মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ
ইসলামের দাওয়াত ও আহবান মানুষের কাছে পৌঁছানো দায়ি ও আলেম সমাজের দায়িত্ব। একইভাবে সমকালে ইসলাম, ইসলামি মহল, ইসলামি প্রতিষ্ঠান, ইসলামি চিন্তা-ভাবনা এসবের উপর ইসলামবিরোধীদের আপত্তি, আক্রমণ, প্রশ্ন ও অভিযোগের উত্তর দেয়াও আলেম সমাজের দায়িত্ব। দাওয়াহ, উত্তর প্রদান, প্রতিবাদ কিংবা ইতিবাচক বিকল্প চিন্তার উপস্থাপন জাতীয় পরিসরে করাও বড় ব্যাপার।
আজ থেকে তিন বা চার দশক আগে যে বিষয়গুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলোচনা করলে, উপস্থিত জনসমাগমে কথা বললে অথবা এক হাজার দুই হাজার মানুষের কাছে তা লিখিত আকারে তুলে দিলে বিষয়টির সমাধান হয়ে যেতো। দায়িত্ব আদায় হয়ে যেতো। এখনকার পরিস্থিতি ঠিক সে জায়গায় নেই। প্রতিটি দাওয়াহ, প্রতিটি প্রতিবাদ, প্রতিটি বিকল্প সুস্থ্য চিন্তার উপস্থাপন ব্যাপক পরিসরে পৌঁছে দেয়া এখন আরও বেশি প্রয়োজন এবং একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জিংও বটে। বিষয়টি যদি এক দুই হাজার মানুষের কাছে পৌঁছে মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে ইসলামের উপর উত্থাপিত আপত্তি, প্রশ্ন ও বিরোধিতার বিষয়গুলো যেভাবে লাখো লাখো মানুষের কানে, মানুষের মগজে পৌঁছানো হয়, এর উত্তর প্রদানের বিষয়টিও যদি লাখো লাখো মানুষের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে তার কার্যকারিতা, প্রভাব ও সুপ্রতিক্রিয়াটি দুর্বল হয়ে যাবে।
এ ক্ষেত্রে সম্প্রতিককালের বড় মাধ্যম অনলাইন মিডিয়া। আমরা নিউজপোর্টাল বলি, ইউটিউব বলি বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বলি সবগুলোই অনলাইন মিডিয়া। বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহার করে লাখো লাখো মানুষের সাথে যোগাযোগের যেসব উপকরণ, আয়োজন ও ব্যবস্থা রয়েছে অল্প ব্যয়ের মধ্য দিয়ে, অল্প লোকবল নিয়োগের মাধ্যমে তা আলেম ও দায়ি সমাজের জন্য অনেক বড় অবলম্বনের বিষয় বলেই আমি মনে করি।
কারণ যে কোনো নতুন বা পুরাতন দাওয়াহ, বা ইসলামবিরোধী জবাব যদি কোনো অনলাইন পোর্টালে দিয়ে দেয়া হয়, তবে সেটা স্বল্প পরিসরে আসুক বা বড় পরিসরে আসুক, সাক্ষাৎকার হিসেবে, নিউজ হিসেবে বা কলাম হিসেবে আসুক বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে তা আপ করে দিলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে তা ধরতে পারছে, পড়তে পারছে। এ সুযোগ ও ব্যবস্থাটা খুবই সা¤প্রতিক ও কার্যকর। গত আট ও দশ বছর ধরে বাংলা ভাষায় এর চর্চা খুব ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে। দিনদিন আরও ব্যাপক হচ্ছে, নানা শাখাপ্রশাখা মেলছে, খুলছে।
