রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


মধ্যপ্রাচ্য দ্বন্দ্বে বিপুল জনসমর্থনে ভাসছে কাতার: ১০ দিন পর কী হবে?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

এ এস এম মাহমুদ হাসান
বিশেষ প্রতিবেদক, আওয়ার ইসলাম

চলতি জুনের ৫ তারিখে কাতারের উপর সৌদি জোটের একাংশ বয়কটের ঘোষণা দিলে শুরুতে এই বয়কটকে সাময়িক মনে হলেও ধীরে ধীরে এ বয়কট বৈশ্বিক রাজনীতিকেই পাল্টে ফেলছে। কাতারের উপর সন্ত্রাসী লালনের তকমা দিয়ে শুরু করা সৌদির এ অসহিষ্ণু বয়কটকে মোটেই ভালো চোখে দেখছে না বিশ্ব মুসলিমের বড় একটি অংশ। এমনকি এতদিন সৌদি যাদের ঘরোয়া মিত্র মনে করত, তারাও সৌদির এ অপরিণামদর্শী বয়কটের সঙ্গে একমত হতে পারেনি। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে এ বয়কটে শরীক হওয়ার আহবান জানালেও মূলত উপসাগরীয় মাত্র ৪টি দেশ ছাড়া সৌদির ডাকে সাড়া দেয়নি কোনো মুসলিম রাষ্ট্র।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কাতারকে এ অবরোধের মাধ্যমে মূলত সৌদি জোটই ক্ষতিগ্রস্থ হলো বেশি। মুসলিম বিশ্বে এ বয়কটের কারণে সৌদি জোটের প্রতি খারাপ ধারণা জন্ম নিয়ছে। বিশেষ করে একটি সার্বভৌমে দেশকে ১৩ দফার যে লিস্ট চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা সৌদি জোটকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে ফেলবে। কেননা একটি স্বাধীন দেশকে কোনো ভাবেই ১৩ দফার ১ দফাও চাপিয়ে দেওয়ার কোনো রাষ্ট্রের নৈতিক অধিকার নেই। এদের শর্তগুলো দেখলে মনে হবে সৌদিজোট এই যুগে নয়; বরং মধ্যযুগে বসবাস করছে, যখন ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো গায়ের জোরে তাদের ইচ্ছা আরেক দেশের উপর চাপিয়ে দিতো। কাতারকে শর্ত দেয়া হয়েছে, এ ১৩ শর্ত গোপন রাখতে হবে। কিন্তু কাতার যখন সেগুলো ফাঁস করে দেয় তখন আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, কাতার আমাদের দাবিগুলো ফাঁস করে মূলত সংকট সমাধানের পথকেই রুদ্ধ করে দিলো। এ থেকে স্পষ্ট, সৌদিজোটের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য বিপ্লবের ভয় এখনো কাটেনি।

যখন মধ্যপ্রাচ্যকে ঘিরে ইরান, রাশিয়া জোটের কৃত্রিম নিয়ন্ত্রণ আর মার্কিন মূলুকের নেতৃত্বে সৌদিজোটের ক্ষমতার অপব্যবহারে পুরো মধ্যপ্রাচ্যই আগুনের কারাগারে রূপান্তর হয়েছে। ঠিক তখনি উদার ভাবাপন্ন মুসলিম রাষ্ট্র কাতারকে বয়কটের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের লেলিহান শিখাকে উষ্কে দেওয়ার অভিযোগ শুধু সৌদিজোটের বিরুদ্ধে নয়, এ অভিযোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসলাইলের উপরও।

রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে প্রাসাদ ক্যু এর মাধ্যমে বিন নায়েফকে সরিয়ে দেয়ায় এটি আরো স্পষ্ট যে, সৌদি জোটের এ অনভিপ্রেত সিদ্ধান্তগুলো একান্তই সৌদিজোটের নয়, বরং এ সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলি দুষ্টচক্রের সিদ্ধান্ত। কারণ আল জাজিরা বলছে, বিন নায়েফ দৃশ্যত কাতারের উপর বয়কটের বিরোধী ছিলেন। বিন নায়েফ সৌদি রাজ পরিবারে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়া সত্বেও খুব সহজেই সৌদি বাদশাহ তাকে রাষ্ট্র ক্ষমতা ও ক্রাউন প্রিন্সের চেয়ার থেকে সরাতে পেরেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের ইন্ধনে।

