শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


আমিনুল ইসলাম হুসাইনী’র ঈদ গল্প

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

গন্তব্য
আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

'ও মন রমজানের ওই রোযার শেষে এলো খুশির ঈদ...'
আনন্দ মঞ্জিলের দক্ষিণ জানালা দিয়ে ভেসে আসছিল কাজী সাহেবের এই অমর সংগীতের সুরধারা। গতরাত থেকেই থেমে থেমে বেজে চলছে। সত্যি! এ এক অমর সংগীতই বটে। এটা ছাড়া বাঙালিদের ঈদের আনন্দই যেন মাটি। কিন্তু সবার মনেই কি আর আনন্দ দোলা দেয়? এই যেমন আনন্দ মঞ্জিলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা বয়স পঞ্চাশের শুফিয়া খাতুনের? যার দু'চোখে এখনো লেগে অাছে দু'ফোটা বেদনার অশ্রু।

সুফিয়া খাতুনের সাথে আমার পরিচয় হয় বড় অাপার সুবাদে। অাসলে ওনি যে বাড়িটাতে থাকেন সেটা আমার বড় অাপার। বড় আপা বিলেত যাওয়ার আগে এটার তদারকির ভার অামার কাধেই ন্যস্ত করে গেছেন। বাড়িটির নাম যদিও আনন্দ মঞ্জিল। কিন্তু এখানে নিরানন্দ ছাড়া আনন্দের ছিটেফোঁটাও নেই। ঠিক যেন দানা ভরা ফল বেদানার মতো। ও হ্যাঁ, ভালো কথা। এই আনন্দ মঞ্জিল কিন্তু কোনো বিলাসবহুল ইমারত নয়। এটি স্রেফ একটি বৃদ্ধাশ্রম। মাস ছয়েক হলো সুফিয়া খাতুন এই আন্দ মঞ্জিল তথা বৃদ্ধাশ্রমে উঠেছেন। একেই বলে নিয়তি। নতুবা এমন সোনার সংসার ছেড়ে তাকে বৃদ্ধাশ্রমে আসতে হবে কেন?
এইতো গত ঈদেও তাঁর বাহুবন্ধনে ছিল আদরের নাতনী সামিয়া। পুত্র নাদিম আর পুত্রবধূ নীলা। তাদের সরব উপস্থিতিতে সুফিয়া খাতুনের ছোট্ট বাড়িটা যেন হয়ে উঠে ছিল বেহেস্তের বাগান।

সুফিয়া খাতুনের স্বামী আরিইফুর রহমান যখন রোড এক্সিডেন্টে মারা যান তখন সুফিয়া খাতুনের বাবা জনাব অাজমল সাহেব মেয়েকে অন্যত্রে বিবাহ দেয়ার জন্য বহু চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সুফিয়া খাতুন তাতে সম্মত হননি। ছেলে নাদিমের দিকে তাকিয়েই জীবনের বৃহৎ অংশ পার করে দেন। স্বামীকে হারিয়ে সুফিয়া খাতুন যতটা না কষ্ট পেয়েছেন, তার চেয়ে বহুগুণ কষ্ট সয়েছেন নাদিমকে বড় করতে। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা হয়েও যে তিনি ছেলেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন সেটা সত্যিই সাহসের ব্যাপার।

নাদিম এখন ভালো চাকরি করে। পুত্রবধূও চাকরিজীবী। সকাল অাটটায় ঘর থেকে নাদিম ও নীলা একসাথে বের হয়। এর কিছুক্ষণ পর বের হয় সামিয়া। সামিয়াকে স্কুলবাসে তুলে দেয়ার পরই সুফিয়া খাতুন একাকী হয়ে পড়েন। আগে অবশ্য একটা কাজের মেয়ে ছিল। তার সাথে সুখ দুঃখের কথা বলেই সময় পার করে দিতেন। কিন্তু ভাগ্যে তার এই সুখ বেশিদিন টিকল না। ঝরা বকুলের মতো শুকিয়ে গেছে পুত্রবধূ নীলার অতিবুদ্ধিতে।

