’ (গর্ভবতী) থাকলে তারা তাকে ধর্ষণ করে না, তারা তাকে ছেড়ে দেয়। এ কারণে বিবাহিত রোহিঙ্গা নারীরা এক সন্তান প্রসবের পরপরই আবার গর্ভধারণ করে। নিজেদের ইজ্জত আর সতীত্ব রক্ষার জন্য এটাই তাদের একমাত্র রক্ষাকবজ। সন্তান ধারণ বা প্রসবে যতো কষ্টই হোক, কিংবা সন্তান লালন-পালনের সামর্থ্য না থাক, নিজেদের নাসাকা পশুদের হাতে ধর্ষণ হওয়া থেকে রক্ষা করতে তারা একের পর এক গর্ভধারণ করে যাচ্ছে। এটাই তাদের অধিক সন্তান জন্মদানের নেপথ্য কারণ।’

https://www.facebook.com/photo.php?fbid=1538978826147930&set=pcb.1538978889481257&type=3

‘ওহ খোদা’! সাকী ভাইয়ের কথা শুনে আমি কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলাম না। ফোনের ওপাশে সাকী ভাইও নীরব। ফোন কানে রেখেও কিছুক্ষণ দুজনই চুপচাপ বসে রইলাম।

‘সালাহউদ্দীন ভাই, এখানে যখন আসি তখন রোহিঙ্গা কোনো শিশুর দিকে তাকালেই আমার চোখের সামনে নিজের সন্তানদের মুখ ভেসে উঠতো। আমি ছোট ছোট তিনটি বাচ্চা রেখে এসেছি বাসায়। এখানকার বাচ্চাগুলোকে দেখলে আমার বাচ্চা রাহবার সাকীর কথা মনে পড়ে, ছোট্ট আফরান সাকীর কথা মনে পড়ে। আমি বুঝি সন্তানের ব্যথা কতো তীব্র...।’

দেলাওয়ার সাকী ভাই তখন গাড়িতে করে শাহপরীর দ্বীপের লেদা ক্যাম্পে যাচ্ছিলেন। সেখানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর পক্ষ থেকে একটি মেডিকেল ক্যাম্প খোলা হয়েছে, তিনি সেটা তদারক করতে যাচ্ছিলেন। একই সঙ্গে পরদিন (আজ) এই ক্যাম্পে ইসলামী আন্দোলনের আমীর মুফতী সৈয়দ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাই আসবেন বলে জানালেন।

দেলাওয়ার হোসাইন সাকী ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় সদস্য এবং টেকনাফে তাদের সংগঠনের ত্রাণ সমন্বয় কমিটির অন্যতম সদস্য।

জিজ্ঞেস করলাম তাদের ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে- ‘আপনাদের সংগঠনের কতো লোক এখানে কাজ করছে?’

তিনি জানালেন, ‘আমাদের সংগঠনের কমপক্ষে প্রায় ১০ হাজার কর্মী সার্বক্ষণিকভাবে এখানে ত্রাণ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত।’

‘এখানে আপনারা কীভাবে ত্রাণ তৎপরতা সমন্বয় করছেন?’

Image may contain: 8 people

‘আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা প্রধানত দুটো কাজ করছি। এক. যারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এপাড়ে আসছে তাদের সীমান্ত থেকে রিসিভ করা এবং তাদের হাতে টাকা, খাবার বা প্রয়োজনীয় সামগ্রী তুলে দিয়ে ক্যাম্পে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেয়া।

দুই. ক্যাম্পে যারা স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নিচ্ছে, তাদের কোনোভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেয়া। এ দুটো কাজ আমরা টপ প্রায়োরিটি দিয়ে করছি।’

‘কিন্তু আমরা যদ্দুর জানতে পারলাম, ক্যাম্পগুলোতে শরণার্থীদের জন্য স্থায়ীভাবে পানি ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে আপনারা কী উদ্যোগ নিচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ, এ ব্যাপারেও আমাদের কাজ পুরোদমে চলছে। পানির জন্য নলকূপ স্থাপন এবং স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তবে নলকূপ স্থাপনে খরচের তারতম্য রয়েছে। যেমন উখিয়া এলাকায় নলকূপ স্থাপন ২০-৩০ হাজার টাকার মধ্যেই হয়ে যায়। কিন্তু টেকনাফ এলাকায় নলকূপ স্থাপন করতে ৭০-৮০ হাজার টাকা লেগে যায়। পানির লেয়ার লেভেলের কারণে এ খরচ হচ্ছে।

তবে ক্যাম্পগুলোতেও আমরা পূর্ণোদ্যমে কাজ করে যাচ্ছি। তেরপল বিতরণ, বাঁশ সংগ্রহ এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। এরপরও আমাদের স্বেচ্ছাসেবক টিম প্রতিটা ক্যাম্পে খুঁজে খুঁজে যারা এখনও ত্রাণ পায়নি তাদের একটা স্থানে জড়ো করে তাদেরকে কার্ডের মাধ্যমে আমাদের ফ্যামিলি প্যাক বিশেষ ত্রাণ আইটেম দিয়ে দেয়া হচ্ছে।