এজন্য দাওয়ার সাথে জড়িত, দাওয়াহ ভিত্তিক সাংবাদিকতার সাথে জড়িত; বিশেষত আলেমদের সাংবাদিকতা দাওয়াহ ভিত্তিক তাদের এ অবলম্বন ও আয়োজনে যুক্ত হওয়া ছাড়া বড় কোনো কাজ করা কঠিন বলেই আমি মনে করি। যদি কঠিন না হয়, তবুও তা এ আয়োজন ও অবলম্বন এড়িয়ে গেলে ইসলামের দাওয়াত ও ইসলাম বিরোধীদের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার বড় একটা প¬াটফর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকারই নামান্তর হবে।
এজন্য আলেম লেখক, আলেম সাংবাদিক ও আলেম সংবাদকর্মী, এ সময়ের স্বাপ্নিক তরুণ যারা কাজ করছেন, তারা দু’ধরনেরই কাজ করছেন। ইসলামকে পজিটিভভাবে উপস্থাপন করছেন এবং ইসলাম বিরোধীরা যেসব আক্রমণ করছে ইসলামের ভেতরে এসে, ঢুকতে চেয়ে সেটা ইসলামের প্রতিষ্ঠান হোক, ইসলামের চিন্তাধারা হোক, ইসলামের ইতিহাস হোক, ইসলামের আকিদা-বিশ্বাস হোক, ইসলামের মাসায়েল হোক; ইসলামের যে কোনো বিষয়ের উপর তারা যে আক্রমণ করছে, এর তাৎক্ষণিক জবাবও তারা দিচ্ছে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী। এ ব্যবস্থাপনায় এখনকার তরুণ, স্বপ্নচারী সাংবাদিক আলেম, সংবাদকর্মী আলেম লেখকদের বিচরণ করার সুফলও আমরা দেখছি কয়েক বছর যাবৎ। আমরা যে বিচরণ ও বিচরণের সুফল দেখছি তার মাত্রা হয়তো আক্রমণের মাত্রার চেয়ে অনেক কম, অপপ্রচারের মাত্রা চেয়ে অনেক কম, প্রপাগাণ্ডার মাত্রা চেয়ে অনেক কম, কিন্তু তারপরও এটা স্বপ্ন জাগ্রত করে মনের মধ্যে। অল্প কয়েকজনের প্রচেষ্টায় একটা জবাব সামনে চলে আসে। এরপর তা শেয়ার হতে থাকে। অনেক সময় তা মূলধারার সংবাদপ্রবাহ ও মিডিয়াকেও কাবু করে ফেলে, পরাজিত করার পর্যায়ে নিয়ে যায়। কিছুদিন যাবৎ এমন কিছু বিষয় লক্ষ্য করছি। বিকল্প গণমাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতন তরুণ আলেমদের কোনো কোনো পদক্ষেপ এবং অনলাইন পোর্টাল, ইউটিউব চ্যানেল করছে তারা বৈরী মিডিয়া থেকে অনেক বেশি দুর্বল হওয়ার পরও সফল একটি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হতে আমরা দেখছি।
এটা আমাদের ভেতর কিছু আশা সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে কিছু দায়িত্ববোধেরও সৃষ্টি করে। এ অঙ্গণে আমাদের আরও মনোযোগ দেয়া উচিৎ, আরও লোকবল নিয়োগ দেয়া উচিৎ, আমাদের আরও মেধা বিনিয়োগ করা উচিৎ, আরও চিন্তা-ভাবনা করা উচিৎ। যারা আহলে খায়র রয়েছেন, যারা এ খাতে বিনিয়োগ করার সামর্থ্য রাখেন, যারা অর্থ খরচ করতে পারেন, আমি মনে করি তাদের এখন এ ক্ষেত্রগুলোতে মনোযোগ দেয়ার সময় এসেছে। কারণ, মূলধারা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করতে কারও কারও মতে শত কোটি টাকার প্রয়োজন। মূলধারা সাপ্তাহিক করতে কয়েক কোটি টাকা লেগে যায়, একটি রেডিও স্টেশন করতে কোটি খানেক টাকা লেগে