আতাউর রহমান খসরু : বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে গত ২০ জুন মঙ্গলবার। বরাবরের মতো এবার ঈর্ষণীয় ফলাফল করেছে মাদারীপুর জেলার শিবপুরে অবস্থিত জামিয়াতুস সুন্নাহ। এবার বেফাকের কিতাব বিভাগের চারটি মারহালায় মোট ২২৭টি বোর্ড স্ট্যান্ড পেয়েছে জামিয়াতুস সুন্নাহ। ফযীলত বা মেশকাতে ১ জন, সানাবিয়া উলয়া বা শরহে বেকায়ায় ৪ জন, মুতাওয়াসসিতা বা নাহবেমিরে ৯৩ জন, ইবতিদায়্যাহ বা তাইসিরে ১২৭ জন শিক্ষার্থী বোর্ড স্ট্যান্ড করেছে।
১৯৯০ সালে মাদরাসার প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ছিলো জামিয়া মোহাম্মাদিয়া ফয়জুল উলুম। ২০০০ সালে আল্লামা মাহমুদুল হাসানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বৃহৎ পরিসরে জামিয়ার বর্তমান ঠিকানায় স্থানান্তরিত হয়। এরপর আল্লামা মাহমুদুল হাসানের তত্ত্বাবধান ও শিল্পপতি আলহাজ্জ বাদশাহ মিয়ার উদার সহযোগিতায় জামিয়ার আজকের মহীরূহ অবকাঠামো গড়ে উঠেছে।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকে জামিয়া বেফাকে ভালো ফলাফলের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে আসছে। আর তা কিভাবে সম্ভব হলো জানতে জামিয়ার প্রিন্সিপাল মাওলানা নেয়ামতুল্লাহ ফরিদীর কাছে। তিনি পাঁচ বছর যাবৎ জামিয়ার পরিচালনায় রয়েছেন। তিনি বলেন, মাদরাসার শিক্ষকগণ শতভাগ আবাসিক। তারা ছাত্রদের সার্বক্ষণিক নেগরানি করেন। শিক্ষকদের নিবিড় পরিচর্যা ও তত্ত্বাবধানই ভালো ফলাফলের মূল রহস্য।
‘সাথে সাথে আমাদের মাদরাসায় ঠিক মতো ক্লাস হয় এবং ক্লাসে সবক বুঝে নেয়া হয়। ছাত্ররাও শিক্ষকদের প্রত্যাশা অনুযায়ী পরিশ্রম করে।’ যোগ করেন মাওলানা ফরিদী।
ভালো ফলাফলের জন্য ভালো ছাত্র নির্বাচন করা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ? উত্তরে তিনি বলেন, ভালো ফলাফল তো ভালো শিক্ষার্থীদের মাধ্যমেই হয়। ছাত্র নির্বাচন যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমরা প্রত্যেক জামাতে ছাত্র ভর্তির সময় সবচেয়ে যোগ্য ছাত্রদের নির্বাচনের চেষ্টা করি। তবে শুধু পরীক্ষা ভালো করবে এমন ছাত্র খুঁজি না। বরং ভালো কিতাব বোঝে, আমল আখলাক ভালো এমন ছাত্রকেই আমরা প্রাধান দেই।
মাওলানা নেয়ামতুল্লাহ ফরিদী জানান জামিয়াতুস সুন্নাহ কিভাবে ছাত্রদের প্রস্তুত করে; বিশেষত পরীক্ষার জন্য। ‘ভর্তির জন্য যে ন্যূনতম মার্কস পাওয়া আবশ্যক, তা পেলেই আমরা ছাত্রদের ভর্তি করিয়ে নেই। তা কিন্তু একশো তে আশি নয়। এরপর ছাত্রদের পেছনে আমরা সর্বোচ্চ শ্রম ব্যয় করি। শিক্ষকদের শ্রম ও ছাত্রদের আন্তরিক চেষ্টায় একজন ছাত্র ধীরে ধীরে যোগ্য হয়ে ওঠে। একটি ছেলে যে মাকবুল (পাশ মার্কস পাওয়া) পর্যায়ের যোগ্যতা নিয়ে ভর্তি হওয়ার ছয় মাস পর তার যোগ্যতা জায়্যিদ জিদ্দান পর্যায়ে পৌঁছে যায়। আলহামদুলিল্লাহ!’
