মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪ ।। ৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ৯ রমজান ১৪৪৫

শিরোনাম :

‘তার তোর সব ছিরা যাইতাছে..’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আহমদ সেলিম রেজা
অতিথি কলাম লেখক

বাংলাদেশে এক সময় নূরা পাগলা বলে একজন স্বনাম ধন্য লোক ছিলেন। ‘ তার তোর সব ছিরা যাইতাছে..’। এটা ছিল তার বিখ্যাত উক্তি। তবে তার সেই উক্তির ছিল ভিন্ন অর্থ। তিনি দৃশ্যমান ও অদৃশ্য অনেক বিষয়েরই নাকি খোঁজ রাখতেন বলে শুনেছি। তো আজকের মুসলিম বিশ্বের রাজা-বাদশা ও অসহায় মুসলমানদের করুণ অবস্থা দেখে মাঝে মাঝে মনে হয়, আমারও সব তার তোর ছিরা যাইতাছে। সে কারণেই হয়তো আমার মনে হচ্ছে, আরব বিশ্বের শাসকদেরও সব তার তোর ছিরা গেছে।

পত্র-পত্রিকায় তাদের ভোগ-বিলাস ও আয়েশী জীবনের খবরা খবর দেখে তো যে কেউ অনুমান করতে পারে যে, উপরওয়ালার সাথে তাদের কোন কানেকশান নাই। এ কানেকশন থাকা না থাকা কী জিনিস আলেম-ওলামারা ভালো বলতে পারবেন। তবে শুনেছি হাদিস শরীফে মু’মিন বান্দাদের কিছু খাইছিয়াতের বর্ণনা আছে। আমার হুজুর বলেন, মানুষের চাল-চলন, উঠা বসা, পানীয়-খাদ্য, কথা-বার্তা ও বন্ধুত্ব দিয়ে নাকি মানুষ চেনা যায়।

আমি বলি, হুজুর! আমি চিনতে পারি না। কে মানুষ, কে অমানুষ? কে মু’মিন কে মুসলমান? তিনি বলেন, হাদিস শরীফে নাকি বর্ণনা আছে, কে কাদের সাথে চলবে? মুসলমানদের চেয়ে ইহুদি খৃষ্টানদের কারা নিজেদের খুব ঘনিষ্ট বন্ধু করবে-এসব। আবার আখেরী জামানা বা কেয়ামতের আগের সামাজিক অবস্থার বিষয়েও নাকি বর্ণনা আছে। আমি হুজুরের কথা বিশ্বাস করি।

উপমহাদেশের ইতিহাসে হযরত নূর কতুবে আলম, শাহ নেয়ামত উল্লাহ (রহ)-এর কাসিদায়ও এসব বিষয়ে কিছু ভবিষ্যৎ বাণী করে গিয়েছেন। হুজুর আমায় সে সব কাসিদা দিয়েছেন। আমি পড়েছি। যার মোদ্দা কথা হলো, ঐশি কানেকশন কেটে যাওয়ার পর মানুষের মধ্যে কোন পর্যায়ের পরিবর্তন ঘটবে? সামাজিক অবস্থার কতটা অবনতি হবে? ভোগ-বিলাস, টাকা-পয়সা ও দুনিয়া প্রীতি কতটা ভয়াবহ আকার ধারন করবে-এসব। সেখানে যুদ্ধ-বিগ্রহের কথাও আছে। এছাড়া কেয়ামতের আলামত হিসেবে কিছু কথা আছে। কোথায় কী ঘটবে-ইমাম মাহদী (আ:) কোন পর্যায়ে পৃথিবীতে আসবেন-এসব।

আমাদের সমাজে এসবের বেশ চর্চা হয়। কেয়ামতের আগে নাকি ইয়েমেন থেকে বের হবে আগুনের গোলা। সেই আগুনের গোলার আলাদা বিবরণও আছে। তবে টিভিতে সম্প্রতি ইয়েমেন থেকে সৌদি আরবের জেদ্দা বিমান বন্দরের দিকে উড়ে আসা ক্ষেপনাস্ত্র বা স্কাডের দৃশ্য দেখে আমার সেই আগুণের গোলার কথাই মনে পড়ে গেছে। এক সময় তাদের এসব নানা ভবিষ্যৎ বাণীর অনেকগুলো বিষয় আমার কাছে ‘তার ছিরা’ বয়ানের মতো মনে হতো। এখন মনে হয়, সেসব বয়ান বিশ্বাসীদের জন্য যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু যুক্তিবাদিদের জন্য এসব কখনোই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। দালিলিকও নয়। এখন তো আবার দলিল ছাড়া, যুক্তি ছাড়া কথাবার্তা খৈ মুড়ি বরাবর। তাই কাসিদার বয়ানের কমজোরিটা আগেই স্বীকার করে নিলাম।

