মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব
যিলহজ মাস চারটি সম্মানিত মাসের একটি। ইসলামপূর্ব যুগেও এ চারটি মাসের মর্যাদা ও সম্মান আরবের মুশরিকদের মাঝে বিদ্যমান ছিল। এ মাসগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহ, মারামারি, হানাহানির মতো কোনো অন্যায়-কর্মে লিপ্ত হওয়া অপরাধ মনে করা হত। বিশেষত এ চারটি মাসের মধ্যে যিলহজ মাসকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হত।
যিলহজের আগের একমাস ও পরের একমাসে কোনো ধরণের যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হওয়া অন্যায় মনে করা হত। যাতে হাজীরা দূর-দূরান্ত থেকে নিরাপদে এসে হজ্বের যাবতীয় কাজ সমাধা করে নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরে যেতে পারে।
যিলহজের পুরো মাস গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রথম দশ দিনের গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। এর রয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট ও মর্যাদা। কুরআনে কারিমের সুরায়ে ফজরের শুরুতে আল্লাহ তায়ালা এই দশ রাতের কসম খেয়ে বলেন, কসম ফজরের এবং দশ রাতের’। এর দ্বারা যিলহজের প্রথম দশকের মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রমাণিত হয়।
হাদিস শরিফে আছে, রাসুল সা. ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহতায়ালার কাছে কোনো দিনের আমলই এই দিনগুলোর নেক আমলের চেয়ে প্রিয়তর নয়। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আল্লাহতায়ালার রাস্তায় জিহাদও নয়? উত্তরে বললেন, না আল্লাহতায়ালার রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে হ্যাঁ যদি কোনো ব্যক্তি নিজের জান ও মাল নিয়ে আল্লাহতায়ালার রাস্তায় জিহাদে যান এবং সে কোনো কিছু নিয়ে ফিরে না আসেন।’ (সহিহ বুখারি ১/১৩২, সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৩৮৫৩)
এই দশ দিনের মধ্যে শেষের দুই দিন আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যাকে হাদিসের পরিভাষায় ‘ইয়াওমে আরাফা’ ও ‘ইয়াওমে নাহর’ বলা হয়। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং ১৯০৭৫)
এ ছাড়াও দুটি ইবাদত এ মাসের প্রথম দশককে আরো বৈশিষ্টমণ্ডিত করে তোলে। যে দুটো ইবাদত যিলহজের মাস ছাড়া অন্য কোনো মাসে আদায় করা সম্ভব নয়। এমন কি রমজানে নয়। একটি হলো হজ, অপরটি হলো কুরবানি।
এই মাসে আমাদের কিছু করণীয়
প্রথমত যাদের ওপর হজ ফরজ হয়েছে তাদের জন্য উচিত অযথা ওজর-আপত্তি দেখিয়ে বিলম্ব না করে তাড়াতাড়ি হজ আদায় করে ফেলা। আমাদের সমাজে বিত্তবান আছেন, যাদের ওপর হজ ফরজ হওয়া সত্ত্বেও অহেতুক তা আদায়ে বিলম্ব করে থাকেন। মুসলমান হিসেবে কোনো পুণ্যময় কাজে অবহেলা বা বিলম্ব করা আমাদের জন্য উচিত নয়।
দ্বিতীয়ত কুরবানি আদায় করা। যাদের ওপর কুরবানি ওয়াজিব, তারা তো অবশ্যই কুরবানি আদায় করবেন। এমনকি যাদের ওপর কুরবানি ওয়াজিব নয় তাদের ও কুরবানি করার চেষ্টা করা উচিত। আগ্রহ ও তামান্না থাকলে নিঃস্ব ব্যক্তিকেও আল্লাহতায়ালা সামর্থ্যবান করে দিতে পারেন। বাহ্যিক সামর্থ্য ও আর্থিক স্বচ্ছলতা তো আল্লাহতায়ালারই হাতে। সে কারণেই কুরবানি ওয়াজিব না হলেও কোরবানি করার চেষ্টা করা উচিত।
তৃতীয়ত যিলহজের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানির আগ পর্যন্ত নখ, চুল ও মোচ ইত্যাদি না কাটা। হাদিস শরিফে আছে, হজরত উম্মে সালমা রা. বর্ণিত, রাসুল সা. ইরশাদ করেন, তোমরা যখন যিলহজ মাসের চাঁদ দেখতে পাও আর তোমাদের কেউ কুরবানি করার ইচ্ছা করে তবে সে যেন চুল নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৫৮৯৭)
চর্তথত, এই মাসের প্রথম দশক যেহেতু বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাশীল এবং এ সময়ের আমল আল্লাহতায়ালার কাছে প্রিয় ও গ্রহণীয় তাই এই দশকে বেশি বেশি নেক আমল করা উচিত। বিশেষত নফল নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত, জিকির-আযকার, দান-খয়রাত ইত্যাদি বেশি করা উচিত। যিলহজ্বের প্রথম দশকের রোজা রাখার বিশেষ ফজিলত হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে। রাসুল সা. যিলহজের প্রথম নয় দিন (ঈদের দিন ছাড়া) রোজা রাখতেন। তবে এই দশকের নবম দিনটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই দিন রোজা রাখার গুরুত্ব ও বেশি। হাদিস শরিফে আছে, রাসুল সা. বলেন, ‘আরাফার দিনের (নয় তারিখের) রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহতায়ালার কাছে আশাবাদী যে, তিনি এর দ্বারা বিগত এক বছর ও আগামী এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন’।
পঞ্চমত, ৯ যিলহজের ফজর থেকে ১৩ই যিলহজের আসর পর্যন্ত প্রতি ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তাকশরিক বলা প্রত্যেকের জন্য ওয়াজিব। তাকবিরে তাশরিক হলো, “আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার অলিল্লাহিল হামদ”। নামাজ একাকি পড়া হোক বা জামাতের সাথে, পুরুষ মহিলা প্রত্যেকের ওপর একবার এ তাকবীরটি বলা ওয়াজিব। পুরুষরা উচ্চস্বরে আর নারীরা অনুচ্চস্বরে বলবে।
লেখক: সম্পাদক আল হেরা