মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১০ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫


সৌদির প্রাসাদ অভ্যুত্থান; সব কিছুর পেছনে যে জন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

দাভিদ হির্স্ট
ইংল্যান্ডের বিখ্যাত মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি বিশ্লেষক এবং Middle East Eye এর সম্পাদক

বাদশাহ সালমান ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে আমি যে প্রসাদ-অভ্যুত্থান নিয়ে লেখালেখি করছিলাম, তার চূড়ান্ত প্রক্রিয়াটি মাত্র সম্পন্ন হলো। সবাই কাতারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু অভ্যুত্থান হলো খোদ সৌদি আরবের মধ্যেই।

অভ্যুত্থানটি ঘটেছে রাতের শেষে ফজরের নামাজের পর। মুসলমানরা নতুন একটি দিন শুরু করার জন্য মাত্র ফজর নামাজ শেষ করেছেন। লক্ষ লক্ষ সৌদিয়ান ঘুম থেকে উঠেই নতুন একটি বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছেন।

৩১ বছর বয়সী একজন রাজপুত্র তাদের পরবর্তী রাজা হতে যাচ্ছেন। সৌদি আরবের নতুন ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে মুহাম্মাদ বিন সালমান আল সৌদের (৩১) নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে ওই পদ থেকে পদচ্যুত হলেন তার চাচাত ভাই মোহাম্মদ বিন নায়েক বিন আব্দুল আজিজ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সৌদি প্রেস এজেন্সি (এসপিএ) এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এর আগে মোহাম্মদ বিন সালমান আল সৌদ দেশটির ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স ছিলেন এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করতেন।

সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সৌদি আরব সফর ও গৃহীত দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত সালমানের ‘সাফল্য’ বলে অভিহিত করা হয়। নতুন প্রিন্স দেশটির সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনে কাজ করবেন বলে জানিয়েছে এসপিএ। এছাড়া দেশটির জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ এবং সেনাবাহিনীর দায়িত্বেও থাকবেন তিনি।

উল্লেখ্য, গত মার্চে বিন সালমান ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। হোয়াইট হাউজের সেই বৈঠকে ইরানকে আঞ্চলিক শান্তির বিপরীতে হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

মৃত্যু পথের যাত্রী তার বাবা বাদশা সালমান এখন শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। মুহাম্মাদ বিন সালমানই এখন নাম ছাড়া প্রকৃত বাদশাহ। বার্ধক্যজনিত কারণে বাবার অক্ষমতার সুযোগ নিয়ে এই যুবক শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়; বরং তার নিজের দেশেও তৈরি করেছে নানা অস্থিরতা। উল্লেখ্য, ট্রাম্পের রিয়াদ সফরের সময় বাদশাহ সালমানের প্রদত্ত ভাষণ একাধিক টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করেছিল; আরব শ্রোতাদের জন্যও তা বার্ধক্যজনিত অস্পষ্টতার কারণে বোধগম্য ছিল না।

বাবার ক্ষমতা গ্রহণের পর ধাপে ধাপে মুহাম্মাদ বিন সালমানের ক্ষমতায় আরোহন করার পথের সব বাধা অতিক্রম করেছে। এবার সর্বশেষ বাধা (তার চাচাত ভাই মুহাম্মাদ বিন নায়েফ) এর সবধরনের ক্ষমতা ও প্রভাব রহিত করা হয়েছে। এই পদক্ষেপ প্রতিহত করার কোনো ক্ষমতা তার হাতে ছিল না। অথচ তিনি ইতিপূর্বে সব যুদ্ধেই নিজে না জড়িয়ে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছেন।

প্রথমেই রাজকীয় অধিদপ্তর (রয়েল কোর্ট) তার হাতছাড়া হয়। এরপর তার মাথার ওপর জাতীয় নিরাত্তার জন্য একটি পরিষদ তৈরি করা হয়। তিনি তার যোগ্যতা দিয়ে সেই ঝামেলাকে অতিক্রম করেন। এরপর তার মন্ত্রণালায় থেকে প্রসিকিউশন ক্ষমতা রহিত করা হয়। তারপর আসে এই অঞ্চলের নিকটতম সহযোগী ও বন্ধু কাতারকে বিচ্ছিন্ন করার অপারেশন।

সমস্ত ক্ষমতা এখন অনভিজ্ঞ ও ঝুঁকিগ্রহণকারী একজন যুবকের হাতে। যিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনকালীন স্বল্প সময়ের মধ্যেই অদূরদর্শী হিসেবে বেশ ‘সুমান’ কামাই করে নিয়েছেন।

