শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪ ।। ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ।। ৯ জিলকদ ১৪৪৫


মিশরের কারাগারে বন্দীদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মাদ শোয়াইব : গত মে মাস থেকে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা ও মানবাধিকার সংস্থার ওয়েবসাইট বন্ধ করছে মিশর। ইতিমধ্যে কয়েকটি প্রভাবশালী নিউজ পোর্টালও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। 

সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার (০8 সেপ্টেম্বর ২০১৭) বন্ধ করে দেয়া হয়েছে নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার গোষ্ঠী, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়েবসাইটটিও। এটি বন্ধ করা হয়েছে মিশরীয় কারাগারে বন্দীদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতনকে কেন্দ্র করে সরেজমিন ঘুরে করা একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে।এখানে বন্দীদের ওপর অবিশ্বাস্য নির্যাতন করা হয় শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করার একদিন পর সংস্থাটির ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছে মিশর। গতকাল থেকে মিশরের অভ্যন্তরে এই সাইটটিতে ঢোকা যাচ্ছে না।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা শাখার উপ পরিচালক জো স্টর্ক বলেন, ‘মিশর সরকার কারাগারে বন্দীদের নির্যাতনকে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত বাড়াবাড়ি মনে করে। কিন্তু হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন বলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা।’

সরেজমিন প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে ১৯ জন সাবেক বন্দী ও অন্যান্য বন্দীদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে সাক্ষাৎকার নিয়ে।

নির্বাচারে গ্রেফতার ও গুম এখন মিশরে স্বাভাবিক ব্যাপার। যারা গ্রেফতার বা গুমের শিকার হন তারা সাধারণত ভয়াবহ নিপীড়নের শিকার হন। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে অনেক নিরাপরাধ মানুষ প্রেফতারের পর কারাগারে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এই নিপীড়ন থেকে রেহাই পায়নি প্রতিরক্ষা আইনজীবী ও মানবাধিকার আইনজীবীরাও।

এই ঘটনায় মিশরের কড়া সমালোচনা করে জাতিসংঘকে মিশরীয় নিরাপত্তা কর্মী, যারা এই নিপীড়নের সঙ্গে সরাসরি জড়িত তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে তদন্ত করার আহবান জানায় লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। আর যেসব কর্মমর্তারা এসব নিপীড়ন সম্পর্কে জানেন তাদের নিয়ে তদন্ত করলে তো আর কথাই নেই।

স্টর্ক আরও বলেন, ‘মিশরীয় কর্তৃপক্ষ নির্যাতন সঙ্কট বন্ধ করার পরিবর্তে মানুষকে সেসব রিপোর্ট সম্পর্কে অন্ধকারে রাখতে চায় যা মিশরবাসী স্বচোক্ষে দেখে। আর কিছু কিছু তো এই নিপীড়নের সরাসরি শিকার।’

এই প্রতিবেদনে মিশরীয় কর্তৃপক্ষ খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছে। মিশরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এই প্রতিবেদন দেশের সুনাম নষ্ট করা হয়েছে এবং বিগত বছরগুলোতে মিশর যে মানবাধিকারে উন্নতি করেছে তাকে অবজ্ঞা করা হয়েছে।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র আহমাদ আবু জায়েদ বলেন, ‘এটি হলো রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা একটি প্রতিবেদন ‘

সংস্থাটির ওয়েবসাইট বন্ধ করা প্রসঙ্গে মিশরীয় সাংবাদিক তামির আবু আরব ফেইসবুকে দেওয়া তার এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি তার রিপোর্টে উল্লিখিত বিষয়গুলোর শুদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য এর চেয়ে আরও ভালো কোনো পদক্ষেপ আশা করেনি।’

লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির ডেপুটি প্রধান মাজদি হামদান বলেন, ‘সরকার সংস্থাটিকে অভিযুক্ত করেছে, যে তাকে অর্থ দেয়া হয়েছে। আর জনগণ যাতে বিষয়টি জানতে না পারে সেজন্য সাইটটিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’

উল্লেখ্য, গত মে মাস থেকে বহু স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ও মানবাধিকার সংস্থার ওয়েব সাইট বন্ধ করে দিয়েছে মিশর। এর মধ্যে রয়েছে আল জাজিরা, হাফিংটন পোস্ট, আরাবি ইত্যাদি। মূলত সৌদি আরব ও আরব আমিরাত প্রথমে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এরপর মিশরও তাদের দেখাদেখি একই ধরনের পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে।

