শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


বন্যার্তদের সাহায্য করুন তবে কুরবানি যেন মতলববাজদের ফতোয়ার নিচে না পড়ে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা মাহমুদ হাসান সিরাজী
প্রিন্সিপাল, জামিয়া ওসমান ইবনে আফফান রা.

গতকাল সন্ধার পর গিয়েছিলাম বাইতুল মোকাররমে।বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আইনুদ্দীন আজাদ রহ. প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ভাবধারার জাতীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন কলরবের একটি চমৎকার ও সৃজনশীল উদ্দোগ চোখে পড়ে। তারা পিকাপভ্যান ভাড়া করে সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সাহায্য উঠাচ্ছে। তাদের এ সৃজনশীল কর্ম তৎপরতাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই।

বন্যার্তদের সাহায্যের উদ্দেশে কলরব একটি সঙ্গীত সন্ধ্যারও আয়োজন করেছে। যার থেকে প্রাপ্ত টাকা দেয়া হবে বন্যার্তদের সেবায়।

হাল আমলে তাদের নিজস্ব মতবিরোধের কারণে কলরব অনেকটা আলোচিত সমালোচিত হলেও সংগঠনের অর্জন কিন্তু অনেক। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তারা অনেক শ্রোতা টানতে পেরেছে। শ্রোতাদের চাহিদা পূরণ করে তাদের মন জয় করা অনেক সংগীত উপহার দিতে পেরেছে। ইদানিং বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে তাদের মানববন্ধনসহ নানান কর্মসূচি দিতেও দেখা গেছে।

বিভিন্ন জায়গায় খবর নিয়ে জানতে পারলাম ইসলামি রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক অনেক সংগঠনই অনেক কার্যকরী ও ফলপ্রসু বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

আসলে অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো ইসলামের নৈতিক অনেক বড় একটি শিক্ষা। ইসলামি শিক্ষায় আলোকিত মানুষগুলো কখনো সে শিক্ষা থেকে পিছপা হয় না। নিজের সবটা দিয়ে তাদের পাশে দাড়াতে চেষ্টা করে। এসব অসহায়- অনাথদের জন্য জাকাত ফিতরার পাশাপাশি সদকায়ে জারিয়ার মত সমাজ সেবামূলক ইবাদতেরও ব্যবস্থা ইসলামে রয়েছে। তাদের জন্য অফেরৎযোগ্য ও নিঃসার্থ অনুদানের ব্যাপারেও ইসলামে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা রয়েছে।

তবে এবারের বন্যা পরিস্থিতি অনেকটা ভয়াবহ হওয়ায় অনেকেই সে দিকে মনোদৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছেন। নিজ দেশে এতবড় ভয়াবহ বন্যায় আশ্রিতদের পাশে দাঁড়াতে সবায় এক সাথে ঝাপিয়ে পড়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এটা নিঃসন্দেহে অনেক ভাল দিক। এটা প্রশংসার দাবীদার একথা অস্বিকার করা যাবে না।

যে যে অবস্থান থেকে যেভাবেই বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন সবায়কেই আন্তরিক মোবারকবাদ জানাচ্ছি।

তবে গতকাল মাগরিবের পরে বাসা থেকে যখন বের হব তখন আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, কুরবানির না করে এর টাকা বন্যার্তদের মাঝে পাঠিয়ে দিলে কোনো অসুবিধা হবে কি না? বুঝতে পারলাম পাশের বাসার তার ভাবি+ বান্ধবী হয়তো মাসআলাটি জানতে চেয়েছে।

এসে জানাবো বলে বাসা থেকে নিচে নামছি আর চিন্তা করতেছি। দেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়েও অনেক ভাবতেছি। বার বার উত্তরবঙ্গের চিত্রগুলো সামনে চলে আসতে লাগল।

তার প্রশ্নটিকে অমূলক মনে হল না। অনেকেই হয়তো এ বিষয়টি নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যেতে পারে। অনেকে নিজেদের উপর ওয়াজিব কুরবানি না করে এর সমুদয় অর্থ পাঠিয়ে দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতেও পারে। আবার আমরা হুজুগে বাঙ্গালী বলে কথা!

রাস্তায় একদল বন্ধু-বান্ধবদের সাথে এক জায়গায় চা খেতে বসলাম। তারা জেনারেল শিক্ষিত হলেও অনেক চৌকস। অনেকটা জাগ্রত বিবেকসম্পন্ন। তাদের সামনেও বিষয়টি আলোচনায় তুল্লাম। তাদের একজন তো বলেই ফেলল, কে কখন তার কুরবানির টাকাটা বন্যার্তদের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছে। এটা আবার মিডিয়াতেও প্রচার হচ্ছে। তাদের কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে আরো অনেকেই যেন তাদের কুরবানির টাকাটা বন্যার্তদের জন্য পাঠিয়ে দেয়।