তিনি ২০১৫ সালে ইয়েমেনের হুথিদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালানোর হুকুম দিয়ে মালদ্বীপে ছুটি কাটানোর জন্য ঘটনার দৃশ্যপদ থেকে সরে যান। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী টানা কযেকদিন খোঁজাখুজি করে তাকে বের করেন। এই যুদ্ধে দশ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করার পর হুথি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানায় দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে। অপরদিকে দক্ষিণের অঞ্চলে প্রেসিডেন্ট আবদে রব্বিহীর হাতছাড়া হয়ে যায়। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি দেশের বাইরে ব্যাপক সমালোচিত হন।

এরপর তার দেশের ভেতরও তিনি কম সমালোচিত হননি। প্রথমেই তিনি সরকারি চাকরিজীবীদের বেতনের কস্ট আরোপের মাধ্যমে মিতবয়ী হওয়ার পদক্ষেপ হাতে নেন। তিনি সতর্ক করেন, এটি না করলে দেশ আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেউলিয়া হয়ে যাবে। পরে আবার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করেছেন দাবি করে এই সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে যান। একদিকে তিনি মিতব্যায়ী হওয়ার এর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, অন্যদিকে ঈদ উপলক্ষ্যে সৌদি চাকরিজীবীদের অতিরিক্ত এক সপ্তাহ ছুটি দেয়া হয়েছে। মোট দুই সপ্তাহ ছুটি পাবেন তারা। এতে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হবে বলেও আশংকা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদগণ। এসব উলট-পালটের মূল হোতা হচ্ছেন মুহাম্মাদ বিন সালমান।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে যে ১১ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র চুক্তি করেছেন। এই চুক্তির যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে আমেরিকা ও সৌদি আরবে। আমেরিকার কয়েকজন আইনপ্রণেতা, ইয়েমেনে সৌদি আরব যে বর্বরতা চালাচ্ছে তারপরও কেন দেশটিকে এত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র দেয়া হবে? ইহুদিবাদী ইসরাইল এ অস্ত্র বিক্রির চুক্তিকে সমর্থণ করেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হোয়াইট হাউজের এক কর্মকর্তা বলেন, অস্ত্র বিক্রি সংক্রান্ত এ চুক্তি এক দশকে ৩০,০০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানোই এ অস্ত্র বিক্রি চুক্তির উদ্দেশ্য বলে দাবি করেন তিনি।

এ ছাড়া, সৌদির কাছে এ অস্ত্র বিক্রির বিষয়ে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ইহুদিবাদী ইসরাইলের সায় রয়েছে বলেও স্বীকার করেন তিনি।

অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, তার আবেগপ্রবণ সিদ্ধান্তগুলোর কোনোটিরই কোনো সুক্ষ্ম বিবরণ পাওয়া যায় না। কিভাবে তা বাস্তবায়ন হবে তার যুক্তি ও পদ্ধতি থাকে না তার সিদ্ধান্তবলীতে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বৃহৎ তেল কোম্পানি আরামকোর পাঁচ শতাংশ নিউ ইয়র্ক ও লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ কাছে বিক্রি করে দেয়ার প্লানও করেছেন তিনি। যদিও এই প্লানটি আইনি ঝুঁকিতে রয়েছে।

এসব কাজের পেছনে তার মূল উদ্বুদ্ধকারী ও উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন উপসাগরীয় অঞ্চলের নব্য সহযোগী আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মাদ বিন জায়েদ। খুব দ্রুত ক্ষমতা পাওয়ার জন্য জায়েদ তাকে দুটি পরামর্শ দিয়েছে।

ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা। এটি সে করে ফেলেছে। সৌদি আরব এখন ইসরাইলের নেতৃত্বেই আছে। তাই সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল জুবায়ের ও জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত নেকি হায়েলি উভয় প্রচেষ্টা করেছে হামাসকে কালোতালিকাভুক্ত করার জন্য।

রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বীনী সংগঠনগুলোর প্রভাব কমানো। এই কাজেও মুহাম্মাদ বিন সালমান বেশ সিদ্ধহস্ত। প্রতিদিনই ধর্মীয় সংগঠনগুলোর প্রভাব কমানোর জন্য কাজ করছেন তিনি। এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখন সে তার ক্ষমতা পাকাপোক্ষ করার কাজে ব্যবহার করছে। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ‘হাইআতু কিবারিল উলামা’র টুইটবার্তাগুলো। যেখানে স্পষ্টভাবে তারা দ্বীনকে রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করছেন।

- হাফিংটন পোস্ট থেকে অনুবাদ করেছেন মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