শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫ ।। ৭ কার্তিক ১৪৩২ ।। ২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

শিরোনাম :
১৬ মাসে কোরআনের হাফেজ কক্সবাজারের ওবায়দুল করিম আমরা কোরআনকে জাতীয় সংসদে নিয়ে যেতে চাই: অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে শনিবার বিক্ষোভ করবে জামায়াত  প্রশাসনকে দ্রুততার সাথে বস্তুনিষ্ঠ ব্যবস্থা নিতে হবে: ইসলামী আন্দোলন আন্তর্জাতিক খতমে নবুওয়ত মহাসম্মেলন সফল করার লক্ষ্যে মানিকগঞ্জ জেলায় মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত  যারা আমাকে অপহরণ করেছে তাদের বাংলাদেশি মনে হয়নি জীবন দিলেও যদি চরিত্র না বদলায় তাহলে ভাগ্যও বদলাবে না: শায়খে চরমোনাই শ্রীমঙ্গলে বেওয়ারিশ কুকুরের আতঙ্ক: এক ঘণ্টায় তিন শিশু আহত ‘দুঃখজনক হলো ইসলামি অঙ্গন থেকে শক্তিশালী মিডিয়া গড়ার উদ্যোক্তা আমরা পাইনি’ ২৪ এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এখন পর্যন্ত পূরণ হয়নি: সারজিস

ছোটগল্প । সুলতানা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মির্জা মুহাম্মদ নূরুন্নবী নূর

ঘরের বারান্দায় বসে আপন মনে মনের মাধুরী মিশিয়ে কাঁথা সিলাইয়ের কাজ করছিলেন রহিমা বেওয়া। একসময়ের সৌখিন রহিমা বেওয়া অনেক আগেই হারিয়েছেন তার প্রাণপুরুষ স্বামী সেকান্দার আলীকে। রহিমার কাছে প্রাণের চেয়ে প্রিয় ছিলো তার স্বামীধন। নিজের জীবনের চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসতেন তার স্বামীকে। স্বামী যেন ছিলো তার জীবন মরণ সঙ্গী। একমুঠো খাবার খায়নি তার স্বামীকে দূরে রেখে। একান্তই কোনো কারণে খেতে হলেও অনেক কষ্ট নিয়েই খাবার খেয়েছেন রহিমা বেওয়া। স্বামী ঘরে না ফেরা পর্যন্ত পথচেয়ে থাকতেন অধীর আগ্রহের সাথে। পারিবারিকভাবেও বেশ স্বনামধন্য ছিলেন সেকান্দার আলী। সমাজে তার বেশ ডাক-নাম ছিলো। এখনও আছে। অর্থনৈতিকভাবেও তিনি ছিলেন অনেক স্বাবলম্বী। এলাকার দুঃখীজনের পাশে দাঁড়িয়ে যেতেন একান্তভাবে। নিজের পরিবারের কোনো আপনজনের একজন সদস্য ভেবে।

সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন অকাতরে। তার নিকটতম কোনো প্রতিবেশী কখনও না খেয়ে দিন পার করেছেন এমন খবর পাওয়া যায়নি তার জীবদ্দশায়। পরের কল্যাণে নিরন্তর কাজ করেছেন মরহুম সেকান্দার আলী। এমনই একজন সমাজ হিতৈষীর বিধবা স্ত্রী রহিমা বেওয়া এখন একাকি দিন পার করছেন বিশাল বাড়িতে। তার পাশে নেই আগের মতো জমজমাট পরিবেশ। মানুষের আনাগোনা। পদচারণা বা কোলাহল। তার পাশে পরিবারের একমাত্র ছেলে বউ সুলতানা ছাড়া আর কেউ নেই এখন। সেও আবার নানান কাজে ব্যস্ত থাকে বেশিরভাগ সময়। বিরাট সংসার। অনেক দায়িত্ব সুলতানার। মেধাবী এবং সনামধন্য পরিবারের মেয়ে সুলতানার মনে কোনো প্রকারের দেমাগ নেই। নেই সামান্যতম অহংকারের ছোঁয়া। কিংবা শিক্ষাদিক্ষার বাহাদুরি। বি.এ. পাশ সুলতানা বেশ সংসারী মেয়ে। শ্বাশুড়ির পাশে থেকে একান্ত আপনার করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছেন আপন সংসার। নিজের ভবিষ্যতের আবাসন।