অপর দিকে অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলো সৌদিজোটের আহবানে সাড়া না দিয়ে নিরপেক্ষ থাকার ভান করলেও এটিকে দেখা হচ্ছে কাতারের প্রতি সর্ম্থন হিসেবেই। এই জোটের বাইরে মুসলিম দেশ হিসেবে তুরষ্ক ও ইরান ঘোষণা দিয়েই সৌদি জোটের সিদ্ধান্ত, বয়কট ও শর্তগুলোর বিরোধিতা করেছে। এমনকি তুরষ্ক ও ইরান কাতারকে রক্ষা ও যে কোনো সাহায্যের জন্য প্রস্তুত বলে অভয় দিয়েছে।

মূলত ইসলামের আবির্ভাব ও তার রক্ষণাবেক্ষনের কেন্দ্রভূমি, রাসুল সা. এর জন্মভূমি, অপরাপর নবীদের আগমনস্থল ও বিশ্ব মুসলিমের সবচেয়ে তীর্থ, পবিত্রস্থান মক্কানগরীর স্বার্থে সৌদি আরবের প্রত্যক্ষ কটাক্ষ, ও রাষ্ট্রীও সমালোচনা, না করলেও বিপুল জনসমর্থন চলে গেছে সৌদির বিরুদ্ধে। এটিকে সৌদির নৈতিক পরাজয় হিসেবেও দেখছেন বিশ্লেষকরা।

এদিকে উপসাগরীয় সৌদি জোটের ৪টি দেশেই কাতার নিয়ন্ত্রিত আল জাজিরা প্রদর্শন ও তাদের ওয়েবসাইট বন্ধ হলেও বর্তমানে আল জাজিরা চ্যানেলের রেটিং বেড়েছে স্মরণ কালের সবচেয়ে বেশি। আল জাজিরা বলছে, মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দাঙ্গা হাঙ্গামায় সৌদি জোটের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও মুসলিম বিশ্বকে বিভক্ত করে ইঙ্গ-মার্কিনি স্বার্থ সংরক্ষণে মরিয়া সৌদি জোটের প্রতি আক্ষেপ জন্মেছে বিশ্ব মুসলিমের। অপর দিকে কাতার বৈশ্বিক ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে উভয়পক্ষের এ সন্ত্রাসী কার্যকলাপে একমত হতে না পারায় সৌদিজোটের বিরাগভাজন হয়ে পড়ে কাতার। আর স্বভাবতই কাতারের এ রাষ্ট্রীয়নীতির সাথে আল জাজিরা একমত পোষণ করে নিউজ কাভার করলে দর্শকপ্রিয়তা পায় আল জাজিরা।

এছাড়া সৌদি জোটের কাতারকে ছুড়ে দেওয়া ১৩টি শর্তের একটি হলো আল জাজিরা বন্ধ করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, আরব বিশ্বের নেতারা কেন আল জাজিরাকে ঘৃণা করছেন। আল জাজিরায় প্রচারিত ‘কল ইন শো’ নামে একটি অনুষ্ঠানে মিসরের প্রখ্যাত আলেম ইউসুফ আল-কারযাভি সরাসরি ফোনালাপে দর্শকদের বিভিন্ন জিজ্ঞাসার শরীয়ত ভিত্তিক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকেন। এ অনুষ্টানটি কয়েক বছরের মধ্যে লাখ লাখ দর্শকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ধর্মীয় নেতা হিসেবে পরিচিত ইউসুফ আল-কারযাভি মুসলিম ব্রাদার হুড বা ইখওয়ানুল মুসলিমিনের ধর্মীয় নেতা হিসেবে বিবেচিত।

আল জাজিরা প্রতিষ্ঠিত হবার আগে এধরনের অনুষ্ঠান আরব বিশ্বের মিডিয়ায় অস্বাভাবিক ছিল। কারণ আরব বিশ্বে রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে মিডিয়া কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রর করা হত। কিন্তু আল জাজিরা এ নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেয়ে অনেক খোলামেলা বিষয়ে, যাদের কথা মিডিয়া বলে না, সে সব মানুষের কথাও তুলে ধরে মিডিয়াটি। যার ফলে আল জাজিরা আরব বিশ্বের অনেক স্বৈরশাসকের অপছন্দের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আরব বসন্ত, মিসরে তাহরীর স্কয়ারের বিপ্লব থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের শাসকদের দানব ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আল জাজিরা চ্যানেলটি। যার ফলে সৌদি জোটের ভীতি ও ঘৃণা জন্মায় জনপ্রিয় আল জাজিরার প্রতি।

