পলাশ রহমান
শুক্রবার, ২৫ আগস্ট, বাদ আছর। খুলনার বায়তুন নূর জামে মসজিদের উত্তর গেট। একদল দাড়ি-টুপি ওয়ালা মানুষ মিটিং করছেন। ঝনঝনে শব্দে বক্তৃতা করছেন গলার রগ ফুলিয়ে। সমাবেশ থেকে একটু ফারাক রেখে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। শুনতে থাকলাম তাদের বক্তৃতা।
মিটিং করছিলেন ইসলামি শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। উপলক্ষ্য তাদের ২৬ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। দেখতে দেখতে দলটি ২৫টি বছর অতিক্রম করে ফেলেছে। বিগত ২৫ বছরে তাদের অর্জন কী, সাংগঠনিক অগ্রগতি কী, তা আমি জানি না। কিন্তু এই দলটির প্রতি আমার ভেতরে এক প্রকারের দুর্বলতা কাজ করে। অচেনা দুর্বলতার বিশেষ কোনো কারণ হয়তো নেই, কিন্তু কেনো যেনো তাদের প্রতি কিছুটা ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ অনুভব করি। চলতি পথে তাদের কোনো মিটিং, মিছিল, সমাবেশ দেখলে থমকে দাঁড়াই। এক চিলতে মৌন সমর্থন জানিয়ে কেটে পড়ি।
গত শুক্রবারও ব্যতিক্রম ছিল না। নিউ মার্কেটের কোনায় দাঁড়িয়ে তাদের বক্তৃতা শুনছি। এমন সময় দূর থেকে মিছিলের শব্দ ভেসে আসতে শুরু করলো। প্রথমে ভেবেছিলাম মিছিলটা ছাত্র আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর সমাবেশে এসে যোগ দেবে। কিন্তু তা হলো না। তারা বায়তুন নূর অতিক্রম করে সোজা জোড়া গেটের দিকে চলে গেলো। তাদেরও প্রায় সবার মাথায় সাদা টুপি, থুতনির নিচে দাড়ি। কারো কারো টুপির উপরে পাগড়ি বাঁধা।
জোড়া গেটের দিকে চলে যাওয়া মিছিলটা যখন বায়তুন নূর অতিক্রম করছিল তখন বায়তুন নূরের সমাবেশে বেশ খানিকটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ করলাম। কর্মী শ্রোতাদের মধ্যে একটা উসখুস ভাব। এক প্রকারের চাপা অস্থিরতা দেখা গেলো। এরই মধ্যে সমাবেশের মাইক থেকে ঘোষণা এলো- ‘ওদিকে কেউ তাকাবেন না। ওটা আমাদের কিছু না। কেউ ওদিকে যাবেন না’ ইত্যাদি।
আমি খুব অবাক হলাম, বিস্মিত হলাম। বায়তুন নূরে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর সমাবেশ করছিল সংগঠনটির খুলনা জেলার দক্ষিন শাখা এবং ফেরিঘাটে সমাবেশ করে মিছিলসহ বায়তুন নূর অতিক্রম করছিল একই সংগঠনের খুলনা জেলার উত্তর শাখা। একই দিনে, একই শহরে, অভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে পৃথকভাবে মাঠে নেমেছিল ইসলামি শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন খুলনা জেলার নেতাকর্মীরা। এক প্রোগ্রামের মাইক থেকে অপর প্রোগ্রাম সম্পর্কে বলা হলো- ‘ওদিকে কেউ তাকাবেন না। ওটা আমাদের কিছু না। কেউ ওদিকে যাবেন না’। হায়রে ইসলামের রাজনীতি! বস্তুবাদী সংগঠনগুলোর সাথে এদের আর বিশেষ কোনো পার্থক্য থাকলো না। এরা নিজেরাই পার্থক্য রাখলো না।
এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন আমার বন্ধু বসির আহমেদ। ইসলামি আন্দোলন বা ছাত্র আন্দোলনের প্রতি কিছুটা দুর্বল আমার খুলনার বন্ধুটি বেশ মনোকষ্ট পেয়েছেন। তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন নি ইসলামি আদর্শের কথা বলা কোনো সংগঠনের এমন আচারণ হতে পারে। তার কথা হলো- এরা যদি আওয়ামী লীগ, বিএনপি হতো কোনো কথা ছিল না। ওরা বস্তুবাদের রাজনীতি করে। ওদের মৌলিক কোনো আদর্শ নেই। ওদের দলাদলি, কামড়া-কামড়ি দেশবাসী অহরহ দেখে। ওদের অপরাজনীতিতে ত্যাক্ত-বিরক্ত দেশের সাধারণ মানুষ এখন বিকল্পের সন্ধান করছে। কিন্তু দেশের ইসলামি আদর্শের সংগঠনগুলোর মধ্যেও যদি বস্তুবাদী আচারণ ঢুকে যায়, তা হবে খুব বেশি দুঃখজনক। বিশেষ করে ইসলামি শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন, যারা শ্লোগান দেয়- সাহাবাদের অনুস্মরণ ইশা ছাত্র আন্দোলন। এগুলোই কি তাদের সাহাবাদের অনুসরণ? শুধুমাত্র লম্বা পানজাবি পরলে আর মুখে দাড়ি রাখলেই কি সাহাবাদের অনুসরণ হয়ে যায়?