অনেক দিন হলো স্বামী হারা হয়েছেন রহিমা বেওয়া। এতোদিন পর্যন্ত কখনও কারো কাছেই কোনো কিছুর আবদার করেননি তিনি। না ছেলের কাছে, না ছেলের বউয়ের কাছে। মা বাবা ভাই-বোন বলতে কেউই জীবিত নেই তাঁর। এক ছেলে ছাড়া আর কোনড সন্তানও নেই রহিমা বেওয়ার। তাই অনেক যাচাই বাছাই করেই ছেলের বউ এনেছেন। কপালগুনে কথা। ছেলের বউও শতকে একজন। যেমন রূপবতী, ঠিক তেমনি গুনবতীও। সকল বিষয়ে শ্বাশুড়ির খবর রাখেন সুলতানা।

বেশ অনেক্ষণ যাবত সুলতানাকে না দেখে বেশ কয়েকবার নাম ধরে ডাকলেন শ্বাশুড়ী রহিমা বেওয়া।
না কোনো খোঁজ নেই সুলতানার। বেশ ভাবুক হলেন রহিমা বেওয়া। আবার ডাকলেন সুলতানাকে। এবারও খবর নেই সুলতানার। আর বসে থাকলেন না রহিমা বেওয়া। এবার বেড়িয়ে এলেন ঘরের বাইরে। এদিক সেদিক খুঁজলেন। না কোথাও পাওয়া গেল না। বেশ চিন্তায় পড়লেন রহিমা বেওয়া। আবারও খুঁজতে গিয়ে দেখেন নিজের ঘরে আড়মোড়া হয়ে শুয়ে আছে সুলতানা। তিনি কাছে গেলেন। পরম আদরের সাথে ডাকলেন সুলতানাকে। আলতো ছোঁয়ায় হাত বোলালেন বউমার শরীরে। কপালে। মাথায়। এবার একটু নড়েচড়ে উঠলো সুলতানা। ঘুম ভাংলো সুলতানার। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে পাশে দাঁড়িয়ে আছেন শ্বাশুড়ী। তাকে ডাকছেন পরম আদরের সাথে। মমতার চাদর জড়িয়ে। ভালোবাসার সবটুকু মমতা ঢেলে। গর্ভধারিণী মায়ের মতন করে। সুলতানা আর শুয়ে থাকতে পারলো না। আস্তে করে উঠে দাঁড়ায়। বিনয়ের সাথে সুলতানা জিজ্ঞেস করে-

