শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


‘আমাদের আর্থ-সামাজিক রাজনীতিতে কিশোর অপরাধের বীজ লুকানো আছে’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ। সময়ের নান্দনিক কথাশিল্পী, লেখক ও সাংবাদিক। শিক্ষক হিসেবেও তার জনপ্রিয়তা অতলস্পর্ষী। ইনিস্টিটিউট অব জার্নালিজম এন্ড দাওয়াহ-এর পরিচালক এ প্রাজ্ঞ আলেম কথা বলেছেন ‘কিশোর অপরাধ’ নিয়ে। তুলে ধরে ধরেছেন কারণ, দেখিয়েছেন উত্তরণের পথ।

সম্প্রতি কিশোর অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে তার মুখোমুখি হন আতাউর রহমান খসরু

আওয়ার ইসলাম : সমাজে কিশোর অপরাধের মাত্রা বাড়ছে। বিষয়টি কতোটা উদ্বেগের?

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ : কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া একটি সমাজের জন্য অনেক বড় উদ্বেগের বিষয়। যেকোনো অপরাধই উদ্বেগের। কিন্তু কিশোরদের অপরাধ নানা কারণে উদ্বেগের। কোমলমতি ও অপরিণত শিশু-কিশোরের মধ্যে অপরাধের প্রবণতা তৈরি হওয়া সমাজের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর।

কিশোরদের একটি দল যখন অপরাধের সাথে জড়িয়ে যায়, তখন যেসব কিশোর এখনো অপরাধপ্রবণ নয় তাদের ভেতরেও সে প্রবণতা তৈরি হতে থাকে। সেটা হয় ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায়।কেউ সঙ্গ দোষে নষ্ট হয়, কেউ হয় এর ভিকটিম। এ প্রবণতা থেকে কিশোরদের মধ্যে মাদক, সংঘাত, খুনোখুনি ও যৌনাপরাধ (ইবটিজিং) ছড়াতে থাকে। শুধু উদ্বেগ নয়; বরং ভয়াবহ ব্যাপার একটি জাতির বিকাশ ও অস্তিত্বের ক্ষেত্রে।

আওয়ার ইসলাম : কিশোর অপরাধের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার কারণ?

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ :  আমাদের সমাজে কিশোর অপরাধ ছড়িয়ে পড়ার অনেক কারণ হয়তো সমাজতাত্ত্বিকগণ বলবেন। আমরা একজন নাগরিক হিসেবে সাদাচোখে যা দেখি তাহলো, যথাযথ ধর্মীয় শিক্ষা ও তার পরিপালন সমাজের সবক্ষেত্রে না থাকা। ধর্মের শিক্ষা ও দীক্ষা (তরবিয়্যত) আমাদের পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থায় যথাযথভাবে থাকলে হয়তো আজকের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। বিশেষ করে চরিত্রগঠনমূলক তরবিয়্যত বা দীক্ষা শিশু-কিশোরদের জন্য নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

সাথে সাথে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া প্রচারিত বিভিন্ন বিষয় শিশুকে অপরাধপ্রবণ করছে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতাও একটি কারণ। বলা যায় সামগ্রিক সামাজিক ও বৈশ্বিক আবহই শিশু-কিশোরদের বিপদগামী করছে। তাদের চরিত্র নষ্ট করছে, মাদকের প্রতি মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতা তৈরি করছে, হিংসা-হানাহানির মনোভব তৈরি করছে।

আওয়ার ইসলাম : কিশোর অপরাধের সঙ্গে বারবার আধুনিক ও নগর জীবনের কথা উচ্চারিত হচ্ছে। নগর জীবনে এ প্রবণতাও অনেক বেশি। নগরসভ্যতাকে কেনো দায়ী করা হয়?

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ : নগরসভ্যতা ও নগরজীবন যাই বলেন, তা আমাদের শিশু-কিশোরদের একটি নতুন ও নিঃসঙ্গ জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাদের অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠার সুযোগ দিচ্ছে।  আমাদের আধুনিক ও নাগরিক পরিবারগুলো শিশুকে সময় কম দেয়।

মা-বাবা উভয়ে চাকরি করেন অথবা মা চাকরি করেন না কিন্তু মেট্রো লাইফে তারা এতো ব্যস্ত থাকেন যে তারা সন্তানের মনের ভেতর প্রবেশের চেষ্টাই করেন না; হয়তো সুযোগও পান না। সন্তানকে আদর করা, তার আচরণের প্রতি খেয়াল রাখা, সন্তানের মনস্তাত্ত্বিক কোনো পরিবর্তন আসছে কিনা তা লক্ষ্য রাখা দরকার বলেই আমি মনে করি।

