শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


ধনীর সম্পদে গরিবের হক; আদায় করবেন কীভাবে?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব

ন্যূনতম সম্মানজনক জীবনযাপন প্রতিটি মানুষের অধিকার। ইসলামি আইনে যেমন এ অধিকার স্বীকৃত, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবেও তা সর্বজনবিধিত।

মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক ঘোষণার ৫২নং পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রতিটি মানুষের কমপক্ষে এমন পর্যায়ের জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে, যাতে তার স্বাস্থ্যের সুরক্ষা হয়, তার ও তার পরিবারের উপযুক্ত জীবনের নিরাপত্তা দেয়া যায়। খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা ও অন্যান্য জরুরি সামাজিক সেবার জোগান নিশ্চিত করা যায়।’

মানুষ যখন বেকারত্ব, অসুস্থতা, অক্ষমতা, বৈধব্য, বার্ধক্য ইত্যাদি সমস্যার সম্মুখীন হয়ে জীবনধারণের উপায়-উপকরণ হারা হয়ে যায়, তখন পর্যায়ক্রমে তার আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর ওপর তার জীবনের নিরাপত্তা দেয়া অনিবার্য দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। আলী রা. বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ধনীর সম্পদ থেকে ঠিক ততটুকুই জাকাত আদায় করা আবশ্যক করে দিয়েছেন, যাতে তা দরিদ্রদের জন্য যথেষ্ট হয়। যদি কেউ ভুখা-নাঙ্গা থাকে, তাহলে তা মূলত সম্পদশালী ব্যক্তির জাকাত আদায় না করার কারণেই।’ (আবু হাজেম)

বোঝা গেল, আল্লাহ তায়ালা বিত্তশালীর অর্থবিত্তে ততটুকুই জাকাত নির্ধারণ করেছেন, যা দরিদ্রদের জন্য যথেষ্ট হয়। আর দরিদ্রদের জন্য যা যথেষ্ট হয়, তা সম্মানজনক জীবিকার ন্যূনতম সীমা। ওমর রা. বলেন, ‘আমি সব সময় সচেষ্ট থাকি যে, প্রতিটি প্রয়োজনই যেন মেটাই, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা একে অন্যকে সাহায্য করার সামর্থ্য রাখি। আর যদি অক্ষম হয়ে পড়ি, তাহলে যেন আমাদের জীবনযাত্রায় এর প্রতিফলন ঘটাই। অল্পে তুষ্ট হয়ে শুধু যা না হলেই নয়, সে পর্যায়ে এসে সবাই সমান হয়ে যাই।’

অর্থাৎ ইসলাম সম্মানজনকভাবে জীবনযাপনের এমন একটি সুনির্দিষ্ট পর্যায় তথা সীমারেখা টেনে দিয়েছে, যেখানে সবাই একই স্তরে এসে দাঁড়ায়। তবে এখানে এটাও স্মরণ রাখতে হবে যে, প্রত্যেকের উচিত অন্যের করুণাভোগী না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানো।

রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘হালাল উপার্জন করা ফরজগুলোর পরে (গুরুত্বপূর্ণ) ফরজ।’ (বায়হাকি)

ইসলাম ধর্মে সম্পদকে কখনোই অবজ্ঞা করা হয়নি। সম্পদ আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত। এ নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা আদায় হবে আল্লাহর বান্দা তথা মানুষের সেবা করার মাধ্যমে।

আমর ইবনুল আস রা. বলেন, একবার রাসুল সা. আমাকে বলেন, ‘আমি তোমাকে একটি সেনাদলের দায়িত্ব দিয়ে পাঠাতে চাই। (অতঃপর তুমি যদি সেখান থেকে বিজয়ী হয়ে ফিরে আস) আর যুদ্ধলব্ধ কিছু সম্পদ যদি তোমার হস্তগত হয়, তা তুমি আল্লাহর পক্ষ থেকে নিও।’

আমর রা. বলেন, ‘তখন আমি নিবেদন করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি তো সম্পদের লোভে ইসলাম গ্রহণ করিনি। আমি ইসলামের সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তা গ্রহণ করেছি এবং এজন্য যে আমি আপনার সঙ্গী হবো।’ তখন রাসুল সা. বলেন, ‘হে আমর! উত্তম লোকদের জন্য পবিত্র সম্পদ একটা বড় নেয়ামত।’ (মুসনাদে আহমাদ)

এ কারণেই রাসুল সা. এর জীবদ্দশায় সাহাবায়ে কেরামের একটা বিরাট দল ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি, কৃষি ও শিল্পে নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ করেছিলেন। সাহাবিদের কেউ কেউ রাসুল সা. এর জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদও পেয়েছিলেন।

