আওয়ার ইসলাম : প্রতিবছর আমাদের দেশ থেকে বেশ কিছুসংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসলমান সৌদি আরবে যান পবিত্র হজব্রত পালনের জন্য। হজে যাওয়া আর বিদেশ ভ্রমণের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। কারণ, ভ্রমণের সময় থাকা-খাওয়া-বেড়ানো ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। কিন্তু হজের সময় নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে বেশ কিছু ধর্মীয় কর্তব্য পালন করতে হয়।
যে বয়সেই হজ করতে যান না কেন, যদি শরীর সুস্থ না থাকে, তাহলে ইবাদত করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। এমনকি কিছু কিছু ফরজ কাজও বাদ পড়ে যেতে পারে। সুতরাং, যাত্রার আগেই চিন্তা করে নেবেন কীভাবে যতটা সম্ভব সুস্থ থাকবেন। এ ব্যাপারে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
অতিরিক্ত আহার : এ সময় প্রচুর হাঁটাহাঁটি ও ইবাদত করতে হয়। ভিড়ের সময় কাবা শরিফের কাছাকাছি রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। ইচ্ছা করলেই গাড়িতে যাতায়াত করা যায় না। ফলে ক্যালরি ব্যয় হয় প্রচুর। এসব কারণে অনেকেই বেশি বেশি খেয়ে থাকেন দেহে শক্তি সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে। কিন্তু দেখা যায়, শক্তি লাভের পরিবর্তে অতিভোজন বদহজমের সৃষ্টি করে, যা সত্যিই একটা যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার। কারণ, পাকস্থলি যতখানি খাবার পরিপাক করতে পারে, তার বেশি হলেই বদহজম হয়ে থাকে। এতে পেট ফাঁপা, ডায়রিয়া, বমি, মাথাব্যথা, পেটে ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। ফলে নির্বিঘ্নে ইবাদত করা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং, খাবার চাহিদার তুলনায় কিছু বেশি হবে, তবে অতিরিক্ত নয়।
স্বল্প আহার : অনেকে এতই কম খান যে, শরীরের স্বাভাবিক সার্মথ্যটুকুও হারিয়ে ফেলেন। হজের ব্যাপারটি এক-দুই দিনের নয়। টানা ২০-৪০ দিন পর্যন্তও মানুষকে ব্যস্ত থাকতে হয়। এসব বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ক্যালরিযুক্ত খাবার অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। যাদের ভাত-রুটি কম খাওয়ার অভ্যাস, তারা মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল অর্থাৎ, আমিষজাতীয় খাদ্য একটু বেশি খাবেন। অপর্যাপ্ত আহারের ফলে দুর্বলতা, ক্লান্তি, মাথা ঘোরা, শারীরিক ও মানসিক অবসাদ দেখা দেয়। এর ফলে কোনো কাজেই শক্তি ও উৎসাহ পাওয়া যায় না।
হজের সময় দীর্ঘপথ হাঁটা, তাওয়াফ (সাতবার কাবা শরিফ প্রদক্ষিণ), সায়ি (সাফা থেকে মারওয়া সাতবার দৌড়ানো), সালাত ইত্যাদি সঠিকভাবে পালন করার জন্য শরীরে শক্তি থাকা একান্ত জরুরি। এদিকে মদিনা শরিফে মসজিদে নববিতে ৪০ রাকাত নামাজ আদায় করতে পারলে আল্লাহ তাআলার অশেষ রহমত পাওয়া সম্ভব হয়। সুতরাং, ওই সুযোগ কেউই ছাড়তে চান না।
অনেক সময় দেখা যায়, কোনো কোনো হজ এজেন্সি সকালের নাশতার ব্যবস্থা রাখে না। এর ফলে মক্কা-মদিনায় গিয়ে হাজিরা বেশ বিপাকে পড়ে যান। অনেকে পয়সা খরচ করে বাইরে খেতে চান না অথবা খুব কম খান। আবার অনেকে ভেবে পান না কী আহার করবেন, কোথায় করবেন।
এমনও দেখা যায়, অনেকে সকালে না খেয়ে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করেন প্রদত্ত খাবারের জন্য। আবার দেখা যায়, খাবার পছন্দ না হলে অনেকে খেতে চান না বা কম খান। এসব কারণে দেহে ক্যালরির ঘাটতি প্রকট হয়ে দেখা দেয়।
বাসি খাবার : কোনোক্রমেই বাসি খাবার খাওয়া উচিত নয়। অনেক সময় বাসি খাবারে গন্ধ না হলেও জীবাণুর বিস্তার ঘটে থাকে এবং এটা শরীরে গিয়ে ধীরে ধীরে সংক্রমিত হয়। এ ধরনের খাবারে পেটে গ্যাস, পেটব্যথা, মাথাব্যথা, বমি, পাতলা পায়খানা ইত্যাদি হতে পারে।
