মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১০ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫


কোন পথে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আবদুর রহমান আর রাশেদ :  মধ্যপ্রাচ্যের সব যুদ্ধ-দ্বন্দ্বের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইরানের রাজনৈতিক ও সামরিক ভূমিকা লক্ষ করা যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া ও ইরানের প্রভাব বাড়ায় উদ্বিগ্ন সুন্নি অধ্যুষিত উপসাগরীয় দেশগুলো। ইসরাইল ও সৌদি আরবে ঐতিহ্যগত প্রতিরক্ষা সহযোগী ইরানের সুসম্পর্ককে তারা সন্দেহের চোখেই দেখছে। যে কোনো সমঝোতার বিপক্ষে থাকা সৌদি আরব চেয়েছিল ইরানের ওপর অবরোধ অব্যাহত থাক। ইসরাইল অবশ্য চেয়েছিল উৎকৃষ্ট একটা চুক্তি; যাতে ইরানকে একেবারেই পারমাণবিক শক্তিশূন্য করা সম্ভব হয়
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইরানের সঙ্গে ছয় বিশ্বশক্তির সমঝোতা চুক্তি ভঙ্গ করলে তার পরিণতি ভালো হবে না বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। ইরানের ওপর থেকে সরিয়ে নেয়া অর্থনৈতিক অবরোধ আবার ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্তে ইরান প্রচ-ভাবে ধাক্কা খেয়েছে। আমেরিকার বর্তমান প্রেডিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনও তার অবস্থানে অনড়। তার দাবি প্রেসিডেন্ট ওবামা যেভাবে চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করেছেন, তা আমেরিকার জন্য ক্ষতিকর। এতে আমেরিকার স্বার্থ নষ্ট হয়েছে। তিনি এ চুক্তিটিকে বাতিল করার কথা বলেছেন। যদিও বিশ্বশান্তি ও স্বস্তির পক্ষে এক যুগান্তকারী এবং ঐতিহাসিক ও অভাবনীয় পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করা হযেছে ইরানের সঙ্গে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ছয় বিশ্বশক্তির সমঝোতা চুক্তিটিকে। তর্কবিতর্ক-সমালোচনা-পর্যালোচনা যা-ই হোক, এমন একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়া অনায়াসসাধ্য ছিল বলা যাবে না। এ চুক্তি ইরানকে স্বস্তি দিয়েছিল এই কারণে যে, তার দীর্ঘ অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটেছে। খুলে গেছে বিশ্বের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের দরজাগুলো। তবে সেজন্য ইরানকে পরমাণু কর্মসূচি সীমিত করতে হয়েছে। অবশ্য এ চুক্তির বিপক্ষে যারা অবস্থান করছিলেন ডোনাল ট্রাম্পের কথায় তাদের মাঝে আবার স্বস্তি ফিরে এসেছে।
ইইউ দেশগুলো চাচ্ছে এ চুক্তিটি টিকে থাকুক। কারণ চুক্তিটি সম্পন্ন হওয়ার পর থেকে ইরানের সঙ্গে বড় বড় ব্যবসায়িক চুক্তি করতে পেরেছে তারা। অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের সময় ইইউ দেশগুলো ইরানের বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে কোনোরূপ ব্যবসায়িক চুক্তি সম্পন্ন করতে পারেনি। ইরানের বড় বড় কোম্পানি তখন কালো তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অন্যদিকে এ চুক্তির কারণে সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট হয়েছে আরব দেশগুলো। বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশগুলো। আরও বিশেষভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ সৌদি আরব ও ইসরাইল। তারা মনে করছে, এ চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার বন্ধ করার পরিবর্তে বিশ্বে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দিয়েছে। সৌদিদের ভাষ্য, এ চুক্তি ইরানকে আরব দেশগুলোতে সৌদি আরবের শত্রুদের প্রতি সমর্থন বাড়ানোর সুযোগ দিয়েছে। কারণ চুক্তির ফলে ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোতে আরও নিবিড় পর্যবেক্ষণ চালাতে দিয়ে নিষেধাজ্ঞার হাত থেকে রেহাই পেয়েছে ইরান। চুক্তি অনুযায়ী ইরানের হুমকি আরও গুরুতর হয়ে দেখা দিয়েছে। রক্ষণশীল সুন্নি মুসলিম অধ্যুষিত সৌদিরা শিয়া অধ্যুষিত ইরানকে মোকাবিলা করতে কয়েক মাস ধরে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। ইরানের প্রভাবই আরব দেশগুলোতে অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতার প্রধান কারণ বলে সৌদিদের বদ্ধমূল ধারণা। ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের দায়ে সৌদির নেতৃত্বে কাতারকে অবরোধ করা হয়েছে।