হুজুরের কাছে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ (সা:) চাঁদ দ্বিখন্ডিত করে দেখানোর পরও নাকি-যারা দাবি করে ছিল, দ্বিখন্ডিত করে দেখাতে পারলে ইসলাম কবুল করবে; তারা করেনি। উল্টো বলেছে, এতো প্রকাশ্য যাদু। একইভাবে হাতের মুঠোতে ধরে রাখা পাথর কথা বলে উঠলেও নাকি দাবিকারীরা মুসলমান হয়নি। তবে কী যুক্তি খুবই ক্ষণস্থায়ী বিষয়? দেখছি, জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে নতুন নতুন যুক্তির আবির্ভাব ঘটছে। মানুষের জীবণ-মৃত্যু, সভ্যতার বিকাশ ও বিনাস, রাষ্ট্রের উত্থান ও পতনের সাথে পাল্টে যাচ্ছে সব।

ইসলামের প্রথম যুগ, ইসলামের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ ও আজকের যুগের মুসলমান ও মুসলিম বিশে^র কায়-কারবার দেখে মনে হয়- যুক্তি হল যুগের নিরিখে একটা চলমান বিষয়। তবে স্বাদের দিক থেকে আচারের মতো সুস্বাদু। কবিগান, পালাগান, মুশির্দী গান বা বাউল গানের মধ্যেও নানা যুক্তির চর্চা শুনেছি। সেই যুক্তবাদি বয়াতীরা আবার প্রতিপক্ষের যুক্ত খন্ডন করে বলেন, যতোই তুমি হও যুক্তিবাদি, কোনো যুক্তিতেই আখেরাত, বেহেস্ত, দোজোখ খন্ডাতে পারবা না। আবার যুক্তি দিয়া তা প্রতিষ্ঠাও করা যাবে না। কারণ এটা ঈমান ও বিশ্বাসের বিষয়। আল্লাহ তোমায় গায়েবের প্রতি ঈমান আনতে বলেছে। বলেছে এসব বিশ্বাস করতে। এজন্য বড়পীর আবদুর কাদের জীলানী রহ:-এর গুনিয়াতুত তালেবীনের যুক্তি খুব অকাট্য- ‘বেলা দলিলা ইল্লাল্লাহ’।

তো আমার মতো যারা ‘তার ছিরার’ গ্রুপের ভক্ত কূল আছে, তারা চারিদিকে সব তারছিরা কারবার দেইখা এখন খালি কান্দে আর হাসে। দুনিয়াদারির সভত্যার মাঝে এসব ‘তার ছিরা’ কারবারই বোধ হয় সব ওলট পালট করে দেয়। সভ্যতা, সমাজ সব বদলে যায়। কারো জন্য ভিষন পীড়া ও কষ্টদায়ক বিষয়। আবার কারো জন্য এসব বিরাট মজাদার বিষয়। ‘ওলট পালট করে দে মা লুটে পুটে খাই’। সেখান থেকে বিষয়টি ছড়িয়ে দেয়া হলো গোত্রীয় হানাহানিতে। এখন তো বিষয়টিকে সরাসরি রাজনীতিতে টেনে এনে, ঠেলে দেওয়া হয়েছে যুদ্ধের ময়দানে। এমনকি সেই যুদ্ধে আমরাও বুঝে না বুঝে নানাভাবে জড়িয়েই গেছি। কীভাবে? সাদ্দামের পতনের পর ইরাকে যা হচ্ছে তাকে কী বলব? যুদ্ধই তো। না হয় গৃহযুদ্ধ বল্লাম। আরো নরম করে আত্মকলহই বল্লাম। লিবিয়ায় কি হচ্ছে? সিরিয়ায় কি হচ্ছে? ইয়েমেনে কি হচ্ছে? এই যে লড়াই, এই যে আত্মকলহ- কিসের জন্য? ইরাক ও সিরিয়ায় খেলাফতের দাবিদার আইএসআইএল বা দায়েশের লড়াইটা আসলে কি?