২৫ বছর একটা সংগঠনের জন্য একদম কম সময় নয়। এই সময়ের মধ্যে তাদের অর্জন কী? কতো দূর নিতে পেরেছে তাদের সংগঠন? সাংগঠনিক কি নিজস্বতা দেখাতে পেরেছে তারা? এসব প্রশ্ন মাথায় নিয়ে আমি আমার প্রিয় শহর খুলনার ইসলামি শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের একটু খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। তা করতে গিয়ে সংগঠনটির ভেতরগত এমন কিছু সংকট বেরিয়ে এসেছে যা লিখে শেষ করা অসম্ভব প্রায়।
২৫ আগস্ট, শুক্রবার খুলনার ইসলামি শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন শহরের প্রাণকেন্দ্রে পৃথক দুটি সমাবেশ এবং মিছিল করেছে। একটি সমাবেশ-মিছিল হয়েছে খুলনা জেলা উত্তর শাখার ব্যানারে, অপরটি খুলনা জেলা দক্ষিণ শাখার ব্যানারে। কিন্তু কেনো তারা পৃথক সমাবেশ মিছিল করতে গেলো? এমন কি প্রয়োজন দেখা দিলো?প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর মতো একটি ভাইটাল কর্মসূচি তারা একসাথে করতে পারলো না কেনো? এ থেকেই বোঝা যায় তাদের ভেতরের অবস্থা কতোটা নাজুক। তাদের উপরের নেতারা কতোটা ভুল পথে পরিচালিত বা উৎসাহিত করেছে তাদের।
ছাত্রদের মধ্যে কোনো ভুল বুঝাবুঝি থাকলে, মনোমালিন্য থাকলে উপরের নেতারা কেনো তা মিটিয়ে দিলেন না? কেনো তারা নিজেরা বিভক্ত হয়ে দুই সমাবেশে যোগ দিলেন? ইসলামি আন্দোলন খুলনা মহানগরের সভাপতি মাওলানা মোজাম্মিল হক, সহসভাপতি শেখ নাসির উদ্দিন, সজিব মোল্লা, তরিকুল ইসলাম কবিররা একাংশে এবং জেলা আন্দোলনের সভাপতি মাওলানা আবদুল্লাহ ইমরান, সেক্রেটারি হাসান ওবায়দুল করিমরা কেনো অন্যাংশে যোগ দিলেন? এর থেকে কী প্রমাণ হয়? তারা নিজেরাই ব্যক্তিস্বার্থে ছাত্রদের বিভক্ত করে রেখেছেন। একই শহরে বিভক্ত প্রোগ্রাম করতে উৎসাহ যুগিয়েছেন। ইসলামী আন্দোলনের নেতারাই মূলত এই পথ দেখিয়েছেন। এর আগে খুলনার ইসলামি আন্দোলনের নেতারা একই দিনে মহানগর এবং জেলা বিভক্ত হয়ে তরবিয়াতের নামে অভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন।
খুলনা শহরে ছাত্র আন্দোলনের প্রধাণত তিনটি কমিটি আছে, শেখ আমিরুল ইসলাম ও সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে জেলা উত্তর শাখা। আব্বাস আলী ও নোমান শেখের নেতৃত্বে দক্ষিণ শাখা এবং হাসিব গোলদার ও হাসানুজ্জামানের নেতৃত্বে বিএল কলেজ শাখা। এই তিন শাখা যদি এক সাথে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন করতো তবে কি বেশি ভালো হতো না? আর যদি পৃথক করতেই হয় তবে তা কেনো একই দিনে, একই সময়ে, কাছাকাছি জায়গায়? নিজেদের ভেতরে দৈন্যতা এভাবে প্রকাশ না করলে কি হতো না?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে বাংলাদেশের মধ্যে ইসলামী আন্দোলন, যুব আন্দোলন বা ছাত্র আন্দোলনের কমিটিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যে ক’টি শহরে সব চেয়ে বেশি ক্যাচাল, ভেতরগত সমস্যায় জর্জরিত তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে খুলনা। এ বিষয়ে অনেক আগে ইসলামি আন্দোলনের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেছিলেন, ‘খুলনার মাটি ফেতনার ঘাটি’। এর প্রধান কারণ ব্যবসা।
খুলনায় ইশা ছাত্র আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর পৃথক আয়োজন কৌশল ছিলো, বিভেদ নয়