তিনি মনে করেন, শ্রেণি কক্ষই একজন ছাত্রের যোগ্য হওয়ার মূল কারখানা। শ্রেণি কক্ষে দুর্বলতা থাকলে অন্য প্রচেষ্টায় ছাত্রদের যোগ্য হওয়া কঠিন। তাই তিনি শ্রেণি কক্ষের উপরই সবচেয়ে গুরুত্ব দেন। সময় মতো ক্লাস হওয়া, ছাত্র-শিক্ষকের উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং পাঠদান ও গ্রহণ সন্তোষজনক হচ্ছে কিনা তিনি নিয়মিত খোঁজ নেন। মাদরাসার সার্বিক লেখাপড়া ও তরবিয়্যাত পর্যালোচনার জন্য প্রতি সপ্তাহে উস্তাদদের মিটিং অনুষ্ঠিত হয়।
বেফাকভূক্ত জামাতের জন্য আলাদা কোনো প্রস্তুতি ও প্রচেষ্টা আছে কিনা জানতে চাইলে জামিয়াতুস সুন্নাহ-এর প্রিন্সিপাল বলেন, ‘আমি যাওয়ার পূর্বে জামিয়ার একটি বদনাম ছিলো যে, বেফাকের জামাতে ভালো লেখাপড়া হয় এবং অন্য জামাতে তেমন হয় না। আমি এসে সব জামাতে যেনো সমান গুরুত্বে লেখা পড়া হয় তার উপর গুরুত্ব দেই। আলহামদুলিল্লাহ! সব জামাতে সমমানের লেখাপড়া হয়।’
তবে হ্যা, কোনো প্রস্তুতিই যে আলাদা করে নেয়া হয় না, তাও নয়। ‘সাধারণভাবে সব জামাতেই সাপ্তাহিক পরীক্ষা আছে। এর বাইরে বেফাকভূক্ত জামাতে দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার পর একটি মডেল টেস্ট হয়। এ টেস্টের পূর্বে ছাত্ররা ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে।’
তাহলে যেসব মাদরাসায় বেফাকের প্রশ্ন সামনে রেখে পড়ানো হয়, দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার ভেতর কিতাব শেষ করে প্রশ্নের অনুশীলন করা হয় তাদের ব্যাপারে কি বলবেন? মাওলানা ফরিদী বললেন, ‘নিঃসন্দেহে এটা নিন্দনীয়। কওমি মাদরাসার মূল লক্ষ্য যোগ্য আলেম তৈরি করার পথে এমন মানসিকতা বড় বাঁধা। প্রথমে পুরো কিতাব বুঝবে এবং ভালোভাবে আত্মস্থ করবে। তারপর অনুশীলন করবে।’ তিনি মনে করেন, অনুশীলনের জন্য তিন সপ্তাহ থেকে এক মাস সময়ই যথেষ্ট।
এ সময় বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন গাইড বইয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘মূল ইবারত থেকে কিতাব বোঝা ও আত্মস্থ করা মূল বিষয়। এটা হয়ে গেলো পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য বাড়তি সহায়তা ছাত্ররা অন্য কোথাও থেকে নিতে পারে। কিন্তু পড়ালেখার মূল ভিত্তিই যদি হয় বাংলা গাইড তবে তা অবশ্যই পরিহারযোগ্য। শিক্ষকদের উচিৎ ছাত্রদের গাইড বিমুখ করা।’ শিক্ষক নির্দেশ দিলে ছাত্ররা তা মানবে এটাই বিশ্বাস করেন জামিয়াতুস সুন্নাহ-এর প্রিন্সিপাল মাওলানা নেয়ামতুল্লাহ ফরিদী।
-এআরকে