শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


শান্তির জন্য প্রয়োজন হিলফুল ফুযুলের আদলে আন্তর্জাতিক শান্তিসংঘ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

শামসীর হারুনুর রশীদ
লেখক : মুহাদ্দিস ও প্রাবন্ধিক
আবহমান বিশ্বে যে পরিমাণ মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে তাতে ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত 'সর্বজনীন মানবাধিকার' অকার্যকর হয়ে পড়েছে অনেক আগেই। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের ওপর দিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চর্চা কী অনেক পরেও মুসলিম বিশ্বকে ভাবিত করছে।
আমাদের চোখের সামনে বার্মা-কাশ্মীর-ফিলিস্তিন-সিরিয়া-ইরাক-আফগান-ভারত-লিভিয়া এমনকি খোদ মুসলিম দেশের জালিম সরকার স্বীয় নাগরিকদের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়ে নোংরা নজির স্থাপন করেই চলছে! ফলে এথেকে উত্তরণে ফিরে থাকাতে হবে বিশ্বমানবতার শান্তিদূত হযরত মুহাম্মদ সা.'র দিকে। আমাদের মহানবী সা. এমন একটি সময় আরব ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যখন আরব সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা বিরাজ করছিল।
এ সমাজে ছিল না কোনো নিয়মনীতি ও আইনের শাসন। গোত্রীয় কলহ, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, সামাজিক শ্রেণিভেদ, নারী নির্যাতন, ব্যভিচার, সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া প্রভৃতি সমাজকে মারাত্মকভাবে কলুষিত করেছিল। ঐতিহাসিকরা আরবের এই সময়কে 'আইয়ামে জাহেলিয়া' বা 'অন্ধকার যুগ' বলে অভিহিত করেছেন। জাহেলিয়া যুগের এই রক্তপাত, অন্যায় ও অনাচার বালক মুহাম্মদ সা.-এর মনে গভীর রেখাপাত করে। তিনি সমাজের সব অন্যায়, অবিচার ও নির্যাতন বন্ধের উপায় খুঁজে বের করার জন্য সর্বদা চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। অবশেষে তাঁর মনে একটি অভিনব চিন্তার উদয় হলো। তিনি তাঁর সমবয়সী কতিপয় যুবককে নিয়ে 'হিলফুল ফুজুল' নামে একটি সংঘ গড়ে তুললেন। এ সংগঠন সমাজের সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। (আসলে নামটি হবে 'হালফুল ফুজুল'( حلف الفضول )
আরবি حلف শব্দের অর্থ শপথ, চুক্তি বা অঙ্গীকার। الفضول শব্দটির অর্থ কল্যাণ, শান্তি, মর্যাদা- সম্মান ইত্যাদি। অর্থাৎ হালফুল ফুযুল অর্থ কল্যাণের অঙ্গীকার বা শান্তিসংঘ ।) আরব সমাজের সব অন্যায় প্রতিরোধের লক্ষ্যে হিলফুল ফুযুল গঠিত হলেও একটি বিশেষ যুদ্ধের ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতে মহানবী সা. এ সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন বলে মনে করা হয়। এ যুদ্ধের নাম 'হরবুল ফুজ্জার' বা অন্যায় সমর।
সম্ভবত ৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে ওকাজ মেলার (মক্কার ওকাজ নামক স্থানে প্রতিবছর এই মেলা বসত) ঘোড়দৌড়, জুয়াখেলা ও কাব্য প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে পবিত্র জিলকদ মাসে মক্কার কোরাইশ ও হাওয়াজিন গোত্রের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়। আরবে পবিত্র জিলকদ মাস ছিল শান্তির মাস। এ মাসে আরব দেশে সব ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। তাই জিলকদ মাসে শুরু হওয়া এ যুদ্ধকে 'হরবুল ফুজ্জার' (মতান্তরে 'ফিজার') বা অন্যায় সমর বলা হয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর স্থায়ী এ যুদ্ধের ভয়াবহতা বালক মুহাম্মদ সা.