যেসব সাইট বন্ধ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, অনলাইন ভিত্তিক পোর্টাল ‘কনতরা’। যেটি চলে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রণায়ের তত্বাবধানে ডয়চে ভেলের অর্থায়নে।

‘ চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংস্থা’র সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত এই কয়েক মাসে প্রায় ৪২৪টি নিউজ পোর্টাল ও ব্লগ সাইট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

এ ধরনের পৈশাচিক নির্যাতন মিশরের জন্য নতুন কিছু নয়। এর আগেও এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে মিশরে।

২০১৫ সালে একবার ‘মিশরের কারাগারে বন্দি এক নারীর আর্তনাদ’ শিরোনামটি  বিশ্ব মিডিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল।  পেছনের পত্রিকা ঘেটে সংবাদটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।

গণতন্ত্রপন্থিদের জন্য নির্যাতনের সেলে পরিণত হয়েছে মিশরের কারাগারগুলো। বন্দিদের আর্তনাদে প্রতিনিয়ত কাঁপছে কারাসেলগুলো।

এমনই বর্বরতম চিত্র উঠে এসেছে এক নারী কারাবন্দির চিঠিতে। গত ৭ জুলাইয়ের লেখা এই চিঠি গণমাধ্যমে আসে মঙ্গলবার।

সরা আল-তাবিল নামের এই তরুণীকে তুলে নিয়ে যায় কিছু অপরিচিত লোক। এরপর তাকে নিরাপত্তা বাহিনীর একটি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। ভবনটি আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ব্যবহৃত হয়। একই কায়দায় তার দুই ছেলে বন্ধুকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেখানকার নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি নিরাপত্তা বাহিনীর ওই ভবনে ১৫ দিন অতিবাহিত করেছি, জিজ্ঞাসাবাদ মুখোমুখি হয়েছি। এ সময় আমি নির্যাতনের শব্দ শুনেছি, বন্দিরা আর্তনাদ করছিল। ওই ১৫ দিনে সেখানে আমিই ছিলাম একমাত্র নারী।’

তরুণ ফটোগ্রাফার তাবিলকে ১৬ দিন পর আদালতে নেয়া হয়। সেখানে প্রায় ১৮ ঘণ্টা তাকে থাকতে হয়। তার বর্ণনায়, দাঁড়িয়ে থাকতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল তার। কারণ ২০১৪ সালের জানুয়ারির বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে তার মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হলে ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারছেন না তিনি।

এরপর তাবিলকে আল-কানাতির কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। এই কারাগারের অধিকাংশ বন্দি নিষিদ্ধ ঘোষিত মুসলিম ব্রাদারহুডের। আর তাদের সবার বিরুদ্ধে অভিযোগের ধরনও প্রায় একই।

তাবিলের বিরুদ্ধে মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য হওয়া এবং মনগড়া সংবাদ প্রচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। অবশ্য দুটি অভিযোগই অস্বীকার করেছেন তিনি।

বন্দি জীবনের বর্ণনায় তাবিল আরো বলেন, কারাগারের পরিবেশ অত্যন্ত নোংরা, রয়েছে তেলাপোকার উৎপাত। অন্য আসামিদেরকেও ভয় পান তিনি। নানা অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়া বন্দিদের সঙ্গে তাকে রাখা হয়েছে। এদের কেউ কেউ পতিতাবৃত্তি, ছিনতাই এবং চুরির মতো অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছে।

তবে তিনি বলেন, যখন পরিবারের সদস্যরা দেখা করতে আসেন, তখন একটু দম ফেলার ফুসরত মেলে এবং যখন তাকে মুসলিম ব্রাদারহুডের নারী বন্দিদের সঙ্গে রাখা হয়।

নিজেকে ব্রাদারহুডের কেউ নন দাবি করে তাবিল বলেন, ব্রাদাহুডের বন্দিদের সঙ্গেই থাকতে পছন্দ করেন তিনি। কারণ, তাদের কেউ ধুমপান করেন না।

