বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


ঢাকায় দিনে ৫০-৬০ দম্পতির তালাকের আবেদন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

দিন দিন বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা বাড়ছেই। সামাজিক অস্থিরতা, প্রগতিশীলতার নামে নারী স্বাধীনতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক-ব্লগ-টুইটারে আসক্তি, পর পুরুষের প্রতি নারীর আসক্তি, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়, ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি কারণে এ বিচ্ছেদ ঘটছে। এই বিচ্ছেদে পুরুষের চেয়ে নারীরাই এগিয়ে। আর শিক্ষিত কর্মজীবী নারীরাও বিবাহ-বিচ্ছেদে এগিয়ে রয়েছেন।

দৈনিক মানবজমিনের একটি রিপোর্টে বলা হয়, জরিপে দেখা গেছে ৭০ দশমিক ৮৫ ভাগ নারী এবং ২৯ দশমিক ১৫ ভাগ তালাক দিচ্ছেন পুরুষরা। কিন্তু কেন এত বিচ্ছেদ ? কেন ভাঙছে সুখের সংসার?

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, সামাজিক অস্থিরতা, যৌতুক দাবি, নির্যাতন, তথ্যপ্রযুক্তি ও আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, পারিবারিক কলহ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মাদকাসক্তি, পরকীয়া, সন্দেহ প্রবণতা, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে না চলা, নারীর পুরুষ নির্ভরশীলতা কমা, নারীর আত্মমর্যাদা বৃদ্ধিসহ নানা কারণে বিচ্ছেদ ঘটছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদ নাসির বলেন, এক কথায় বলতে গেলে টলারেন্সের অভাব ও প্রতিযোগিতামূলক আধুনিক সমাজ। অল্প সময়ে অনেক কিছুই আমাদের অর্জন করতে হবে। আর এই অল্প সময়ে অনেক কিছু করতে গেলেই সমস্যার সৃষ্টি হয়।

তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হলো সামাজিক বন্ধন যেখানে মানিয়ে নেয়া পরস্পরকে বুঝা ও একটা আস্থা বা বিশ্বাসের অভাব। এই জায়গাটিতে ঘাটতি আছে। সমাজের মানুষের চাহিদা বেড়ে গেছে। গ্রাম, শহর, বস্তি যেখানে যে আছে তার চাহিদা বেড়ে গেছে। যা আজ থেকে আরো বিশ বছর আগে ছিল না। প্রতিযোগিতামূলক সমাজে স্যাটেলাইটের প্রভাবে সবাই ভালো মন্দ সুবিধা অসুবিধা বুঝতে পারছে। এবং কোনো না কোনো ভাবে সেটা অর্জন করার চেষ্টা করছে। যার দরুন ধৈর্য এবং পরিবারের প্রতি সম্মান কমে যাচ্ছে। এই কারণেই বিবাহ বিচ্ছেদগুলো ঘটছে। এটি মোকাবিলায় পুরাতন পারিবারিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ পরিবারকে টিকিয়ে রাখতে হলে পারিবারিক মূল্যবোধ খুবই জরুরি। কিন্তু বর্তমান সমাজের প্রেক্ষিতে সেটা খুবই কঠিন।

ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণ ও উত্তরের সকল অঞ্চলের তথ্যানুযায়ী, ২০১০-২০১৬ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে তালাকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫২ হাজার। গতবছর ছিল সাড়ে ৬ হাজার। যা ২০১৫ সালে ছিল প্রায় ৯ হাজার। এর আগে ২০১৪ সালে ৮ হাজার ২১৫টি, ২০১৩ সালে ৮ হাজার ২১৪, ২০১২ সালে ৭ হাজার ৯৯৫, ২০১১ সালে বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে ৫ হাজার ৩২২ এবং ২০১০ সালে বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার।

প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০টির মতো বিচ্ছেদের আবেদন জমা হচ্ছে। প্রতিবছরই আগের বছরের তুলনায় বাড়ছে এই সংখ্যা। বর্তমানে রাজধানীতেই নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে ৪৯ হাজার বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন।

ঢাকা শহরের চেয়ে সারাদেশে এই চিত্র আরো ভয়াবহ। কেবল ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকাতেই প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০টির মতো বিচ্ছেদের আবেদন জমা হচ্ছে। শুধু শহরে নয় সারাদেশে এই ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। আর এই বিচ্ছেদে পুরুষের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন নারীরা। এক জরিপে দেখা গেছে ৭০ দশমিক ৮৫ ভাগ নারী এবং ২৯ দশমিক ১৫ ভাগ তালাক দিচ্ছেন পুরুষরা। বিবাহ ও বিচ্ছেদ নিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন গবেষণা তথ্য থেকে জানা যায়, ইতিমধ্যে নিষ্পত্তি হওয়া ৮৭ শতাংশ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে পরকীয়ার জের ধরে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০০ সালে ঢাকা শহরে মোট ডিভোর্স নোটিশের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭৫৩টি, ২০০১ সালে ২ হাজার ৯১৬টি, ২০০২ সালে ৩ হাজার ৭৩টি, ২০০৩ সালে ৩ হাজার ২০২টি, ২০০৪ সালে ৩ হাজার ৩৩৮টি, ২০০৫ সালে ৫ হাজার ৫২৫টি, ২০০৬ সালে ৬ হাজার ১২০টি, ২০০৭ সালে ৭ হাজার ২০০, ২০০৮ সালে ৭ হাজার ৭৮টি, ২০০৯ সালে ৭ হাজার ৭০৪টিতে।

সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, আধুনিকতার নামে পশ্চিমাদের জীবনযাপন মানুষের জীবনের খুব বেশি প্রভাব ফেলছে। এজন্য মধ্য ও উচ্চবিত্ত প্রায় প্রতিটি পরিবারের মধ্যেই খুব অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। উপড়ে উঠার জন্য ও নিজেদের প্রকাশ করার প্রতিযোগিতায় সমাজের মানুষ খুব বেশি অধৈর্য হয়ে পড়ছে।

পরিবারগুলোর মধ্যে ধর্মীয় ও নৈতিকতার চর্চা উঠে যাচ্ছে। পারস্পরিক সহমর্মিতার অভাব, সম্মানবোধের অভাব এবং ধর্মীয় অনুশাসন থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে বেশির ভাগ তালাকের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া অন্য কিছু কারণের মধ্যে হলো মেয়েরা আগের চেয়ে বেশি শিক্ষিত হচ্ছে। তারা এখন অনেক সচেতন। মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য না করে ডিভোর্সের পথ বেছে নিচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, বিবাহ বিচ্ছেদ কম বেশি আগেও ছিল। কিন্তু এখন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে মেয়েরা এখন স্বাবলম্বী। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হলে তারা মনে করে নিজেরাই চলতে পারবে। এ ছাড়া ব্যক্তিত্বের সংঘাত, সাংস্কৃতিক সংঘাত, জৈবিকভাবে অতৃপ্তির সংঘাত। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হলো সাংস্কৃতিক ও রুচিগত পার্থক্য। এসব কারণে যদি দিনের পর দিন মাসের পর মাস তারা অতৃপ্ত থাকে তবেই বিচ্ছেদ ঘটে। মেয়েরা স্বাবলম্বী তারা মনে করে তাদের হারাবার কিছু নেই। কিন্তু আগের দিনগুলোতে মেয়েরা অসন্তুষ্ট থাকলে কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না।

নৌকায় ভোট না দেয়ায় স্ত্রীকে তালাক


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