ইমরান আনোয়ার
আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়। জগদ্বিখ্যাত জ্ঞানের রাজদূত ও শতসহস্র বিদ্বানের আঁতুড়ঘর। মিশরকে চেনে না এমন কে আছে; 'আজহার'কে না চেনার মানুষও অঢেল নয়! সহজভাবে বলি; জ্ঞানের আধারে যাদের বিচরণ, সে জ্ঞান হোক জগত-সংসার অথবা পরকালীন শান্তি-সমৃদ্ধির নিগুঢ় শিক্ষা, জ্ঞানের তরুলতা-শাখায় বিচরণকারী প্রতিটি সন্ধানী প্রাণ আজহার-এর প্রেমে মুগ্ধ।
৯৭০ অথবা ৭২ সনে বৃহৎ ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে আল-আজহার প্রতিষ্ঠিত হয়। কুরআন এবং ইসলামী আইনশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, তর্কশাস্ত্র, পদার্থ, রসায়ন, বিজ্ঞান, প্রকৌশল, চিকিৎসাশাস্ত্র, এবং চন্দ্রকলাসহ প্রয়োজনীয় সকল বিভাগে এখানকার শিক্ষার্থীরা অধ্যয়নের সুযোগ পান।
দেশ-বিদেশের চার লক্ষাধিক শিক্ষার্থী এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের স্বপ্নের গোড়াপত্তন করেন। তার মাঝে রয়েছে বাংলাদেশের আকুল জ্ঞান-অনুসন্ধানকারীরাও। বহুকাল ধরে এ খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা-সংস্কৃতির সঙ্গে জুড়ে আছেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। ইচ্ছা, অধ্যাবসায়, কিছু করে দেখানোর প্রতিজ্ঞা- এমন অবিচল আকাঙ্ক্ষাগুলো তাদের ভিনদেশি অনেক ছাত্রের চেয়ে মর্যাদাবান করে তুলেছে। কখনো সে সম্মান সবাইকে বিমূঢ় করে দিয়েছে। আজ তেমনই এক গৌরবময় ইতিহাস রচনাকারী মেধাবী শিক্ষার্থীর পরিচয় আপনাদের সামনে তুলে ধরব।
প্রায় বাইশ হাজার বিদেশি ছাত্রের কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে জয় করে সেরা ১০ জনের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন বাংলাদেশি দুইজন। ১ম জন শরিফ আব্দুল বাসেত ৭ম স্থান অর্জন করেন, ২য় জন ইকবাল হোসাইন পেয়েছেন ৬ষ্ট স্থান। আজ শুনুন শরিফ আব্দুল বাসেতের গল্প।
পরিচয় ও শিক্ষাসনদ
শরিফ আব্দুল বাসেত। পিতা ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল বাসেত ভুঁইয়া। নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার দড়িগাঁও গ্রামে তার জন্ম। আট ভাইবোনের মধ্যে পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান তিনি। বর্তমানে নরসিংদী সদরের পূর্ব দত্তপাড়ার পারিবারিক আবাসস্থলই তার মূল ঠিকানা। পড়াশোনায় হাতেখড়ি হয় নিজ জেলা নরসিংদীতেই। দারুল উলুম দত্তপাড়া মাদরাসা ও আরেকটি ভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে তিনি প্রাথমিক মক্তব ও কুরআন হিফজ সম্পন্ন করেন। অতঃপর নবীন স্বপ্নের হাত ধরে পথচলা শুরু হয়ে। ধর্মীয় জ্ঞান ও জাগতিক শিক্ষার অতুলনীয় মেলবন্ধন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রখ্যাত জামিয়া দারুল আরকাম আল-ইসলামিয়া'তে ভর্তি হন ২০০৩/৪ মৌসুমে। সেখানে নিজেকে গড়ার প্রস্তুতিতে গভীর মনোনিবেশ করেন। অনুঘটক হিসেবে সবটুকু শ্রম ও পৃষ্ঠপোষকতা বরণ করে নেন প্রিয় উস্তাদদের কাছ থেকে। টানা আটটি বছর মাদরাসার সকল বিধি-বিধান ও শিক্ষা-উপকরণে নিজেকে অগ্রণী হিসেবে নিয়োজিত রাখেন এ সহজাত প্রতিভাধর ছাত্র। অতঃপর ২০১০/১১ইং মৌসুমে এগিয়ে আসে সেই মাহেন্দ্রাক্ষণ! "ওয়াবিহি কালা হাদ্দাসানা'র বিমুঢ় সুরে ঋদ্ধ হয়ে বছর শেষে পরম কৃতিত্বের সঙ্গে 'তাকমিল'-এর সনদ লাভ করেন।
অনুপ্রেরণা লাভ
স্বপ্ন ও সম্ভাবনার বিস্ময়কর প্রেরণাদায়ী প্রতিষ্ঠান জামিয়া দারুল আরকাম আল-ইসলামিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। প্রতিটি ছাত্র এখানে নিজেদের আলাদাভাবে চিনতে শেখে। জগতে জ্ঞানের আলোকে ব্যাতিক্রমীভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয় প্রতিজন। সেকারণেই দেখা যায়, এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রবৃন্দ পৃথিবীর সুবিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোতে কৃতিত্বের সঙ্গে অধ্যয়ন করে যাচ্ছেন। ধর্মীয় ও জাগতিক জ্ঞান- সব শাখাতেই তাদের অবাধ বিচরণ রয়েছে। এমনই একদল মেধাবী শিক্ষার্থীকে বুকে টেনে নিয়েছে কল্যাণীয়েষু জামিয়া আজহার। তারা দারুল আরকামের গর্বের সন্তান। এ সৌভাগ্যবান জ্ঞানের অতিথি দলে নাম লেখাতে তীব্র ইচ্ছাশক্তি নিয়ে শরিফ পাড়ি জমান মিশরের কায়রো শহরে। ২০১২'র জুলাই মাসে তিনি শিক্ষাজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবকাশটুকু পেয়ে যান। ইউনিভার্সিটি-পূর্ব যোগ্যতা-নির্ধারণী স্তর 'তাহদীদে মুস্তাওয়া'র জন্য তিনি জামিয়া আজহারে আবেদন করেন। এবং পরম করুণাময়ের অশেষ ইচ্ছাতে তার আবেদন গৃহীত হয়।
যেভাবে জামিয়া আজহারে ভর্তি হলেন
সাধারণত জামিয়া (ইউনিভার্সিটি) লেভেলে উপনীত হওয়ার জন্য -যাদের মুআদালা করার সুযোগ নেই- আজহারের তিনটি বাধ্যতামূলক মারহালা (স্তর) রয়েছে। শাফাওয়ি, ই'দাদি, ছানাভি; এ তিন স্তরে ছাত্রদের মেধা, শ্রম, এবং কার্যকর পদক্ষেপ তাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন ফল এনে দেয়। কারো জন্য তিন বছর, কেউবা এক বছরে, আর কেউ হয়তো তারচেয়ে কম সময়ে এ মারহালাতে নিজেকে যোগ্য হিসেবে প্রমাণ করেন। সবশেষে জায়গা করে নেন স্বপ্নের ইউনিভার্সিটিতে। আমাদের শরিফের সময় লেগেছে এক শিক্ষাবর্ষ।
পৃথিবীতে শতসহস্র শিক্ষানুরাগীর আজন্ম অভিপ্রায় হল জামিয়া আজহারে পাঠ লাভ করা। ঐতিহ্য ও মান বিবেচনায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন সর্বজনস্বীকৃত। তাই যে কোনো শ্রেণী-বিভাগের সাধারণ ভর্তি পরীক্ষায় এখানে প্রচুর ছাত্র সমাগম হয়। সঙ্গত কারণেই শরিফদের মাধ্যমিক স্তরের জন্য আবেদনকৃত ছাত্র-সংখ্যা ছিল ভড়কে যাবার মত! মোট তিন হাজার ছাত্রের বিপুল