লেখক

একদিকে আল জাজিরা যেমন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় তেমনি শত্রুদেরও নজর কাড়ে। আরব বিশ্বে স্বৈরশাসক বা রাজতন্ত্রের মত শাসন, বৈষম্য, শোষণসহ বিশেষ করে সৌদি আরব ও মিসরের শাসকদের কাছে আল জাজিরা অনুষ্ঠানগুলো নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তারা চাননা তাদের জনগণ এসব বিষয় নিয়ে আল জাজিরা অনুষ্ঠান দেখুক।

আর সেই থেকেই সৌদি জোটের ক্ষমতা হারাবার ভয়ে যত দুশ্চিন্তা থেকে কাতার বয়কটের সূত্রপাত।

ইতোমত্যে কাতার সৌদি জোটের দেওয়া শর্তগুলো না মানার ঘোষণা দিয়েছে। কাতার বলছে, এটা আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতির উপর আঘাত। আমাদের সার্বভৌম ক্ষমতার উপর কারো খবরদারী করার এখতিয়ার নেই।

কিন্তু এখন দেখার বিষয় হলো, সৌদি জোটের বেঁধে দেওয়া ১০ দিন সময়ের পরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলোর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কি হয়! এবং অপরাপর শক্তিশালী রাষ্ট্র ও বৃহত মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা কি হয়। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, সৌদি জোটের বিরুদ্ধে তুরষ্ক ও ইরানের নেতৃত্বে অপরাপর মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর জোট হতে পারে। সাথে সাথে এখন পর্যন্ত শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো মধ্যপাচ্যের এ সংকটে প্রত্যক্ষভাবে নাক না গলালেও শর্তের বেধে দেওয়া সময় শেষ হওয়ার পর বিশ্বশক্তির মেরুকরণ হতে পারে। এতে সংকট নিরসনের চেয়ে ভয়াবহ সংকট ঘনীভূত হবে এবং সমস্যার জটলা বাঁধবা। বাকীটা সময় হলেই বুঝা যাবে।

আমাদের জানতে হবে, মধ্য প্রাচ্যের এহেন অপরিণামদর্শি পরোক্ষ যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় বিশ্বের অপরাপর রাষ্ট্রগুলোর সাথে সাথে বিশ্ব মুসলিমের মতামত ও তাদের চিন্তা চেতনার পর্যবেক্ষণ কী? বিশ্বের খ্যাতিমান বিবিসি, রয়টার্স, সিএনএন, আল জাজিরাসহ প্রায় সবগুলোর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর অফিসিয়াল পেজে চলছে সৌদিজোটের পোষ্টমর্টেম। তীর্যক মন্তব্য আর মার্কিন-ইসলারাইলি স্বার্থ রক্ষার এ বয়কটে তুলোধুনো করা হচ্ছে সৌদি নেতৃত্বকে। যদিও পেজগুলোতে সৌদি জোটের ৪টি দেশের নাগরিকরাই তাদের প্রতিক্রিয়াগুলো জানাতে পারছে না কোনো মাধ্যমকেই। কেননা তাদের প্রতিক্রিয়া জানানোর উপর কঠোর রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। পেজগুলোতে সার্চ করলে দেখা যায়, প্রায় সব পাঠক সৌদি আরবের ব্যাপারে নেতিবাচক মন্তব্যে ছেয়ে ফেলেছে পেজগুলো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের প্রতিক্রিয়ার (লেখাটি সংক্ষিপ্ত করার জন্য) কয়েকটি নিচে তুলে ধরা হলো।

আলী আকতার নামে একজন লিখেছেন, সৌদির কর্মকান্ডে মনে হচ্ছে না যে, তারা মুসলিমদের পবিত্রস্থান কাবা ঘরের খাদেম। তারা মুসলিম বিশ্বের নেতা না। মনে হচ্ছে তারা ইসরাইলি রাষ্টের একটি বৃহত শাখা রাষ্ট।

দ্রাবিতান নামে আফ্রিকান একজন লিখেছেন, কাতার কি সৌদির কোনো উপশহর? কেননা কোনো রাষ্টের অঙ্গরাজ্যেও সৌদির দেওয়া ফরমান অচলযোগ্য। অঙ্গরাজ্যের উপরও এমন কড়া শর্ত কেন্দ্রীয় সরকার দিতে পারে না।

পাকিস্তানি সুলতান লিখেছে, রাজতন্ত্রধারীরা ইয়ামেন নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটাবে কাতারকে দিয়ে। কাতারে আগ্রাসন চালালে ইতিহাসের জঘন্য পাপ করবে সৌদি।

কাতারের অবরোধ তুলতে আল জাজিরা বন্ধসহ ১৩ শর্ত


সম্পর্কিত খবর