‘ঘর নেই, খাবার নেই, বাথরুম নেই, গায়ে কাদা, চেহারায় আতঙ্ক, এ দৃশ্য সহ্য করার মতো নয়’

আরাকানের স্বাধীনতা ছাড়া রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান অসম্ভব: মাওলানা লিয়াকত আলী

এর সাথে ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহারও উল্লেখ করা যায়। আজ থেকে পাঁচ-সাত বছর আগেও পিসি ছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহার করা কঠিন ছিলো। কিন্তু এখন ৩ হাজার টাকার একটি এন্ড্রোয়েড মোবাইল সেট হলেই সে সব কিছু হাতের মুঠোই পেয়ে যাচ্ছে।

আমার মনে হয়, কিশোর-তরুণ-তরুণীদের ইন্টারনেটসমৃদ্ধ মোবাইল ফোনের অবাধ ব্যবহার সম্পর্কে সারা জাতিরই আরেকবার ভাবা প্রয়োজন। তার ব্যবহার কেমন হওয়া উচিৎ, কতোটুকু হওয়া উচিৎ  পুরো বিষয়টা নিয়েই আমাদের নীতিনির্ধারক ও পরিবারগুলোর আরেকবার ভাবা দরকার।

আওয়ার ইসলাম : পশ্চিমা বিশ্বে এ ধরনের ব্যবস্থা আছে বলে আমি জানি। শিশুদের উপযোগী এমন মোবাইল ফোন আছে যা দিয়ে নির্ধারিত নম্বরের কল রিসিভ ও ডায়াল করা যায়।

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ : এ ধরনের পদ্ধতি দিকে আমাদের যাওয়া উচিৎ। আমরা এমন অনেক কিছু গ্রহণ করি যা আমাদের বিশ্বাস ও চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাহলে পশ্চিমা বিশ্ব সমাজ, জীবন, তরুণ-তরুণীদের মানসিক কোমলতা রক্ষার জন্য কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করলে তা আমরাও কেনো গ্রহণ করবো না।

ফিল্টারিংসমৃদ্ধ প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ানো সময়ের দাবি। যেনো আমাদের তরুণরা সহজেই অপরাধের দিকে ঝুঁকে না পড়ে, আক্রান্ত না হয় সে চেষ্টা করা আমাদরে দায়িত্ব।

আওয়ার ইসলাম : আপনার কথায় পরিবারের বিষয়টি উঠে এসেছে। শিশু-কিশোরদের উপযোগী পারিবারিক কাঠামো কেমন হওয়া উচিৎ?

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ : খুব সংক্ষেপে এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন। তবুও আমি বলবো, আদর্শ দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে হজরত সাহাবায়ে কেরাম রা. থেকে শুরু করে সমকালীন মনীষীদের অনেক রচনা রয়েছে, জীবনচরিত, পাঠ-উপকরণ রয়েছে।

সেগুলো পড়লে আমরা বুঝতে পারবো আদর্শ পরিবারের কাঠামো কেমন হয়। পরিবারের ব্যাপারে দীনী শিক্ষা; আমি বলবো, শ্বাশত মানবিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ যাকে বাংলায় নৈতিকতা শিক্ষা বলে যেমন, পারস্পারিক শ্রদ্ধ ও স্নেহের সম্পর্ক, সহনশীলতা ও উদারতা, সত্যবাদিতা ও সততা, অন্যের অধিকার নষ্ট না করা, পিতা-মাতাকে মান্য করা অর্থাৎ যুগে যুগে যে বিষয়গুলো আমরা মান্য করেছি  একটি পরিবার যদি তা মান্য করে সেটা আদর্শ পরিবার গঠনে সহায়ক হবে।

আওয়ার ইসলাম : শিশু-কিশোরের জীবন গঠনে বাবা-মার পারস্পারিক সম্পর্ক ও সন্তানের সাথে তাদের আচরণ কেমন প্রভাব ফেলে?

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ : স্বামী-স্ত্রীর পারস্পারিক সু-সম্পর্ক রক্ষা করা এবং পরিবার ও সন্তানকে পযাপ্ত সময় দেয়া অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এতে যদি আয়-উপার্জন কমে যায় এবং সন্তানের লেখাপড়া ভালো হয়, মানসিক উন্নতি ঘটে তাতে ক্ষতি নেই। একজন মানুষ কোটিপতি না হয়ে লাখপতি হলো এবং তার সন্তান সু-সন্তান হলো আমি এ লোকটিকেই লাভবান মনে করবো। এটাকে দুনিয়া আখেরাতে সফল বিনিয়োগ বলেই মনে করি।

আওয়ার ইসলাম : কিশোর অপরাধের কারণ হিসেবে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর রিপোর্টে বার বার উঠে এসেছে ‘গ্যাং ক্যালচার’। বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন?

