শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


‘আমারটা তো আমারই আছে, তোমারটাও কতটা আমার’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আহমদ সেলিম রেজা
অতিথি কলাম লেখক

হুজুর বলেন, ইসলাম হলো সহজ সরল পথ। ফলে মুসলমানদের কাজের নীতি হলো, যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য ব-ই মিথ্যা বলিব না। ইউরোপের নীতি হলো, বানরের পিঠা ভাগের মতো। ‘আমারটা তো আমারই আছে। তোমারটাও কতটা আমার’ সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বাংলাদেশের নীতি হলো, সবার সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরিতা নয়। চাণক্য নীতি হলো, যদি বলো উত্তরে, যাইবে দক্ষিনে। কুটনীতিকদের আলোচনা থেকে জেনেছি, কুটনীতিতে মুসলমানদের দুর্বলতার জায়গা হলো সরলতা ও সততার জায়গা। আর পূর্ব ও পশ্চিমের কুটনীতিকরা মুসলিম দেশের সাথে ‘তোমারটাও কতটা আমার’ নীতিতে খেলে বেশ ভালো স্বাদই পেয়েছে।

সৌদি আরব, মিশর, পাকিস্তান, তুরস্ক, ইরাক, আরব আমিরাত, বাহরাইন তার দৃষ্টান্ত। তারপরও মুসলিম দেশ হয়েও সাম্প্রতিক কালে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ইরান। তাদের পথ অনুসরণ করে সাম্প্রতিক বিশ্বে নতুন করে ঘুরে দাঁড়িয়ে লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, তুরস্ক ও কাতার বেশ চমক দেখিয়েছে। ইরানের এই বুদ্ধিবৃত্তিক বা ‘হেকমত-এর সাথে’ কুটনীতির স্বীকৃতি মিলেছে রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স ও জামার্নীর কাছ থেকে। ইরান নতুন যে নীতিটা দাঁড় করাতে চাইছে, তাহলো আমারটা আমার, তোমারটা তোমার। তবে লাভ লোকসানের প্রশ্নে কেউ পরস্পরের স্বার্থহানির কারণ হবে না। উপকৃত হতে চাইলে পরস্পরের উপকার হতে হবে। আমার দ্বারা তুমি ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। তোমার দ্বারা আমি না-এই গ্যারান্টি ক্লজ থাকতে হবে। ইরানের এই নীতি বিশ্বে কার্যকর হলে বর্তমান ওয়ার্ল্ড অর্ডার পাল্টে যাবে। তবে এমনি এমনি সেটা হতে দিতে চাইবে কী কেউ? জানতে চান হুজুর। প্রশ্নই আসে না। আমার তড়িৎ জবাব। হুজুর বলেন, সে কারণেই বিশ্বে আজ নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার অজুহাতে মার্কিন বিরোধীরা ধীরে ধীরে একত্রিত হচ্ছে। উত্তর কোরিয়া, চিন, রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, কাতার-বলয়টা ক্রমে বাড়ছে। আর ছোট বড় নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে বিশ্ব ভয়াবহ এক যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চীন-ভারত উত্তেজনা আমাদের ঘারে গরম নি:শ্বাস ফেলবে, এটাই স্বাভাবিক। আবার উত্তর কোরিয়া-মার্কিন দ্বন্ধে চীন-রাশিয়া ঐক্যবদ্ধ অবস্থানে চলে যাবে এটা মার্কিনীরাও জানে। তাই তাইওয়ান নিয়ে, দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে তারা নাড়াচড়া করে দেখছে-মার্কিন অবস্থানটা কতটা সুবিধাজনক? ওদিকে জলবায়ু ও প্রতিরক্ষা ব্যয়ের প্রশ্নে মার্কিন ভূমিকা নিয়ে অসন্তুষ্ট ফ্রান্স ও জার্মানী। ফলে চীন, রাশিয়া ও ইরানের সাথে বাড়ছে তাদের কুটনৈতিক সখ্যতা ও বাণিজ্য। সাম্প্রতিক জাতিসংঘের অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপকে রাশিয়া ঘোষণা করেছে, বাণিজ্যিক যুদ্ধ হিসেবে। আবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে ওরা পড়ে গেছে নতুন এই পেরেশানিতে। এ অবস্থায় মার্কিন প্রশাসন চলছে শ্যাম রাখি না কুল রাখি দ্বন্ধ। তাদের প্রেসিডেন্টের অবস্থান আর কংগ্রেসের অবস্থান ভিন্ন। সিনেট রীতিমতো নজরদারি করছে প্রেসিডেন্টের ওপর। পরস্পর পরস্পরকে অবিশ্বাস করে এখন নিজেদের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে তারা। প্রেসিডেন্টের অফিস হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা তথ্য পাচারের অভিযোগে চাকরী হারাচ্ছেন। এতে কার্যত ক্ষমাতা বাড়বে রাশিয়ারই। তবে পেন্টাগন বসে নেই। বিশ্বের এক নাম্বার শক্তির বড়াইকারী দেশের মর্যাদা রক্ষার বা নিজেদের বাঁচানোর উপায় হিসেবে তারা সহসাই একটা যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতে পারে বিশ্বে।
-তাতে আমাদের কী? আমি বলি। আমরা তো সব পক্ষেই আছি। অসুবিধা কী?