ওসমান রা., আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা., সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. এ ধরনের অনেক সম্পদশালী সাহাবির নাম ইতিহাস সংরক্ষণ করেছে। তারপরও তারা হালাল পন্থায় সম্পদ উপার্জন করেছেন। সম্পদ উপার্জন আখেরাতের সঙ্গে বৈরী কোনো বিষয় নয়। তবে সম্পদের যদি সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত না করে তবে সেটি ভিন্ন কথা।

প্রতিটি দরিদ্র গৃহহীন পরিবারকে জাকাত বা সাধারণ দান থেকে এতটুকু পরিমাণ প্রদান করা সামর্থ্যবানদের দায়িত্ব, যাতে দরিদ্রতা ও গৃহহীনতার অভিধা থেকে মুক্ত হয়ে ন্যূনতম সচ্ছলতার পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। এ সাহায্য ব্যক্তি পর্যায়েও হতে পারে আবার প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও হতে পারে।

মোট কথা, গরিব সমাজের উন্নয়নের দায়িত্ব সমাজের বিত্তবান প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির ওপর বর্তায়। সমাজের বিত্তবানদের কাছে এটা গরিবের অধিকার। এটা কিছুতেই গরিবের প্রতি ধনীর দয়া বা অনুগ্রহ নয়। এ অধিকারের সপক্ষে ইসলামই সবচেয়ে জোরালো নির্দেশনা জারি করেছে। এরশাদ হয়েছে, ‘আর তাদের (ধনীদের) সম্পদে অধিকারবঞ্চিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকার রয়েছে।’ (সূরা জারিয়াত : ১৯)

এজন্য ইসলাম ধনীর অর্জিত সম্পদে গরিবের জন্য জাকাত, সদকা, নিঃস্বার্থ ঋণদান, অধীনস্থদের ভরণপোষণ, আত্মীয়স্বজনের অধিকার, প্রতিবেশীর অধিকারসহ বিভিন্ন বিধান প্রবর্তন করেছে। কারণ পৃথিবীর সমুদয় সম্পদের ওপর সামষ্টিকভাবে সব মানুষের অধিকার রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের (সব মানুষের) কল্যাণে সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা বাকারা : ২৯)

তাই বিত্তবানরা সুখে-দুঃখে সমাজের কল্যাণে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সেবায় এগিয়ে আসবেন এটাই ধর্ম ও মানবতার দাবি।

সম্মানজনক জীবিকার ন্যূনতম সীমা আদায়ের অধিকার শুধু মুসলিমদের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং অমুসলিমদের জন্যও প্রযোজ্য।

ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসকারী সবার পক্ষে এ অধিকার প্রদান করা সবার আগে রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে হীরাবাসীর জন্য খালিদ ইবনে ওয়ালিদ যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, তার দৃষ্টান্ত টানা যেতে পারে। সেই ঘটনা শুনুন তার জবানিতেই। ‘তাদের জন্য আমি ব্যবস্থা করেছি যে, কোনো বৃদ্ধ যদি কাজে দুর্বল হয়ে পড়ে, বা কোনো দুর্ঘটনা বা রোগে অক্ষম হয়ে পড়ে, অথবা ধনী থাকার পর কোনো কারণে দ্রুত দরিদ্র হয়ে পড়ে এবং তার নিজ ধর্মের লোকেরা তাকে দান-খয়রাত করতে থাকে, তাহলে তার জিজিয়া কর মওকুফ করে দিয়েছি এবং মুসলমানদের বায়তুলমাল বা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাকে এবং তার পরিবারকে ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে দিয়েছি, যা দারুল হিজরা (মদিনা শরিফে) ও দারুল ইসলামে (ইসলামী রাষ্ট্রে) প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত ছিল।’

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, সবার মাঝে জীবিকার নিরাপত্তার জন্য ইসলাম কিছু নীতিমালা গ্রহণ করেছে। সবাই যাতে ন্যূনতম সচ্ছলতার জীবনযাপন করতে পারে। এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘মোমিনরা পরস্পর ভাই ভাই।’ এ ভ্রাতৃত্ব শুধু স্লোগান নয়; বরং এটি হচ্ছে বিধি-ব্যবস্থা, যাতে অর্থসম্পদ ও জীবিকার বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে সবাই সমান হয়। ভ্রাতৃত্বের উপঢৌকন আমরা দেখতে পাই সালমান ফারসি ও আবুদ দারদা (রা.) এর জীবনীতে। রাসুল (সা.) তাদের দুইজনকে ভাই বানিয়ে দিলেন। আর তখন তারা নিজেদের সম্পদ সমভাবে ভাগ করে নিলেন। বর্ণিত আছে, কিছু সাহাবি ছিলেন, যাদের খাবার কম থাকলে তারা প্রত্যেকের খাবার একটি থালায় ঢেলে নিজেদের মধ্যে সমভাবে ভাগ করে নিতেন।

লেখক: সম্পাদক, মাসিকআলহেরা


সম্পর্কিত খবর