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ : কোনো সন্দেহ নেই, কিশোর অপরাধের বড় উপসর্গ গ্যাং ক্যালচার। বছরখানিক আগে উত্তরায় একটি ছেলে মারা যায় গ্যাং কালচারের কারণে। আমি বলবো, আমাদের দেশে বিনোদনের নামে এমন সব বিষয় ছড়িয়ে পড়ছে যা শিশু-কিশোরদের সংঘবদ্ধ অপরাধে উদ্বুদ্ধ করছে।

আমার মনে হয়, আমাদের আর্থ-সামাজিক রাজনীতির ভেতর এর একটি বীজ লুকানো আছে। আমাদের সমাজে এই ব্যাপারটা আছে, একটি ছেলে কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রাছায়ায় চলে সমাজে প্রভাবশালী হয়ে উঠছে, শূন্য থেকে কোটিপতি হচ্ছে বয়স পঁচিশ হওয়ার পূর্বেই, পড়ালেখা ছাড়াই সে চাকরি-বাকরি পেয়ে যাচ্ছে কিছু সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের সঙ্গে হেঁটে-চলে। এসব কারণে পরিবারের উপরের দিকের একটি মৌনসমর্থনও লক্ষ্য করা যায় কখনো কখনো। তারা তো খুনোখুনি পযন্ত ভাবতে পারে না। তারা ভাবে এতে যদি ছেলেটার ক্যারিয়ার গড়ে ওঠে দোষ কী?

আওয়ার ইসলাম : উন্নত বিশ্বে শিশুর মনস্তাত্ত্বিক গঠনের উপর গুরুত্ব দিয়ে সিলেবাস করা হয়। আমাদের কি সেদিকে মনোযোগ দেয়া উচিৎ নয়?

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ : বিষয়টি সমর্থন করে আমি বলবো, ইসলামের ইতিহাসেও এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। পশ্চিমা বিশ্ব অনেক সময় হাজার বছরের অতীত কোনো ঘটনাকে উপজীব্য করে একটি শিক্ষা গ্রহণ করে এবং তা তাদের সিলেবাসে অন্তর্ভূক্ত করে। ইসলামের ইতিহাসে শিশুর মনস্তাত্ত্বিক গঠনের দৃষ্টান্তের অভাব নেই। সাহাবায়ে কেরামের জীবনের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখবেন, তারা কিভাবে শিশুর মনস্তত্ত্ব গঠন করেছেন। হজরত মুহাম্মদ সা. ও মা পাখির গল্প এখানে পেশ করা যায়।

আওয়ার ইসলাম : এ সংকট বা আপনার ভাষায় জাতির অস্তিত্বের জন্য ভয়াবহ বিপযয় থেকে আমরা কিভাবে আত্মরক্ষা পেতে পারি?

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ : আমাদের সামগ্রিক আলোচনায় আত্মরক্ষার বিষয়টিও চলে এসেছে। আমি বলবো, সমাজের সব পযায়ে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার বিস্তার, আদর্শ পরিবার গঠন, চরিত্র ধ্বংসকারী ইন্টারনেট ও বিনোদন মাধ্যম পরিহার, শ্বাশত মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা, সন্তানের জন্য সময় ও সুশিক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমরা এ বিপযয় রোধ করতে পাারি।

আওয়ার ইসলাম : আপনি যদি কিছু যোগ করতে চান!

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ : আমাদের সমাজে একটি চোরাই বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, যখনি মানবিক মূল্যবোধ ও শিক্ষার কথা বলা হয়, তখনি নাচ-গান-বিনোদনের কথা টেনে আনা হয়।

ধর্ম থেকে সরিয়ে অন্যভাবে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করা হয়। মানবিক মূল্যবোধের সাথে নাচ-গান, শিল্প ও কথিত সংস্কৃতিকে যুক্ত করা হয়।

আমি মনে করি, এটাও একটি বিপযয়কর দিক। যারা এগুলো করছেন, ধর্মীয় মূল্যবোধকে চাপা দেয়ার জন্য করছেন। এটা একটি বিষ্ফলমূলক প্রস্তাব ও প্রচেষ্টা।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