এটা বাস্তব যে, মধ্যপ্রাচ্যের সব যুদ্ধ-দ্বন্দ্বের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইরানের রাজনৈতিক ও সামরিক ভূমিকা লক্ষ করা যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া ও ইরানের প্রভাব বাড়ায় উদ্বিগ্ন সুন্নি অধ্যুষিত উপসাগরীয় দেশগুলো। ইসরাইল ও সৌদি আরবে ঐতিহ্যগত প্রতিরক্ষা সহযোগী ইরানের সুসম্পর্ককে তারা সন্দেহের চোখেই দেখছে। যে কোনো সমঝোতার বিপক্ষে থাকা সৌদি আরব চেয়েছিল ইরানের ওপর অবরোধ অব্যাহত থাক। ইসরাইল অবশ্য চেয়েছিল উৎকৃষ্ট একটা চুক্তি, যাতে ইরানকে একেবারেই পারমাণবিক শক্তিশূন্য করা সম্ভব হয়।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, কুয়েত, ওমান ও কাতার মিলে গঠিত উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ এ চুক্তি নিয়ে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন। তারা বলতে চায় আরব বিশ্বে বিভিন্ন দেশে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে ইরান। একই সঙ্গে এ অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বাড়ানোরও চেষ্টা করছে। এ দেশগুলো তাদের বড় শত্রু। তারা মূলত পারমাণবিক চুক্তির বিরুদ্ধে ছিল না। তারা ছিল ইরানের সঙ্গে ব্যবসায়িক চুক্তির বিরুদ্ধে। কারণ এতে ইরান অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছে এবং উপসাগরীয় দেশগুলোতে যুদ্ধ লাগাচ্ছে। বিশেষ করে তিনটি আরব দেশে যুদ্ধে ইরানের সরাসরি হাত রয়েছে, তাহলো সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরাক। ইরানের সঙ্গে ব্যবসায়িক পার্টনার বাড়লে সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা এ তিন দেশে ইরানের হস্তক্ষেপ আরও বাড়বে।
অন্যদিকে পারমাণবিক চুক্তি ভঙ্গ হলে ইরান আবার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করবে। এতে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খখলা বাড়বে বৈ কমবে না। সেক্ষেত্রে ইরান পশ্চিমাদের সামনে দুইটি বিকল্প রাস্তা রাখবে, যার একটি পশ্চিমাদের গ্রহণ করতেই হবে। এক. হয়তো পশ্চিমারা ইরানের সঙ্গে চুক্তি বহাল রাখবে। এতে উপসাগরীয় অঞ্চলে তার প্রভাব ক্রমেই বাড়বে। দুই. চুক্তি ভঙ্গ করলে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ হবে এবং এতে আমেরিকা ও ইসরাইলের ক্ষতি হবে।
মোটকথা, ওবামা ইরানের সঙ্গে চুক্তি করে শুধু পারমাণবিক প্রকল্প বন্ধ করেছে; অন্যদিকে ইরানের হাতকে এমনভাবে ছেড়ে দিয়েছে, যাতে ইরান সব জায়গায় তার প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এতে ওইসব রাষ্ট্রও রয়েছে, যেসব রাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রয়েছে। যেমন উপসাগরীয় অঞ্চল, ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান।
সুতরাং এ সত্যটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে, পারমাণবিক চুক্তি ইরানের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বিজয়। ওবামা প্রশাসনের জন্য একটি মারাত্মক ভুল। এ ভুলটি করার কারণে ইরান এ অঞ্চলে ক্রমে প্রভাব বিস্তার করতে পারছে। এমনকি এমন দেশেও যুদ্ধ করছে, যে দেশের সঙ্গে ইরানের কোনো স্থলসীমানা নেই। সিরিয়ায় ইরানের নেতৃত্বে ৫০ হাজার কট্টরপন্থী যোদ্ধা রয়েছে। অথচ পুরো উপসাগরীয় অঞ্চল এখন কট্টরপন্থী বিভিন্ন সংগঠনের কার্যক্রম থেকে মুক্তি চাচ্ছে।

আশ শারকুল আওসাত অবলম্বনে মুহাম্মাদ শোয়াইব


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