তাদের ব্যক্তিগত মতামত নিলাম। এ ব্যাপারে তাদের মূল্যায়নটি বুঝার চেষ্টা করলাম। তারা তাদের সাদা চোখে বিবেক দ্বারা মূল্যায়ন করল। তাদের ভাষ্য হল, কুরবানি ওয়াজিব ইবাদত। তাও শর্ত সাপেক্ষে ওয়াজিব হয়। সবার উপর আবার সব সময় হয়ও না। আর ঐটা কুরবানির পর্যায়ে আসার কথাও নয়। এটা ভিন্ন ইবাদত ঠিক আছে। তাই কুরবানির সমমানের নয়। একে কুরবানির সঙ্গে মেলানো ঠিক হবে বলে মনে হয় না।

তাদের মূল্যায়নে মুগ্ধ হলাম। তাদের জাগ্রত বিবেক দেখে বিমোহিত হলাম।

আলহামদুলিল্লাহ্‌ এ দেশের মানুষ এখন অনেক সচেতন হয়েছে। এরা ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যাটা জানতে চায়। সে অনুযায়ী আমল করতে সচেষ্ট হয়।। মতলববাজদের প্রতারণামূলক ফতোয়াবাজী এদের টলাতে পারে না। এ দেশে ধর্মের নামে অধর্ম প্রচার করে টিকে থাকা সম্ভব নয়। ভালো মন্দের মাঝে পার্থক্য করার মত জ্ঞান বুদ্ধী এদের রয়েছে।

আমিও অফিসে এসে মাসআলাটি দেখলাম। দেশের শীর্ষস্থানীয় নির্ভরযোগ্য আরো দু চারটি ফতোয়া বিভাগে ফোন করে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলাম। মাসআলাটি জেনে নিতে সক্ষম হলাম। নিজের জানা, দেখা ও জেনে নেওয়া সবকিছু এক হয়ে গেল। কুরবানি ওয়াজিব ইবাদত। শর্তসাপেক্ষে বান্দার উপর ওয়াজিব হয়। শর্ত পাওয়া না গেলে ওয়াজিব হবে না। বান্দা নিজের উপর ওয়াজিব করে নিলে কুরবানি না করে উপায় নেই।

সুতরাং আমরা বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াবো। তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসবো। এটা আমাদের মানবীয় ও ধর্মীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য। তবে যাদের উপর কুরবানি ওয়াজিব তারা কুরবানি না করে টাকাটা ওইখানে পাঠিয়ে দেওয়া সমুচিত হবে না।

ইচ্ছা করলে কুরবানির বাজেট কমিয়ে এর বিশেষ একটা অংশ তাদের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এতে নিজের ওয়াজিবটাও আদায় হবে আবার তাদের পাশেও দাঁড়ানো সম্ভব হবে। লক্ষ টাকা দিয়ে গরু কিনে অনেক হাক ডাক করে পারা প্রতিবেশীকে জাগিয়ে কুরবানি করাকে কুরবানি বলা হয় না। এটা লৌকিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কুরবানির পশুর সাথে নিজের ভেতরের পশুটাও জবেহ করতে হবে।

আর কুরবানির টাকাটা ঐখানে এভাবে না পাঠিয়ে নিজেই দু একদিনের জন্য বন্যাকবলিত এলাকায় চলে যান না! দেখে শুনে গরু কিনে ওইখানে কুরবানি দিয়ে এর গোস্তটা তাদের মাঝে বিলিয়ে দিন। সাথে কয়েক বস্তা চাল ডালও বিতরণ করতে পারেন।

আমাদের একটু সদিচ্ছা থাকলে আমরা আরো অনেক পদক্ষেপ নিতে পারি। বর্তমানে দেশের ১৩ কোটি ৩১ লক্ষ ১৪ হাজার ২ শত ৬ জনের মত মোবাইল ব্যবহার করে। প্রত্যেক গ্রাহক থেকে ১০ টাকা করে নিলেও কিন্তু অনেক বড় একটা ফান্ড করা যায়। এ রাজধানীতে সমাজ ও চরিত্র বিদ্ধংশী বার আছে কতগুলো? ওইসব বারে যাতায়াতকারীদের থেকে একদিনের অর্থ কেটে নিলেও তো অনেক মোটা অংকের একটা টাকা আসে। সরকারি বেসরকারি কর্মচারীদের একদিনের বেতন দিয়ে দিলেও এমন একটা বন্যামৌসুম সামাল দেওয়া যায়। পরিবহনগুলো থেকেও মোটা দাগের একটা কালেকশন করা যায়।

কুরবানির খাতবাদ দিয়েও আরো অনেকভাবে তাদের পাশে দাঁড়ানো যায়।

অতএব, কুরবানি না করে এর অর্থ ওইখানে পাঠানোর ব্যাপারে প্রচার করা এটা কুরবানির বিরুদ্ধে ঠাণ্ডা মাথার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। ভাল কাজ করতে গিয়ে ষড়যন্ত্র পা দেওয়া যাবে না।

আল্লাহ কুরবানিকে সমুন্নত রেখে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর তাওফিক দান করুন।

‘যারা ‍কুরবানি না দিয়ে বন্যার্তদের সাহায্য করতে বলছে তাদের মতলব ভালো না’

কুরবানির অনিচ্ছাকে দমন করে কুরবানি দেয়াই কুরবানির শিক্ষা


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