বিশেষ করে শিশুখাদ্যের অভাব এখানে প্রকট। আমরা শিশুদের জন্য ল্যাকটোজেন ১ এবং ল্যাকটোজেন ২ দুধ সরবরাহ করছি।

আরেকটি চমৎকার দিক হলো, আমরা যেহেতু সাংগঠনিকভাবে কাজ করছি, এ কারণে আমাদের কাজগুলো খুব সুশৃংখল এবং পরিকল্পিভাবে হচ্ছে। ফলে দেখা যায়, অনেক ত্রাণদাতা তাদের ত্রাণ আমাদের মাধ্যমে বিতরণ করছে।

যেমন গতকাল ঝিনাইদহের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আমাদের কাছে চার লাখ টাকার ওষুধ প্রদান করে গেছে। আজও (গতকাল) চারটি ত্রাণ প্রদানকারী টিম আমাদের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করছে। ত্রাণগুলো তারাই নিজেদের হাতে বিতরণ করছেন, কিন্তু পুরো ব্যবস্থাপনাটা আমরা তত্ত্বাবধায়ন করছি। এর ফলে শরণার্থীরা সবাই সমান হারে ত্রাণ গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে।

অনেক সময় দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন ত্রাণ দিতে এসে রাস্তার মধ্যেই ত্রাণ দিয়ে চলে যায়। সেখানে যারা শক্তিশালী তারাই বারবার ত্রাণ পাচ্ছে, কিন্তু যারা নারী ও শিশু কিংবা দুর্বল তারা মোটেও ত্রাণ পাচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি, সকল শরণার্থী যেন সমানহারে ত্রাণের আওতায় চলে আসে।’

‘সাকী ভাই, কতোদিন থেকে আপনি এখানে কাজ করছেন? এই ভয়াবহ বিপর্যয় দেখে আপনার অভিজ্ঞতা কীভাবে ব্যক্ত করবেন?’

‘আমি এখানে প্রায় আট-দশদিন থেকে কাজ করছি। অভিজ্ঞতার কথা ভাই বলে বুঝানো যাবে না। এখানে না এলে, নিজ চোখে না দেখলে মানুষের দুর্দশা বুঝা যাবে না। মানুষ কতোটা দুর্বিষহভাবে জীবনযাপন করছে, সেটা আপনি ভাবতেই পারবেন না। এখানে পুলিশ বা বিজিবি দিয়েও আপনি কাজ করতে পারবেন না। কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে তো সম্ভব নয়ই।

https://www.facebook.com/photo.php?fbid=1539452079433938&set=a.544276555618167.1073741825.100001074814273&type=3

আমরা কেবল বর্তমান পরিস্থিতিটা সামাল দিচ্ছি। শুধুমাত্র ২০-৩০ হাজার সেনাসদস্য যদি এখানে সুশৃংখলভাবে মাসখানেক কাজ করে তবেই এই পরিস্থিতিকে কিছুটা আয়ত্বে আনতে পারবে। নয়তো যেভাবে মানবিক বিপর্যয় এখানে সৃষ্টি হয়েছে, তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।’

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর পক্ষ থেকে এবং দেলাওয়ার হোসাইন সাকী ভাইয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গতকাল থেকে শাহপরী দ্বীপের তিনটি মাদরাসায় লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে। সেখানে দিনভর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য একবেলা দুবেলা খাবারের আয়োজন করা হচ্ছে। একজন শরণার্থীও যেন না খেয়ে থাকে সে মহান ব্রত নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।

একজন দেলাওয়ার হোসাইন সাকী হয়তো পারবেন না টেকনাফে আশ্রয় নেয়া সকল রোহিঙ্গার মুখে হাসি ফুটাতে, কিন্তু শরণার্থীদের জন্য দিনের পর দিন তার ত্যাগ ও অবর্ণনীয় শ্রম আরও অসংখ্য তরুণকে অনুপ্রাণিত করবে।

নিজের পরিবার এবং সকল ব্যস্ততাকে আল্লাহর জিম্মায় ছেড়ে দিয়ে অসহায় মানুষের কান্না মুছে দিতে যে যুবক টেকনাফের দুর্গম এলাকায় পাগলের মত ছুটে চলেছেন, এ জমানার মুহাম্মদ বিন কাসিম তো তিনিই। তার ত্যাগ আর বিসর্জনের রক্ত-ঘামেই রচিত হবে আগামী পৃথিবীর ইতিহাস।

তিনিই আমাদের হিরো। আমাদের রিয়েল হিরো।

আগের পর্ব

রোহিঙ্গা শিবিরের হিরো : গাজী ইয়াকুব

রোহিঙ্গা শিবিরের হিরো : সালাহুদ্দীন মাসউদ


সম্পর্কিত খবর



সর্বশেষ সংবাদ