খুলনার ইসলামী আন্দোলনের প্রথম সারির নেতারা সংগঠনকে তাদের ব্যবসায়ীক কাজে ব্যবহার করেন। অধিকাংশ নেতা বিভিন্ন নামে কো-অপারেটিভ খুলে বসেছেন। কেউ কেউ অন্যের প্রতিষ্ঠানে বেতনভুক্ত কাজ করছেন। তাদের প্রধান কাজ হলো সংগঠনকে ভাঙ্গিয়ে, দলীয় পদ-পদবি দেখিয়ে নিজেদের ব্যবসা বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়া। দলীয় কর্মী সমর্থক এবং মুরিদদের ব্যবসার পুঁজি বানানো। এসব করতে গিয়ে তারা দলকে বিভক্ত করে ফেলছেন। দলীয় কমিটিগুলোকে নিজেদের পকেট কমিটিতে পরিণত করছেন। যোগ্য মেধাবী কাউকে সাংগঠনিক ভাবে সামনে আসতে দিচ্ছেন না। মুখ চেনা কয়েকজন নেতা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছেন। নিজেদের ব্যবসায় দলীয় কর্মী সমর্থকদের আকৃষ্ট করতে যতো দূর যা করা সম্ভব সব চেষ্টাই তারা অব্যাহত রেখেছেন। এক্ষেত্রে তাদের কেন্দ্রীয় সংগঠন থেকে কোনো নিয়ন্ত্রণ, নীতিমালা আছে বলে মনে হয় না। বরং অতীতে স্বয়ং দলীয় আমীরকেও তাদের কারো কারো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান উদ্বোধন করতে দেখা গেছে।
তারা অনেক সময় যুক্তি দেখান- দল করতে হলে টাকার দরকার হয়। ইসলামের খেদমত করতে গেলে টাকা দরকার হয়। তাদের যুক্তি হয়তো ঠিক, কিন্তু কখন টাকা দরকার? কিভাবে টাকা দরকার? টাকার উৎস কী হওয়া উচিত, এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যায় না।
এক্ষেত্রে জামায়াতের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, তারাও এক সময় এমন কথা বলতো। টাকা ছাড়া সংগঠন এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয় না, এই যুক্তিতে তাদের নেতাকর্মীরা ব্যাপকভাবে ব্যবসা বাণিজ্যে ঝুকে পড়ে। সংগঠনের নেতারা বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেন। যার ফলে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়, নেতাকর্মীরা ‘বড় লোক’ হয়, কিন্তু সংগঠন দুর্বল হতে থাকে। সাংগঠনিক কাঠামো, নিয়ম শৃংখলায় শীথিলতা দেখা দেয়। যার ধারাবাহিকতায় আজ তারা একটি পতিত সংগঠনে পরিণত হয়েছে।
সংগঠন করতে টাকা দরকার, তাই বলে সংগঠনকে বিক্রি করে নয়। সংগঠনকে ব্যবসার সাইবোর্ড হিসাবে ব্যবহার করে নয়। কোনো সংগঠনের নেতাকর্মীরা যদি ব্যাপক হারে ব্যবসায়ী হয়ে যায় ওই সংগঠন পথ হারাতে বাধ্য হয়। আদর্শ থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। ইতিহাসে এমন অনেক নজির আছে। সুতরাং এসব বিষয়ে কেন্দ্রীয় ইসলামি আন্দোলন বা ছাত্র আন্দোলনের শক্ত নজরদারি থাকা দরকার। নেতার্মীদের জন্য ব্যবসা বাণিজ্য থেকে শুরু করে সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রেও দলীয় নীতিমালা থাকা দরকার। এসব যদি না করা যায় তবে মানুষ ইসলামি আন্দোলনের প্রতি আস্থা রাখতে পারবে না। দিনে দিনে দলীয় নৈরাজ্য বৃদ্ধি পাবে। সংগঠন আদর্শচ্যূত হবে।
দেশের রাজনৈতিক মহল এবং মিডিয়া পাড়ায় একটা কথা চালু আছে, চরমোনাই পন্থীরা ততটুকু রাজনীতি করেন যতোটুকু করলে তাদের ব্যবসা এবং পীর মুরিদির কোনো ক্ষতি হবে না। তারা ততটুকু কথা বলেন যতোটুকু বললে তাদের ব্যবসা বাণিজ্যে কোনো প্রভাব পড়বে না। সুতরাং সংগঠনের কেন্দ্র থেকে যদি শক্ত পদক্ষেপ নেয়া না হয় তবে মানুষ এসব কথাই বিশ্বাস করতে শুরু করবে। যা হবে দেশের ইসলামপন্থীদের জন্য চরম দুর্ভাগ্যজনক।
লেখক: প্রডিউসার, রেডিও বেইস ইতালি
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন