বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১১ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫


আলেমদের ‘মাওলানা' বলে ডাকা কি শিরক?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি আবদুল কাদির মাসুম

'মাওলানা' শব্দটি 'মাওলা' ও ‘না' দুই আরবি শব্দের সমাস। 'না' অর্থ আমরা বা আমাদের। আর 'মাওলা' শব্দের প্রায় ৩০ টি অর্থ রয়েছে। যেমন: প্রভু,বন্ধু, সাহায্যকারী, মনিব, দাস, চাচাতো ভাই, প্রতিনিধি, অভিভাবক, নিকটবর্তী, আত্মীয়, নেতা, গুরু, প্রতিপালক, সর্দার,  প্রেমিক, প্রতিবেশী, আনুগত্য, প্রার্থনা, নিরবতা, ইবাদত ও দন্ডায়মান ইত্যাদি।

(সূত্র:-ইমাম ইবনুল কায়্যিমকৃত 'বাদায়িউল ফাওয়ায়িদ' ৪/৯৭৮, হযরত থানভীকৃত 'ফাতাওয়ায়ে আশরাফিয়া' পৃঃ ৭০, বাবুল ফিকহ, ফতওয়া নং-৩১, হযরত লাখনভীকৃত 'উমদাতুর রিআয়াহ' ২/৩২৮, লিছানুল আরব ৮/৪৫২,ছিহাহ পৃঃ৮২০,কামুস ২/ ৬২৩, আলমিসবাহুলমুনীর পৃঃ৫৯১, মাকায়িছুল্লুগাহ ২/৫৪৯)

কুরআন ও হাদিসে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন অর্থে 'মাওলা' শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। আমাদের কিছু সংখ্যক লামাযহাবী ভাইয়েরা সঠিক অনুসন্ধান না করে বাহ্যিক দৃষ্টিতে বলে ফেলেন 'মাওলানা' শব্দটি আল্লাহর সাথে সুনির্দিষ্ট। যেমন কুরআনে এসেছে- ‘আনতা মাওলানা ফানছুরনা’ (সুরা বাকারাঃ২৮৬)। এই আয়াতে 'মাওলানা' বলে আল্লাহকে সম্বোধন করা হয়েছে। বুঝা গেল এটি আল্লাহর বিশেষ্য। সুতরাং কোন মানুষকে 'মাওলানা' বলে সম্বোধন বা বিশেষিত করা জায়েয নয়; বরং শিরক।

আমাদের ভাইদের এ বক্তব্যটি ঠিক নয়। কেননা আল্লাহর ক্ষেত্রে 'মাওলানা' শব্দকে যে অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে আলেমদের ক্ষেত্রে সে অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। আল্লাহর ক্ষেত্রে 'মাওলানা' অর্থ হল আমাদের প্রভু আর আলেমদের ক্ষেত্রে তার অর্থ হচ্ছে আমাদের (ধর্মীয়) অভিভাবক।

(সূত্র:-কিতাবুল ফাতাওয়া ১/২২৮, কিতাবুল ইলম, ফতওয়া নং-১৫৩, আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল ২/৬৩৮ মুতাফাররিক মাসায়েল)

ধরুন 'ভালোবাসা' শব্দটি। আপনি বললেন- 'আমি আমার বোনকে ভালোবাসি' এবং বললেন- 'আমি আমার স্ত্রীকেও ভালোবাসি।' বলুনতো, স্ত্রীর ভালোবাসা ও বোনের ভালোবাসা উভয়টার মর্ম কি এক? কখোনো না। উভয়টার মর্ম ও অর্থের মাঝে আকাশ-পাতাল তফাৎ। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা জৈবিকপ্রসূত আর বোনের প্রতি ভালোবাসা রক্তের বন্ধনের আকর্ষণপ্রসূত। তো 'ভালোবাসা' শব্দটা যেভাবে দুই ক্ষেত্রে দুই অর্থে দুই মর্মে, অনুরুপভাবে 'মাওলানা' শব্দটাও দুই ক্ষেত্রে দুই অর্থে ভিন্ন ভিন্ন মর্মে।

মোটকথা আলেমদের ক্ষেত্রে 'মাওলানা' শব্দের অর্থ হচ্ছে 'আমাদের ধর্মীয় নেতা বা অভিভাবক।' আল্লাহর ক্ষেত্রে অর্থ হচ্ছে 'আমাদের প্রভু বা মালিক'।