: আম্মা আমাকে ডাকলেন?
: হ্যাঁ মা।
: কোনো দরকার?
: না, তেমন কিছু না।
: তাহলে?
: অনেকক্ষণ থেকেই তোমাকে দেখছি না। তাই।
: আচ্ছা।
এবার দুইজনে পাশে বসে গল্প করছেন। জীবনের অনেক কাহিনী শুনালেন রহিমা বেওয়া। বড় হবার কাহিনী। স্বামী হারানোর বেদনার কাহিনী। একাকীত্বের যন্ত্রণার কাহিনী। আরো অনেক অনেক বর্ননা দিলেন শ্বাশুড়ী। শ্বাশুড়ীর জীবন কাহিনী শুনে অনেকটাই কষ্ট পেল সুলতানা। নিজেকে আরো বেশি দায়িত্বপ্রাপ্ত মনে করতে শুরু করল বউমা। একান্ত আপনার করে। গভীর থেকে গভীরে। এবার শ্বাশুড়ীর একান্ত পাশে বসে আবারো বলতে শুরু করলো-
: আপনার কি চাই মা?
: না। কিছুই না।
: অবশ্যই আজকে কিছু একটা চাইতে হবে আপনাকে। যা আপনার কষ্ট দূর করতে সহযোগিতা করবে। হৃদয়ে শান্তি আনবে। মনের দুঃখ ব্যথা দূর করে প্রশান্তির পরশ জোগাবে। আপনাকে আপনার করে বাঁচতে সাথীর ভুমিকা রাখবে। বলুন মা। আপনার চাওয়া পাওয়ার কথা বলুন।
: না মা। তোমার কাছে আমার আর কোনো কিছুই চাওয়া পাওয়ার নেই।
: তবে?
: কোনো তবে নাই।
: আমার আছে।
: কি সেটা?
: আপনার প্রশান্তির জন্য কিছু একটা চান। একান্তই আপনার করে চান।
: যেমন।
: জানি না।
: তাহলে?
: আপনাকেই বলতে হবে।
: আমার কোনো চাওয়ার নেই মা।
: আছে। জানি আপনার অনেক কিছুই চাওয়ার আছে।
: বল তাহলে?
: পারবো না।
: তাহলে আমার চাওয়ার আছে তা তুমি বুঝতে পারলে কি করে।
: সেটিও জানি না। তবে আমার মন বলছে আমার কাছে আপনার অনেক কিছুই চাওয়ার আছে।
: তুমি ভাবতে পার। তবে জেনে রাখ। আসলে আমার কিছুই চাওয়ার নাই মা। আমার জীবনে যা কিছুর দরকার না চাইতেই তুমি তার সবকিছুই দিয়ে দিয়েছো আমাকে। তাই আমার আর কিইবা চাওয়ার থাকে!
: আপনার না থাকলেও আমার আছে। আপনার জন্য আমার অনেক কিছুই চাওয়ার আছে। দুনিয়ার জন্য। আখিরাতের জন্য। আপনার ছেলের জন্য। আমাদের ভবিষ্যতের জন্য। আমাদের অনাগত জীবন চলার জন্য।
বয়সের ভারে নুব্জ্য রহিমা বেওয়া বউমার এসব কিছু তেমন ভালো বুঝতে পারে না। তাই শ্বাশুড়ীর আকুতি-
: বলো। আমার জন্য তোমার কি চাওয়ার আছে? আমার প্রশান্তির জন্য তোমার কি দরকার? তোমার জন্য কি চাওয়া। আমার ছেলের জন্য কি প্রয়োজন? তোমাদের ভবিষ্যতের জন্য কিসের আকুতি? অনাগত জীবনের জন্য আর কি পেতে চাও তুমি? দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তির জন্য কী কী জিনিস দরকার তোমাদের? দুই জীবনের কল্যাণের জন্য আরো কী প্রয়োজন?

শ্বাশুড়ীর কথায় এবার একটু লজ্জা অবনত হয়ে মাথা নিচু করে বউমা সুলতানা। আনমনা ভাব তার। যেন কি বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। খুব লজ্জা হচ্ছে বলতে। ইচ্ছে করছে কিন্তু!

এবার কিছুটা আঁচ করতে পেরেছেন শ্বাশুড়ী রহিমা বেওয়া। তাই আবারো কাছে ডাকলেন বউমাকে। পরম আদরের সাথে। মমতার চাদরে। আদরের পরশ বুলিয়ে। বউমার মাথায় হাত বোলালেন শ্বাশুড়ী। প্রাণভরে দু'অা করলেন বউমার জন্য। তার ভবিষ্যতের জন্য। তাদের আগামীর পথচলার জন্য। দুনিয়ার কল্যাণের জন্য। পরকালের নাজাতের জন্য। এবার পরম আদরে পাশে ডেকে বললেন-
আমার একটা চাওয়া আছে। তুমি কি পারবে তা পূর্ণ করতে? তুমি যদি আমার চাওয়াটাকে পূর্ণ করতে পার তাহলে হয়তো আমি কিছুটা হলেও নিসঙ্গতা থেকে মুক্তি পাব। খেলার সাথী পাব। পড়ার বন্ধু পাব। খাওয়ার সঙ্গী পাব। তুমি পারবে মা আমার এ কাজটুকু করতে--