একদিন কী এক বিষয়ে কথা হচ্ছিল নীলা আর নাদিমের। নাদিমকে কিছুটা উত্তেজিতই মনে হচ্ছিল। নীলা নাদিমকে চাপা স্বরে বলে-
তুমি শুধুশুধু আমার উপর রাগ করছো। অামি কি মায়ের শত্রু? অারে বাবা অামিতো মায়ের উপকারের জন্যই কথাটা বলেছি। শুয়ে বসে থাকলে ওনারইতো ক্ষতি। শুনলে না সেদিন ডাক্তার কি বলে গেল।
কী বলে গেছে?
একেবারে শুয়ে বসে না থেকে একটু নড়াচড়া করতে। টুকটাক কাজ করতে। তাহলে রোগব্যাধি সহজে আক্রমণ করতে পারবে না। তাছাড়া রান্নাবাড়া থেকে শুরু করে সংসারের সবকাজতো মা-ই তদারকি করে থাকেন। তো শুধুশুধু কাজের মেয়েটিকে পুষে অর্থাপোচয়ের কোনো মানে হয়? মা যখন টুকটাক কাজ করছেন, অার অামিও যদি মাকে সাহায্য করি তাহলে কাজের মেয়ের কোনো দরকার অাছে? ভেবে দেখো এর জন্য কতোগুলো টাকা গচ্চা যাচ্ছে। মেয়ে বড় হচ্ছে। ওর কথাটাওতো মাথায় রাখা দরকার। শেষের দিকে নীলা বোধদয় কথাগুলো একটু জোর অাওয়াজেই বলেছিল। সে জন্যই কথা গুলো শুনতে সুফিয়া খাতুনের কান পাততে হয়নি। পরদিন সুফিয়া খাতুন নিজেই কাজের মেয়েটিকে বিদায় করে দেন। ফলে ঘর মুছা থেকে শুরু করে কাজের মেয়ের সবগুলো কাজের দ্বায়িত্ব তিনাকেই নিতে হলো।
***
রাখবেন হরেক মাল..., বিশ টাকার হরেক মাল..., প্লাষ্টিকের হরেক মাল...!

সুফিয়া খাতুন ফেরিওয়ালাকে দেখে একটু অবাকই হলেন। একেতো অল্প বয়স, তার ওপরে মার্জিত ভুষন। স্বভাবজাত ফেরিওয়ালাদের মতো মনে হয় না। তাই ১৪-১৫ বছরের ছেলেটিকে তিনি কিছুতেই ফেরিওয়ালা হিসেবে মেনে নিতে পারছিলেন না। অগত্যা কৌতুহলকে দমন করতে ছেলেটি ডাকলেন-
এই, এদিকে এসো।
ছেলেটি বাড়িতে প্রবেশ করেই সুফিয়া খাতুনকে সালাম দেয়-
আসসালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুমুস সালাম। কীনাম তোমার?
আমার নাম কাশেম।
বাড়ি কোথায়?
বরিশাল।
বাড়িতে কে কে আছে?
সুফিয়া খাতুনের এই এক কথাতেই ছেলেটির উজ্বল মুখায়বে হটাৎ করে এক ধলা কালো মেঘে নেমে অাসে। অল্পক্ষণেই সেই মেঘ বারিধারায় রুপান্তরিত হয়ে গড়িয়ে পড়ে দু'চোখের কোন বেয়ে।
এ্যাঁকি তুমি কাঁদছো কেন? দুঃখিত, তোমাকে বোধহয় কষ্ট দিয়ে ফেললাম।
না না। আসলে হঠাৎ মায়ের মুখটা মনে পড়ে গেলতো তাই...
তোমার মা নেই?
না। আসলে এই পৃথিবীতে আমার আপনজন বলতে তেমন কেউই নেই। রাক্ষসী নদী আমার সব খেয়েছে। বাবা-মা,ভাই-বোন সব। সবাইকে আমার থেকে কেড়ে নিয়েছে।
যদি কিছু মনে না করো তাহলে একটা কথা বলি?
জ্বি বলুন।
না মানে কীভাবে এই দুর্ঘটনাটা ঘটলো?