চিঠিতে উঠে এসেছে তরুণী এই ফটোগ্রাফারের আর্তনাদও। তিনি বলেন, ‘একটা সময়ের শেষে জীবন আমাদের আলো দেয়। এটা আমাদের বড় কষ্টগুলো ভুলিয়ে দেয়। ওহ আল্লাহ! কখন এই দুঃস্বপ্নের শেষ হবে।’

সম্প্রতি সাবেক সেনাপ্রধান ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি সরকারের সমালোচনা করেছেন এমন বেশ কয়েকজন মিশরীয় নাগরিক গুমের শিকার হয়েছেন। দেশটির জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এ ধরনের অন্তত ৫০টি অভিযোগ পেয়েছে।

এছাড়া কারাগারে খুন, নিপীড়ন এবং অবহেলার শিকার হয়ে ১২৪ জন বন্দির মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

আরও একটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো।

৬৪৩ দিন ধরে নির্যাতনের শিকার হয়েছি

৬৪৩ দিন ধরে নির্যাতনের শিকার হয়েছি আমি। আর আমার নির্যাতনকারীকে লাল গালিচা দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন।

মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল সিসির বৃটেন সফরের আগ দিয়ে নিজের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে এ কথা লিখেছেন দেশটির নাগরিক মোহাম্মদ সোলতান।

গার্ডিয়ানে তিনি আরও লিখেছেন, লন্ডনে সিসির সফর শুধু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে মিশরীয়দের আস্থাকেই খাটো করবে না, এটা দেশে তাদের মৌলবাদকে উৎসাহিত করবে। সোলতান তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, কায়রোর কেন্দ্রবিন্দুতে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের লক্ষ্য করে সেনাবাহিনীর খোলা গুলিবর্ষনে কয়েক ইঞ্চির জন্য একটি গুলির আঘাত থেকে বেচে যায় আমার মাথা। তবে ২০১৩ সালের আগস্টে সেনাদের গুলি থেকে বাচতে পারিনি। গুলিতে আমার বাহুর হাড় ভেঙে যায়। এর আগে দুই ক্যামেরাম্যান মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। আমি সহ অপর সাংবাদিকদে শুধু টার্গেট করা হয়েছিল কারণ আমরা মিশরের ইতিহাসে প্রথম

গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে উৎখাতের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ অবস্থান ধর্মঘট কভার করছিলাম। কিছুদিন পর আমার বাড়ি থেকে আরও তিন সাংবাদিক সহ আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তী ২১ মাস ধরে আমি ও আমার সতির্থ রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর নিয়মিত চরম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়।

ভয়াবহ ওই নির্যাতনের প্রভাব থেকে আমি এখনও বের হয়ে আসতে পারি নি। নিরাপত্তারক্ষীরা দুই লাইনে দাড়াতো। আর আমাদের লাইনের মাঝখানে দৌড়াতে বাধ্য করা হতো। দৌড়ানো অবস্থায় সবাই লাঠি, চাবুক, বেল্ট দিয়ে বেধড়ক মারধোর করতো। আমার ভাঙা হাতে দু’ঘণ্টা ধরে প্রহার করা হয়। আমার অবৈধ আটকের বিরুদ্ধে আমরণ অনশণ শুরু করার পার আমাকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার একটি কারগারে আলাদা একটি কক্ষে ‘মেডিকেল পর্যবেক্ষণে’ রাখা হয়। সেখানে কমপক্ষে ১০ বার মারা যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।

একাধিকবার কোমায় চলে গেছি। কারাগারের এক কোনে জানালাবিহীন একটি কক্ষে আমাকে রাখা য়। সেখাটে টানা ১৬৩ দিন মানসিক নির্যাতন করা হয় আমাকে। শুধুমাত্র নিরাপত্তারক্ষীরা ব্যতিত কোন মানুষের সঙ্গে দেখা বা কথা বলতে দেয়া হয় নি। আর ওই কর্মকর্তা আমার কাছে ব্লেড আর খোলা বিদ্যুতের তার দিয়ে আত্মহত্যা করতে বলতো।

কারাগারে রাজনৈতিক বন্দী আমার পিতাকেও  আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গার্ডিয়ানে লেখা নিবন্দে সোলতান বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, ক্যামেরন যদি নীতিগত কারণে একজন অতিথিকে দেয়া আমন্ত্রন ফেরাতে না চান তাহলে নিজেদের সন্ত্রাসবিরোধী কৌশল মেনে তার সেটা করা উচিত।

সূত্র : আল মুজতামা


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