যদি শুধু শব্দগত রূপ মিল থাকাতেই কোন শব্দের ব্যবহার ও প্রয়োগ নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে আমি বলবো-আমাদেরকে 'মুমিন' নামে আখ্যায়িত করা বা সম্বোধন করাও নাজায়েজ। কারণ আল্লাহ তাআলার ৯৯ নামসমুহের একটি হচ্ছে 'মুমিন'। অথচ কুরআন ও হাদিসে জাগায় জাগায় মুসলমানদের 'মুমিন' বলে বিশেষিত করা হয়েছে। তো এখানেও কিন্তু বান্দার ক্ষেত্রে 'মুমিন' শব্দের এক অর্থ আর আল্লাহর ক্ষেত্রে আরেক অর্থ, একইভাবে 'মাওলানা' শব্দটার বেলায়ও ব্যাপারটা তাই।

ইতিহাস তালাশ করলে আমরা দেখতে পাই, সর্বশ্রেষ্ঠ তাবেয়ী হযরত হাছান বছরীকে লোকেরা 'মাওলানা' বলে ডাকতো। (সূত্র:- তাহযীবুততাহযীব ২/২৬৩, আলবেদায়া ওয়ান্নেহায়া ৬/২৬৬)

রাসুল সা. হযরত যায়েদ বিন ছাবিত রা: কে বলেছেন, : « ﺃﻧﺖ ﺃﺧﻮﻧﺎ ﻭﻣﻮﻻﻧﺎ ...ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﺒﺨﺎﺭﻱ

হযরত আলী রাযি. তার ছেলে হযরত হাসান রা.'র উস্তাদ আসলে হাসান রা.কে বলেছিলেন-
ﻗﻢ ﺑﻴﻦ ﻳﺪﻯ ﻣﻮﻻﻙ

অর্থাৎ 'তুমি তোমার মাওলার সামনে দাড়াও।' (সূত্র:-ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী ৫/৪৩৫)
ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী'র ভাষ্য এরুপ- ﻭ ﻟﻮ ﻗﺎﻝ ﻷﺳﺘﺎﺫﻩ ' ﻣﻮﻻﻧﺎ ' ﻻ ﺑﺄﺱ ﺑﻪ ﻭ ﻗﺪ ﻗﺎﻝ ﻋﻠﻰ ﺭﺿﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ ﻻﺑﻨﻪ ﺍﻟﺤﺴﻦ ﺭﺿﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ : ' ﻗﻢ ﺑﻴﻦ ﻳﺪﻯ ﻣﻮﻻﻙ ' ، ﻋﻨﻰ ﺃﺳﺘﺎﺫﻩ ﻭ ﻛﺬﺍ ﻻ ﺑﺄﺱ ﺑﻪ ﺇﺫﺍ ﻗﺎﻝ ﻟﻤﻦ ﻫﻮ ﺃﻓﻀﻞ ﻣﻨﻪ
‏( ﺍﻟﻔﺘﺎﻭﻯ ﺍﻟﻌﺎﻟﻤﻐﻴﺮﻳﺔ ٤٣٥ / ٥ ﻛﺘﺎﺏ ﺍﻟﻜﺮﺍﻫﻴﺔ، ﺍﻟﺒﺎﺏ ﺍﻟﺜﻼﺛﻮﻥ ﻓﻰ ﺍﻟﻤﺘﻔﺮﻗﺎﺕ )

তাছাড়া আরেকটা লক্ষণীয় বিষয়, উর্দূ ভাষায় 'মাওলানা' শব্দটি উস্তাদ ও আলেমে দীন অর্থেও ব্যবহৃত হয়।
(দেখুন- রহমাতুল্লাহ জালালাবাদী রহ. কৃত আলহাদিয়্যাতুল মারযিয়্যা পৃঃ ১১৭ , ফিরুজুল্লুগাত পৃঃ ৬৬৪)

আমরা যেহেতু এই শব্দের ব্যবহার উর্দুভাষীদের থেকে পেয়েছি, তাই মাওলানা দ্বারা এই দুই অর্থই উদ্দেশ্য। আর হযরত আলীর উক্তি থেকেও এই কথাই বুঝা যায়।

বেহেশতী জেওর কি মাওলানা আশরাফ আলী থানবী’র লেখা?


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