হুজুর বলেন, অসুবিধা কী নওয়াজ শরীফ বুঝতাছে। লাইনটা আমার পছন্দ হয়নি। তাই হুট করে আমি বলি, হুজুর! এটা তো আদালতের রায়ের কারণে ঘটেছে। সে দূর্নীতিবাজ। তার মেয়ে, জামাই সব দূর্নীতিবাজ। তিনি চোখ পিটপিট করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর বলেন, সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে কেন? আমি ঝটপট বলি, গরভাচেভের জন্য। তিনি বল্লেন, ভুল। আমি চমকে উঠলাম। হুজুর বলেন কী! তিনি বলেন, সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙ্গেছে বরিস ইয়েলেৎসিনের লোভের জন্য। সে ছিল রাশিয়ার প্রাদেশিক প্রেসিডেন্ট। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আস্থাভাজন।

বিবিসি নতুন করে সে কথা আবার স্মরণ করিয়ে দিতে সম্প্রতি ‘মদের আসরেই কি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার চুক্তি হয়েছিল’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন লিখেছে। তাতে বলা হয়, ১৯৯১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙ্গে গিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। তিনটি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র- রাশিয়া, ইউক্রেন এবং বেলারুশের নেতারা সে বছর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য এই ঐতিহাসিক চুক্তিতে সই করেন। চুক্তির প্রথম লাইনটি ছিল এরকম, ‘ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক আইনের বিষয় হিসেবে ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিষ্ট রিপাবলিকস বা ইউএসএসআর এর কোন অস্তিত্ব আর নেই’। এর আগে বেলারুশে বৈঠকে বসলেন তিনটি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের নেতারা। গরবাচেভ এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না। বৈঠকটি ডেকেছিলেন বেলারুশের প্রেসিডেন্ট স্ট্যানিস্লাভ শুশকেভিচ। ইউক্রেনের লিওনিদ ক্রাভচুক এবং রাশিয়ার বরিস ইয়েলৎসিন যোগ দিয়েছিলেন সেখানে। অবশ্য এরআগেই ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছে। গরবাচেভ তখন এক কঠিন সময় পার করছেন।