গ্রামের বাড়ি বরিশাল হলেও আমরা ঢাকাতেই থাকতাম। বাবা-মা দু'জনেই গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। ছোট ভাইটা পড়তো ক্লাশ থ্রি আর বোনটা পড়ত ওয়ানে। ঈদের ছুটিতে বাবা-মা আর ভাই-বোনদের গ্রামের বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি দেখে আমি ঈর্ষান্বিত হলেও কিছুই করার ছিল না। কারণ আমার তখন জে এস সি'র প্রস্তুতি চলছিল। তাই ঈদের ছুটিতে অামার অার যাওয়া হলো না। ঢাকাতেই থাকতে হলো। ঈদ শেষে বাবা-মা ডাকায় ফিরছিলেন। আমিও অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন তারা আসবেন। কিন্তু কে জানত এমন এক দুঃসংবাদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। বিকেলবেলায় বন্ধুর বাসায় টিভি দেখছি এমন সময় টিভি স্ক্রিনে ভেসে উঠলো ব্রেকিং নিউজ। পদ্মায় লঞ্চ ডুবি। কাওড়াকান্দি থেকে মাওয়া আসার পথে আড়াইশ যাত্রী নিয়ে পদ্মায় পিনাক-৬ লঞ্চ ডুবির ঘটনা ঘটেছে। অামি অার স্থির থাকতে পারলাম না। চিৎকার করে বলি-
ও মোর আল্লাহ! ওই লঞ্চে যে মোর মা-বাপ, ভাই-বোইনও অাছে।

***
সেদিন দুপুরে নাদিম কিছু একটা খুঁজছিল। কিন্তু পাচ্ছিল না। নাদিমকে পেরেশান দেখে নীলা জিজ্ঞেস করে-
কী ব্যাপার? তোমাকে এতো অস্থির দেখাচ্ছে! জরুরি কিছু হারিয়েছে?
অামার ফাইলটা দেখেছো?
কই, নাতো।
কেন কী হয়েছে?
ওটাতে অফিসের একটা চেক ছিল। দশ লাখ টাকার।
দশ লাখ টাকা! কী বলছ এসব? মাকে জিজ্ঞেস করেছো?
কেন? মাকে জিজ্ঞেস করবো কেন?
আচ্ছা! আমার সব কথাতেই তুমি চটে যাও কেন? আমিতো এমন বলিনি যে মা-ই ওটা সরিয়েছেন। এমনওতো হতে পারে ওটা তুমি মনের ভুলে কোথাও রেখে গিয়েছিলে অার মা সেটা যত্ন করে রেখে দিয়েছেন।
তাহলে মা নিশ্চয় আমাকে জানাতেন।
হয়তো মনে নেই। একবার জিজ্ঞেস করলে কী এমন পাপ হয়ে যাবে?
মুখে লাগাম দাও নীলা। এ প্রসঙ্গে আমি আর একটা কথাও শুনতে চাই না। এ কথা বলেই নাদিম অফিসে চলে যায়। তার কিছুক্ষণ পর নীলাও হন হন করে বেরিয়ে পড়ে। সব শুনে সুফিয়া খাতুন আঁচলে চোখ মুছেন। জানালা খুলে আকাশের দিকে তাকান। অাকাশেরও যেন মন ভালো নেই আজ। ছাই রঙা মেঘের অাবরণে পুরো আকাশটাই কেমন অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। সুফিয়া খাতুন অাকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আনেন। এমন সময় একটা মোহময় শব্দ তিনার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে। শব্দের উৎস সন্ধানে তিনি নিচে তাকান। তখনই নজরে পড়ে সেই ফেরিওয়ালা ছেলেটিকে।
দাদিমা কেমন অাছেন?
ছেলেটি অনেক্ষণ থেকেই দাদিমা দাদিমা বলে ডাকছিল। কিন্তু অন্য মনস্কার কারণে সে ডাক তিনি শুনতে পাননি। সুফিয়া খাতুন ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।
আসসালামু আলাইকুম। দাদিমা কেমন আছেন?
আলহামদুলিল্লাহ। ভালো। তুই কেমন আছিস?
তোমার দোয়ায় ভালো আছি।
এর পর আরো অনেক কথা হয় তাদের মাঝে। কথার এক পর্যায়ে সুফিয়া খাতুন বলেন-
হ্যাঁরে, তোর কি পড়তে মন চায় না?
মনেতো চায়। কিন্তু তা কি আর সম্ভব হবে?
কেন হবে না?
টাকা পাবো কোথায়?
অামি যদি দেই।
তুমি টাকা দেবে! হ্যাঁ গো, সত্যিই কি তুমি অামাকে আবার পড়াবে?
ওমা! এতে অবাক হওয়ার কী আছে? তুই কি আমার পর?
***
বিছানায় শুয়ে শুয়ে নাদিম যখন হারানো চেকটার কথা ভাবছিল তখন পাশ থেকে নীলা মৃদৃ স্বরে বলে-
আমার মনে হয় চেকটা তোমার মা-ই নিয়েছেন।
মানে?
উত্তেজিত হচ্ছ কেন? আগেতো আমার কথা শোনো।
কী বলতে চাও তুমি?
বলছি, ওইযে ফেরিওয়ালা ছেলেটা...
হ্যাঁ, তো কী হয়েছে?
অামাকে কথা শেষ করতে দেবেতো?
ঠিক অাছে। বলো, অামি শুনছি।
নীলা পূণরায় বলা শুরু করে-
সেদিন ছেলেটিকে মা বলছিলেন যে, ওর পড়ালেখার জন্য যতো টাকার প্রয়োজন হয়, তিনি তা দেবেন। এও বলছিলেন যে, তাকে নাকি গ্রামের বাড়িতে ঘরদোরও করে দেবেন। তো তুমিই বলো এতো টাকা তিনি পাবেন কোথায়?
নীলার যুক্তিতে নাদিম কেমন চুপসে যায়।