পানি : হজের সময় প্রচুর পানি, ফলের রস, দুধ, যে কোনো শক্তিদায়ক পানীয় পান করা উচিত। কারণ, অত্যধিক পরিশ্রম এবং গরম ও শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে দেহে পানিস্বল্পতা হতে পারে। প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন লিটার পানি বা পানীয় গ্রহণ করতে হবে। পানি দেহের জলীয় ভারসাম্য ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
অসুস্থতা : জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে মানুষ যেমন ফরজ আদায় করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন, তেমনি এ সময় বার্ধক্যজনিত অথবা যে কোনো ধরনের রোগেও আক্রান্ত হতে পারেন। ধর্মপ্রাণ মুসলমান এরপরও আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে ছুটে যান মক্কা-মদিনা, মিনা-আরাফাত প্রান্তরে। তবে অসুস্থতা যা-ই থাকুক না কেন, প্রত্যেক মানুষকেই নিজ নিজ শরীর সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। সঙ্গে রাখতে হবে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র, প্রয়োজনীয় ওষুধ, পানি ও খাবার। কারণ, হাজীরা কখন কোথায় অবস্থান করবেন তার কোনো ঠিক নেই।
এ ছাড়া সে দেশের আনুষঙ্গিকতার জন্য অনেক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে অবস্থান করতে হয়, সে ক্ষেত্রে সঙ্গে থাকা খাবার খেয়ে শরীর সুস্থ রাখাটা জরুরি। সঙ্গে রাখতে পারেন কেক, বিস্কুট, কলা, আপেল, নাশপাতি, খেজুর, বাদাম, আলু বোখারা, কিশমিশ, শুকনা মিষ্টি, জুস, দুধ। এসব খাবারে সহজেই অধিক ক্যালরি পাওয়া সম্ভব। যাদের ডায়াবেটিস আছে, তারা সঙ্গে রাখতে পারেন চিড়াভাজা, মুড়ি, ভুট্টার খই, ডায়াবেটিক বিস্কুট, দুধ ইত্যাদি। হাইপোগ্লাইসেমিয়ার আশংকা থাকলে সঙ্গে জুস রাখতে পারেন। মদিনায় বাঙালিদের অবস্থান যেখানে, সেখানে মুড়িসহ বাংলাদেশের অনেক খাদ্যপণ্য পাওয়া যায়।
ডায়াবেটিসে যেহেতু প্রতি তিন ঘণ্টা পরপর খাবার খেতে হয়, তাই দেরি না করে সময়মতো খেয়ে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ। এতে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার (রক্তশর্করা স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নেমে যাওয়া) হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। ডায়াবেটিস গাইড বইটি সঙ্গে রাখা একান্ত জরুরি। এতে যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র, খাদ্যতালিকা সবই রয়েছে। হজে যাওয়ার সময় ইনসুলিন (যদি প্রয়োজন থাকে) এবং ডায়াবেটিসের মুখে খাওয়ার বড়ি যা-ই ব্যবহার করেন না কেন, হিসাব করে কিছু বেশি পরিমাণে নিতে হবে। কারণ, এগুলো শেষ হয়ে গেলে বিপদে পড়তে হবে। এ ছাড়া গ্লুকোমিটার (রক্তশর্করা মাপার যন্ত্র), রক্তচাপ মাপার যন্ত্র, থার্মোমিটার সঙ্গে নিতে হবে।
হৃদেরাগী ও উচ্চরক্তচাপের রোগীদের সময়মতো ওষুধ সেবন করা জরুরি। এ ছাড়া তাদের চলাফেরা ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। জমাট চর্বি বাদ দেয়ার পরও এমন কোনো খাবার খাওয়া উচিত নয়, যাতে অস্বস্তি বোধ হয় এবং পেটে গ্যাস হয়। যেমন, খুব বেশি মশলাযুক্ত মাংস, আঁশযুক্ত সবজি ও ডুবোতেলে ভাজা খাবার খাওয়া। উট, দুম্বা, গরু, খাসির মধ্যে উটের মাংসে চর্বির আনুপাতিক হার কম। সুতরাং, তারা উটের মাংস অনায়াসে খেতে পারেন। তাদের খাসি ও দুম্বার মাংস পরিহার করা উচিত।
বড় ধরনের অসুস্থতা ছাড়াও হজের সময় যতটা সম্ভব সতর্ক থাকতে হবে, যাতে অন্যান্য ছোটখাটো অসুখে আক্রান্ত না হন। এতেও ইবাদতে বিঘ্ন ঘটতে পারে। যেমন- জ্বর, সর্দিকাশি, পেট খারাপ, পেটব্যথা, বমি, মাথাব্যথা, গা-ব্যথা, অ্যালার্জিজনিত চুলকানি ইত্যাদি। যেহেতু প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে অনেক লোকের সঙ্গে চলাফেরা, ওঠাবসা, খাওয়া, প্রার্থনা করতে হয়; সে জন্য শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষ সহজেই সংক্রমণজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এ জন্য মাস্ক ব্যবহার করলে ভালো হয়।
-এজেড