যায় বলে শুনেছি। সে জায়গায় আমাদের তরুণ আলেমরা যারা স্বপ্নচারী, যারা একটু সুচিন্তা নিয়ে গঠনমূলক কিছু কাজ দুই ধারায় করতে চায়; ইসলামকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে চায় এবং ইসলামের আদর্শিক শত্রæ যারা প্রতিনিয়ত ইসলামের উপর নতুন নতুন আক্রমণ করছে- তাদের প্রতিরোধ করতে চায়, এমন তরুণদের পাশে যদি অল্প বিনিয়োগ নিয়েও দাঁড়ানো যায়, দীনদার সামর্থ্যবান মানুষগুলো তাদের হাত প্রসারিত করেন, তবে আমাদের ছেলেদের আমাদের তরুণদের লড়াইটা অনেক শক্তিশালী হবে, অনেক জোরালো হবে এবং এ প্রতিরোধটা মূলধারার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অনেক শক্তি ও আশার সঞ্চার করবে বলে আমি মনে করি।
আওয়ার ইসলাম এক বছর পূর্ণ করেছে। আওয়ার ইসলামের পুরো টিমটাই আমার পরিচিত, আমার স্নেহভাজন; মাওলানা হুমায়ুন আইয়ুব এদের দলপতি, রোকন রাইয়ান ও আতাউর রহমান খসরু রয়েছেন। আরও যারা বিভিন্ন পর্যায়ে আওয়ার ইসলামের সঙ্গে আছেন এবং ছিলেন আমি তাদের অভিনন্দন জানাই। ভুল-ত্রুটি মানুষের থাকে, হয়তো তাদের দুয়েকটি কাজের ব্যাপারে অন্যদের ভিন্নমতের সুযোগ ছিলো, তারপরও ইসলাম নামের বড় প্লাটফর্মে এবং আলেমসমাজ নামক বড় প্লাটফর্মের, দেওবন্দ ও কওমি মাদরাসার প্লাটফর্মের প্রতিনিধি হয়ে তারা বিভিন্ন সময় যে লড়াইগুলো করেছে, বড় আলেমদের বক্তব্য সেখানে উপস্থাপন করেছে, তাৎক্ষণিক একটা প্রতিক্রিয়া উপস্থাপন করেছ, একটা জবাব তৈরি করেছে এবং ইসলামবিরোধীদের দুর্বলতাগুলো তুলে ধরা, তাদের আক্রমণগুলো জনগণের সামনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে মনোযোগী ও সাহসী ভূমিকা রেখেছে; বড় ধরনের ইতিবাচক গণমাধ্যমের সূচনা হিসেবে তাদের এসব পদক্ষেপকে আমি অভিনন্দন জানাই। তাদেরকে মোবারকবাদ জানাই। তারা যেনো সামনের বছরগুলোতে আরও সহযোগিতামূলক পরিবেশের মধ্য দিয়ে আরও বড় ধরনের কাজ করতে পারে, ইতিবাচক সাংবাদিকতা ও দাওয়াহ ভিত্তিক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে আরও বড় পরিসরে কাজ করতে পারে এবং আরও বড় দৃষ্টান্ত দৃষ্টি করতে পারে আমি তাদের কাছে সেটা প্রত্যাশা করি, তাদের জন্য দোয়া করি এবং তাদেরকে অভিনন্দন জানাই।
একই সঙ্গে আওয়ার ইসলামের পাশাপাশি কওমি তরুণদের আরও যেসব নিউজ পোর্টাল রয়েছে, অনলাইন পত্রিকা রয়েছে, ইন্টারনেট ভিত্তিক তৎপরতা রয়েছে তাদেরকেও অভিনন্দন জানাই। তারাও যেনো সুন্দরভাবে এগিয়ে যেতে পারে, আমাদের সামর্থ্যবান মানুষ তাদের পাশে দাঁড়ায়। সবার প্রতি শুভ কামনা ব্যক্তি শরীফ মুহাম্মদ ও আমার প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম এন্ড দাওয়াহ-এর পক্ষ থেকে।
লেখক : পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম এন্ড দাওয়াহ।