: দু'অা করুন মা। আমি আপনার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তায়ালা যেন আপনার চাওয়া পাওয়ার দাবি পূর্ণ করে দেন।
: আমীন।
: বলুন আপনার চাওয়া।
: বলছি। শোন তাহলে--

আমি তখন সবেমাত্র নববধূটি। আমার শ্বশুরবাড়ির কিছুই বুঝে উঠিনি আমি। না শ্বশুরকে। না শ্বাশুড়ীকে। না দেবর, নোনদ-ননদীদেরকে। না তোমার শ্বশুরকে। আমি সুবোধ বালিকার মতোই অবলা। একেবারেই সরলা। তবে শ্বাশুড়ীর খুব আদরের ছিলাম। একান্ত কাছের ছিলাম। পরম আদর যত্নে মানুষ হয়েছি শ্বাশুড়ীর কোলে। মায়ের আদরে। গর্ভধারিণী মায়ের দুঃখ ভুলেছি আমার শ্বাশুড়ীর আদর পেয়ে। মমতা মাধুরী আচরণে। ভালোবাসার চাদরের পরশে। সর্বোত্তম নসিহতে। জানি না আমি তোমাকে সেরকম কিছু দিতে পেরেছি কিনা। তবে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি তোমার হক আদায় করতে। তোমার পরিপূর্ণ অধিকার ফিরিয়ে দিতে-
: মা, আপনি এসব বলে আমাকে আর অপরাধী বানাবেন না প্লিজ। শুধু এতোটুকুই বলতে চাই, গর্ভধারিণী মাকে রেখে এলেও আপনার পাশে থেকে তা ভুলতে সক্ষম হয়েছি আমার জীবনে। আমার জীবনের পথচলায়। আমার কর্মের জীবনে। আমার সাংসারিক কর্ম ক্ষেত্রে। তাই আপনি আমার কেবল শ্বাশুড়ী নন, আপনি আমার মা। আমার গর্ভধারিণী মায়ের ছায়া। আমার মায়ের বিকল্প মা। আমার মায়ের জান্নাতী কোল। আমার মায়ের জান্নাতী বাগান। বলুন মা আপনার চাওয়া-পাওয়ার কথা। আপনার পাওয়ার আকুতি--

: তাই।
হ্যা মা, তাই। আপনার চাওয়া পূর্ণ করতে আমার চেষ্টার সামান্যতমও ঘাটতি থাকবে না ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তায়ালা যেন আপনার আকুতি পূর্ণ করতে তাওফিক দেন আমাকে। আমি যেন তা পূর্ণ করতে পারি। আমাকে দিয়ে যেন আল্লাহ তায়ালা তা করিয়ে দেন।
: আমীন।
: আল্লাহুম্মা আমীন।

: হ্যাঁ মা। আমি তাই তোমার জন্য দু'অা করছি। আশির্বাদ করছি প্রাণভরে। হৃদয়ের একান্ত মমতা ঢেলে। দোয়া করি আল্লাহ তায়ালা যেন তোমার কোলজুড়ে একজন জান্নাতী রহিমা দান করেন। যে রহিমা হবে আমার খেলার সাথী। আমার পড়ার সাথী। আমার ঘুমের সাথী। আমার চোখের পুতুলী। আমার আদরের ছোট্ট বোন। আমার কলিজার টুকরা নাতনী। আমি দুনিয়া থেকে চলে গেলেও যে রহিমা তোমার পাশে থেকে অনুপ্রেরণা জোগাবে। সাহস জোগাবে প্রাণে। আমাকে ভুলে যেতে সহোযোগীতা করবে ছায়া হয়ে। আমাকে চোখে চোখে রাখতে ছায়ার ভুমিকা পালন করবে আপনার করে। তুমি যেই রহিমার কোলে ফিরে পাবে প্রাণ। খুঁজে পাবে হৃদ্যতা।

শ্বাশুড়ীর এমন আকুতি শুনে ঘোমটার আড়ালে মুচকি হাসলো বউমা। এবার পরম শ্রদ্ধায় মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল সুলতানা।

গল্পটা একজন রিকশাওয়ালার


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