উপস্থিতিতে তাহদীদে মুস্তাওয়ার (মান নির্ধারণী) সর্বেশেষ পরীক্ষায় ১৫০ জনের তালিকায় নিবন্ধিত হন মাওলানা শরিফ। অতঃপর বিশেষ প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি সেরে ২০১৩'র জুনে চূড়ান্ত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। সকল বিদেশি ছাত্রছাত্রীর সমন্বয়ে এ পরীক্ষায় অংশ নেয় প্রায় ১৮০০ শিক্ষার্থী। এখানে নিজের যোগ্যতা ও পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখে মেধা তালিকার ৬ষ্ঠ স্থানটি দখল করে নেন। হাতেনাতে পুরষ্কারও পেয়ে যান। ইউনিভার্সিটির প্রথাগত বিধান এড়িয়ে এক বছর পূর্বেই সেখানে স্কলারশিপ নিয়ে জামিয়া আজহারে পদার্পণ করেন। আল-আজহারের গ্র্যান্ড ইমাম-এর বদান্যতায় স্কলারশিপ লাভে ধন্য হন তারা। পরবর্তীতে ভর্তি হন চার বছর মেয়াদি স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রীর "শরিয়া ও আইন" ফ্যাকাল্টির "শরিয়া" বিভাগে। মৌসুমটি ছিল ২০১৩/১৪। প্রতি বছরই ফাইনাল পরীক্ষায় নিজের সুনাম ও কৃতিত্ব বজায় রাখেন। "জায়্যিদ জিদ্দাহ" বা 'ভীষণ ভালো' ফলাফলের মাধ্যমে আজহারের সেরা বিদেশি ছাত্রদের অন্তর্ভুক্ত হন মেধাবী শরিফ আব্দুল বাসেত।
তবে চমকের শেষ প্রলেপ তখনো বাকি ছিল। দীর্ঘ চার বছরের মেহনত, সফলতা ও প্রত্যাশাকে পুঁজি করে সম্মান শেষ বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন শরিফ। জীবন ও জীবিকার নিষ্ঠুর গতিপথে এ পরীক্ষার ফলাফল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তাই সফলতার মসৃণ প্রদর্শনে এগিয়ে চলা সত্ত্বেও আর সবার মত তিনিও এ পরীক্ষায় কিছুটা শঙ্কিত ছিলেন। অতীতের অভূতপূর্ব ফলাফলের কারণে নিজের দায়বদ্ধতার প্রতি যেন আরো বেশি আটকে ছিল মন! তবে শেষ পর্যন্ত খোদার করুণা তার দিকে চেয়ে মুচকি হেসেছে। পেছনের মুগ্ধ করা নিয়মিত সাফল্যকে আরো বেশি রঙ্গিন করে এবারের ফলাফলে হাজারো শুভানুধ্যায়ীকে তাক লাগিয়ে দেন। প্রায় বাইশ হাজার বিদেশি ছাত্রের কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে জয় করে সেরা ১০ জনের তালিকায় জায়গা করে নেন তিনি। যেটিকে তিনি বলছেন- "আল্লাহর অশেষ দান"। অবশ্যই আল্লাহর রহমত ব্যতিত এমন নজিরবিহীন ফলাফল কারো পক্ষে সম্ভব নয়!
যেখানে সফলতা, সেখানে প্রাপ্তির হিসেবনিকেশও থাকে। জামিয়া'র গ্র্যান্ড ইমাম-এর পক্ষ থেকে আগেই ঘোষণা ছিল, পুরো ইউনিভার্সিটির সেরা দশজন বিদেশি ছাত্রকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে হজ্ব পালনের সুযোগ করে দিবেন। সাথে থাকবে অন্যান্য পুরস্কার। ঘোষিত সকল সমাদরই এসেছে সফলতার স্রোতে ভেসে। আজ তিনি নিজের ও প্রিয় দেশ বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করে স্রষ্টার অসীম অনুগ্রহের শুকরিয়া আদায়ে পবিত্র বাইতুল্লাহ জিয়ারাতের প্রহর গুনছেন।