১৯৯১ সালের অগাষ্টে তার বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছিল কট্টরপন্থী কমিউনিষ্টরা। তারা গর্বাচভের সংস্কার কর্মসূচী পেরেস্ত্রোইকার বিরোধী ছিল। কিন্তু সেই অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে ক্ষমতায় টিকে যান গরবাচেভ। তবে এসবের নেপথ্যে কে ছিল তার বলেনি বিবিসি। এরপর হঠাৎ করে ১৫ টি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের মধ্যে স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে। ইউক্রেন সহ অনেক ছোট ছোট প্রজাতন্ত্রে স্বাধীনতার দাবিতে গণভোটও হয়। এরপর হুজুর থামেন। আমার কাছে জানতে চান, তোমার কি মনে হয় সব কিছু এমনি এমনি ঘটছে? নেওয়াজ শরীফের রায়ের মতো? যে সোভিয়েট সরকার সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেয়, সেই সরকার মাত্র চার মাসের গণ আন্দোলনে কোন ভূমিকাই নিতে পারল না? সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলো? জনগণের এতো শক্তি? এই শক্তির জোগানটা এলা কোথা থেকে? যারা জোগান দিল তাদের লাভটাও কিন্তু কম হলো না। এরপরই কিন্তু বিশ্বের একক মোড়ল হিসেবে আবিভূত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমি চুপ করে শুনতে থাকি। হুজুর বলে চলেন, তো ১৯৯১ সালের ৮ ডিসেম্বরের সেই বৈঠকে তারা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার জন্য ১৪টি অনুচ্ছেদের একটি চুক্তির খসড়া তৈরী করে।

বিবিসি লিখেছে, ‘রাত তিনটে নাগাদ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ঘোষণা করে তৈরি চুক্তির খসড়া তৈরি হয়ে গেল। এখন পুরো বিশ্বের সামনে ব্যাপারটা ঘোষণা করার পালা’। এরপর ‘ইয়েলেৎসিন এবং ক্রাভচুক মজা করে আমাকে স্ট্যানিস্লাভ শুশকেভিচকে বললেন, আমরা দুজন মিলে আপনাকে মনোনীত করেছি গরবাচেভকে বিষয়টি জানানোর জন্য। তখন শুশকেভিচ হেসে বলেন, মিস্টার ইয়েলৎসিন, আমি আর ক্রাভচুক মিলে আপনাকে মনোনীত করছি আপনার প্রিয় বন্ধু প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে ফোন করার জন্য। এরপর ইয়েলৎসিন ফোন করলেন প্রেসিডেন্ট বুশকে। আর মস্কোতে মিখাইল গর্বাচভের অফিসে ফোন করেন শুশকেভিচ। সেই টেলিফোন আলাপের কথা এখনো মনে করতে পারেন মিস্টার শুকেভিচ।

বিবিসিকে তিনি বলেন, আমি গর্বাচভকে বুঝিয়ে বললাম, কি ধরণের চুক্তিতে আমরা সই করতে চলেছি। গর্বাচভ তখন একটা ভাব নিয়ে বললেন, তাহলে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের কী হবে? তখন আমি বললাম, আসলে বরিস ইয়েলৎসিন এখন প্রেসিডেন্ট বুশের সঙ্গে কথা বলছেন। এবং প্রেসিডেন্ট বুশের মনে হয় আপত্তি নেই!
এরপর হুজুর আমার দিকে চেয়ে বলেন, এরপরও যদি বলো, আদালতের চোখে রাজনীতিকে বিচার করতে তাহলে তোমার সাথে আর সময় নষ্ট না করাই ভালো। হুজুর হুজুর রাগ করবেন না। নেওয়াজ তো আমেরিকারই..হুজুর আমাকে কথা শেষ করতে দেন না। বলেন, ছিল। কিন্তু চিনের সাথে অর্থনৈতিক করিডোর করে সে মার্কিনীদের বিরাগ ভাজন হয়েছে। আফগান ইস্যুতেও পাকিস্তানের সাথে মার্কিনীদের খটমট চলছিল। সবশেষে সৌদি নেতৃত্বে ইরান বিরোধী জোটে পাকিস্তানের অংশগ্রহণ নিয়ে অস্পষ্টতা কাঁচের মতো পরিষ্কার হয়ে যায় কাতার অবরোধে পাকিস্তান কাতারের পক্ষ নিলে। ক‚টনৈতিক অঙ্কের ফল তাই বলে। তাই বলি যাহা দেখ শুধু তাহাই সত্য নয় যাহা দেখা যায় না তাহাও মিথ্যা না-ও হতে পারে। জানো হে সুজন, করো যদি সন্ধান।

লেখক পরিচিতি : সাংবাদিক, কলাম লেখক ও গবেষক

-এজেড


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