-এর কোমল মনকে মারাত্মকভাবে ব্যথিত করে তোলে। এ যুদ্ধে অনেক লোক প্রাণ হারিয়েছিল। এ যুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ১৪ কিংবা ১৫ বছর (সিরাতে ইবনে হিশাম)। যদিও তিনি অস্ত্র হাতে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেননি; কিন্তু এই যুদ্ধের বীভৎসলীলা দেখে বালক মুহাম্মদ সা. অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন এবং আরববাসীদের এরূপ ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে ভাবতে থাকেন। আরবে শান্তি বজায় রাখার জন্য তিনি একটি শান্তিসংঘ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে সমমনা নিঃস্বার্থ কিছু উৎসাহী যুবক ও পিতৃব্য জুবাইরকে নিয়ে তিনি এ শান্তিসংঘ গঠন করেন। এ সংঘের চারজন বিশিষ্ট সদস্য ফজল, ফাজেল, ফজায়েল ও মোফাজ্জেলের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছিল 'হিলফুল ফুজুল'। এ সংঘের কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ : (১) দেশে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা, (২) বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সদ্ভাব ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করা, (৩) অত্যাচারিতকে অত্যাচারীর হাত থেকে রক্ষা করা, (৪) দুর্বল, অসহায় ও এতিমদের সাহায্য করা, (৫) বিদেশি বণিকদের জান ও মালের নিরাপত্তা বিধান করা এবং (৬) সর্বোপরি সব ধরনের অন্যায় ও অবিচার অবসানের চেষ্টা করা। এ শান্তিসংঘ প্রায় ৫০ বছর ধরে স্থায়ী হয়েছিল।
এভাবে মুহাম্মদ সা. মানুষের কল্যাণের জন্য আত্মনিয়োগ করেন এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত হিলফুল ফুজুলই বিশ্ব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কল্যাণী সেবাসংঘের মর্যাদা লাভ করে। এভাবে হজরত মুহাম্মদ সা. নবুয়তপ্রাপ্তির আগেই শান্তির অগ্রদূত হিসেবে পৃথিবীর বুকে আত্মপ্রকাশ করেন। জাহেলি যুগে আরব সমাজের অন্যায়, অবিচার প্রতিরোধ করার জন্য হিলফুল ফুজুল গঠিত হলেও মহানবী সা.-এর নেতৃত্বে গঠিত এ সংগঠনটির শিক্ষা সর্বকালের, সর্বসমাজের যুবকদের জন্য একটি আদর্শ শিক্ষা ও পথনির্দেশক হয়ে রয়েছে।
বর্তমান যুগে জাহেলি যুগের মতো কলুষিত সমাজ পরিলক্ষিত না হলেও পৃথিবীর সব দেশে, সব সমাজেই এখনো বহু অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্য রয়ে গেছে। এখনো সমাজে বহু মানুষ নিপীড়িত, নির্যাতিত ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এখনো সমাজে হত্যা, নারী নির্যাতন, সুদ, ঘুষ প্রভৃতি অসামাজিক কাজ কম-বেশি প্রচলিত রয়েছে। হিলফুল ফুযুলের মতো সংগঠিত হয়ে যুবসমাজ আজও সমাজের সব অন্যায় প্রতিরোধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
এই সংঘের তথ্য ও তত্বে ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। ফিকহুস সিরাহ গ্রন্থকারের মতে- ইসলামে বছরের চারটি মাস অতিশয় পবিত্র ও সম্মানিত। এগুলো হলো জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। আরবদের কাছেও সুদীর্ঘ অতীত থেকে মাস চারটি সম্মানিত ও পবিত্র গণ্য হতো। এই চার মাসে যুদ্ধবিগ্রহ ও রক্তপাত হারাম। কিন্তু এই সম্মানীয় মাসের পবিত্রতা লঙ্ঘিত হয়েছিল পরপর চার বছরের যুদ্ধে। এজন্য আরবরা এই যুদ্ধের নাম দিয়েছিল হারবুল ফুজ্জার বা পাপবিদ্ধ লড়াই।