আরব ভূ-খন্ড ভাগ করল বৃটিশ-ফ্রান্স-ইটালী। আরব ভ’খন্ড দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করল তারা। এখন আরব রাষ্ট্রসমুহের রাজা বাদশারা তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কিনে সেই অস্ত্রে নিধন করছে কাদের? ইয়েমেনীদের। ইরাক সিরিয়ায় লিবিয়া কে মারছে কাকে? মুসলমান মুসলমানদের। তারা সুন্নী না শিয়া এই প্রশ্ন অবান্তর। কারণ তারা মানুষ, তারা আল্লাহর বান্দা এবং মুসলমান। কিন্তু এই বোধ থেকে মুসলমানদের দূরে ঠেলে দিল কে? নিজেদের মধ্যে বিভেদ ও বিভাজন তৈরী করলো কিভাবে? শ্রেষ্ঠত্বের ও মালিকানা লোভ দেখিয়ে নাকি ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে? নেতৃত্বের লোভ দেখিয়ে নাকি ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার ও রাষ্ট্রের মালিকানার লোভ দেখিয়ে? আমার সাথে ইসরাইল-আমেরিকা-বৃটেনের মতো সুপার পাওয়ার আছে। পেট্রো-ডলার আছে। অস্ত্র আছে। অতএব কাউকে গণার সময় নাই-এই বোধ যখন কোন মুসলমানের চেতনায় ঠাঁই পায়-তার ফায়সালা তো কেবল আল্লাহরই হাতে।

আজ ইরাক ও সিরিয়ায় আমরা কি দেখছি, একদল মুসলমান দাবি করছে, নয়া খেলাফত..পুরাতন সব বাদ। ওরাই আসল। মানে কী? এ তো একেবারে ফেসবুকের বন্ধুত্বের মতো খাঁটি ডিজিটাল কারবার।

মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাদের লোখায় পড়েছি, এসবের শুরুটা হয়েছিল, সাদ্দাম যুগে। ইরাকের শিয়াদের কানে তখন জপ তুলে দেওয়া হয়েছে, সে সুন্নী । আট বছর ধরে ইরানের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। ওকে উৎখাত কর। সুন্নীদের বলা হয়েছে, সে স্বৈরাচারী। সে আসলে কমুনিষ্ট। ফিদেল ক্যাস্ট্রো তার বন্ধু। তারপর দৃশ্যপটে এলো কে? জাতিসংঘের টেবিলে ইরাক বিরোধী প্রস্তাব আনল কে? আমেরিকা। আরব রাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্বকে তারা বুঝালো, সাদ্দামের কাছে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কেমিকেল অস্ত্র আছে। অতএব উৎখাত কর।

তারপর একে একে প্রথমে সাদ্দামকে, পরে গাদ্দফীকে উৎখাত করা হলো। তারপরে টার্গেট করা হলো, বাশার আল আসাদকে। কারা এসব ঘটালো? এখন অভিযোগ উঠেছে, দায়েশ গঠন, প্রতিপালন, প্রশিক্ষণ, অস্ত্রসরবরাহ কে করেছে? প্রথমে এলো তুরষ্কের নাম। তারপর সৌদী আরব ও কাতার দৃশ্যপটে হাজির। অস্ত্র আসছে আমেরিকা, বৃটেন ও ইসরাইল থেকে। অভিযোগের তীর কিন্তু আগেই টার্গেট ফিক্স করে রেখেছে।

সর্বশেষ তথ্য, সৌদি আরব নাকি সেই অভিযোগ থেকে নিজেকে বাঁচাতেই এখন কাতারকে বলির পাঠা বানিয়েছে। তাই জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসে মদদ দেওয়ার অভিযোগ তুলে কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ দিয়েছে মিশর বাহরাইন ও আরব আমিরাতকে সাথে নিয়ে। শর্ত দিয়েছে ইরানের সাথে সম্পর্ক রাখা যাবে না। আল জাজিরা বন্ধ করতে হবে। ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ও মিসরের ইখোয়ানুল মুসলেমিনকে সহযোগিতা বন্ধ করতে হবে।

এতোদিন এসব দাবি ছিল আমেরিকা ও ইসরাইলের। এখন ওরা দূরে বসে হাত তালি দিচ্ছে আর অদৃশ্য সূতা টানে এক মুসলিম রাষ্ট্র অপর মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ইসরাইল আমেরিকা, বৃটেন ও রাশিয়া থেকে অস্ত্র ও বুদ্ধি ক্রয় করছে। একে আমরা কি বলব, আত্মকলহ না নয়া ক্রুসেড!

সাংবাদিক ও কলাম লেখক

এসএস/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