পরদিন সকালে সুফিয়া খাতুন স্বামীর দেয়া গহনাগাঁটি নিয়ে জুয়েলারিতে যান। তার পর সেখান থেকে যান ব্যাংকে। বাসায় ফিরে সুফিয়া খাতুন থ হয়ে গেলেন নীলা- নাদিমের কাণ্ড দেখে। নীলা ও নাদিম মিলে সুফিয়া খাতুনের ঘরকে লণ্ডভণ্ড করে ফেলছে। কী যেন খুঁজছে দু'জনে। তিনি ছেলেকে ডাক দেন-
নাদিম!
হ্যাঁ.., কে?
নাদিম ভুত দেখার মতো চমকে উঠে।
তোরা আমার ঘরে কী খুঁজছিস?
না মানে... মানে... মানে ওই ফাইলটা...।
নাদিম আর সামনে বাড়তে পারে না। কোনোরকমে মায়ের ঘর থেকে বের হয়ে সোজা রাস্তায় হাটা ধরে।

এদিকে সুফিয়া খাতুন নিজেকে বিশ্বাসই করাতে পারছিল না যে, তারই গর্ভজাত সন্তান তাকে চোর বলে সন্দেহ করছে। সুফিয়া খাতুনের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠে। অস্পষ্ট স্বরে বলেন-
আয় অাল্লাহ! এও কী ছিল আমার কপালে?
***
আব্বু...! আব্বু...! জলদি উঠো।
নাদিম চোখ কচলিয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করে-
কিরে সামিয়া! কী হয়েছে?
আব্বু তোমার চেকটা পাওয়া গেছে।
কী বলছিস! কোথায় পেলি?
আম্মুর ব্রিফকেসে।
সামিয়া নাদিমের দিকে চেকটা বাড়িয়ে ধরে। কিন্তু নাদিম তা হাতে নিল না। এক লাফে বিছানা ছেড়ে মায়ের ঘরের দিকে দৌর দেয়। কিন্তু ততোক্ষণে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। অর্থাৎ ঘরে ঢুকে নাদিম অার মাকে পেল না। পেল শুধু দশলাখ টাকা অার একটি চিঠি। নাদিম চিঠির ভাঁজ খুলে তাতে চোখ রাখে-
বাবা নাদিম!
বিশ্বাস কর আমি তোর টাকা চুরি করিনি। মা কি ছেলের টাকা চুরি করতে পারে? পারে না। কারণ কোনো মা-ই তার সন্তানের ক্ষতি চায় না। অামিও চাই না। আমি জানি এ মুহুর্তে তোর দশলাখ টাকার প্রয়োজন। তাই আমি তোর বাবার দেয়া গহনাগুলো বিক্রি করে অার আমার সঞ্চিত টাকাগুলো মিলিয়ে দশলাখ টাকা রেখে গেলাম। জানিস বাবা! তোদেরকে নিয়ে অামি কতো স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু আমার জানা ছিল না মায়েরা বৃদ্ধা হয়ে গেলে স্বপ্ন দেখা অপরাধ। সেই অপরাধটাই যে অামি করেছি। তাই যদি পারিস তাহলে এই বৃদ্ধাটকে ক্ষমা করে দিস। তোদের ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছেরে। অবশ্য কষ্ট হওয়ারই কথা। এতোদিনের সংসারতো তাই কেমন যেন একটা মায়া পড়ে গেছে। কিন্তু তবুও যে আমাকে যেতেই হবে। কেন না আমার স্থান যে এখানে নয়। বৃদ্ধাশ্রমে। তাই আমি চললাম আমার গন্তব্যে। তোরা ভালো থাকিস। বিদায়...

লেখক : গল্পকার ও প্রাবন্ধিক


সম্পর্কিত খবর