মহানবী সা. এর বয়স যখন বিশের কোটায় তখন কোরাইশদের মধ্যে এ অন্যায় রক্তপাতের বিরুদ্ধে চেতনা তীব্রতর হয়। যুদ্ধে দুই পক্ষের নিহত লোকদের সংখ্যার তুলনায় প্রতিপক্ষে নিহতের অতিরিক্ত সংখ্যার জন্য রক্তপণ আদায় করে কোরাইশরা। এভাবে ফুজ্জারের যুদ্ধ সমাপ্ত হয় শাওয়াল মাসে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সমাজে জননিরাপত্তা চরমভাবে ভেঙে পড়েছিল আগে থেকেই। বিশেষভাবে দুর্বল ও মজলুম মানুষের জীবন হয়ে উঠেছিল চরম দুর্বিষহ। বাইরে থেকে কাবাঘর জিয়ারতে যারা আসত, তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও ভাবিয়ে তোলে সবাইকে।
দীর্ঘ চার বছর স্থায়ী যুদ্ধও ছিল জননিরাপত্তা লঙ্ঘনের একটি ঘটনার ভয়াবহ পরিণাম। কাজেই কোরাইশ নেতারা চিন্তা করলেন আমাদের মজলুম মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। প্রথম যে ব্যক্তি প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন তিনি ছিলেন নবী করিম সা. এর চাচা জুবাইর ইবনে আবদুল মোত্তালিব। নবী করিম সা. এই চুক্তির স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি আমার চাচাদের সঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনে জাদআনের ঘরে একটি অঙ্গীকারের সময় উপস্থিত ছিলাম। এই চুক্তির বিনিময়ে আমাকে লালবর্ণের উটনী দেয়া হলেও আমি তা পছন্দ করব না। যদি ইসলামের যুগে এই চুক্তির আওতায় আমাকে কোনো আIহবান জানানো হয়, আমি সে ডাকে সাড়া দেব। (ফিকহুস সিরাহ, পৃ. ৭২)।
আল্লামা নুবাইরির বর্ণনায় অঙ্গীকারটি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা যায়। জুবাইর ইবনে মুতএম বলেন, রাসূলে পাক সা. বলেন, আমাকে যদি লালবর্ণের উটও দেয়া হতো, তবুও ইবনে জুদআনের ঘরে যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল এবং তাতে আমি উপস্থিত ছিলাম, তা ভঙ্গ করা আমি পছন্দ করতাম না। সেই চুক্তিতে বনি হাশিম, বনি জুহরা ও বনি তিম গোত্রগুলো এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল যে, তারা সব সময় মজলুমের সাহায্য করবে।
মজলুমদের মধ্যে কেউ যদি সেই চুক্তির বরাতে এখনও আমার কাছে সাহায্য চায়, আমি তাকে অবশ্যই সাহায্য করব। চুক্তিটি ছিল হিলফুল ফুজুল। (নুুবাইরি : পৃ. ১/১০১)। ইবনে হিশাম বলেন, তারা এই মর্মে অঙ্গীকার ও চুক্তিবদ্ধ হয় যে, মক্কার অধিবাসী বা অন্য জায়গার কোনো মজলুম মানুষ যদি মক্কায় প্রবেশ করে, তাকে তারা সহায়তা দেবে এবং যে ব্যক্তি তার ওপর জুুলুম করবে, তার সঙ্গে তারা লড়াই করবে, যতক্ষণ না মজলুমের হক উদ্ধার হয়। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/১৪১)।
ওয়াকেদি বলেন, জুরহুম সম্প্রদায়ের কয়েকজন লোক, যাদের নাম ছিল ফজল, ফুজালা, ফেজাল ও মুফাজজাল, তারা এ ধরনের চুক্তি সম্পাদন করেছিল। কাজেই কোরাইশরা এই চুক্তি সম্পাদনের সময় তাদের নামানুসারে এর নামকরণ করে। (আল আগানি : ১৬/৭০)। (অসমাপ্ত) ১৮/ ০১/ ১৭
আজো পৃথিবীর বুকে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য বিশ্ব নবীর প্রতিষ্ঠিত হিলফুল ফুযুল হতে পারে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
এসএস/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