বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


প্রসঙ্গ বাজেট ভাবনা: ইসলামে ঘাটতি বাজেটের অনুমোদন নেই

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আলামিন আল আরাফ

শুরুতেই একটা গল্প বলি, এক এমপিকে নিয়ে এই গল্প। তিনি একটা বিএমডব্লিউ গাড়ি কিনেছেন। সেটা নিয়ে তিনি বের হলেন। রাস্তার ধারে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে তিনি নামবেন। একটু হাওয়া খাবেন। যেই না দরজা খুলেছেন, অমনি একটা ট্রাক এসে তার খোলা দরজা উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে ফোন করলেন। পুলিশ এল। তিনি বললেন, ‘দেখুন, একটা ট্রাক কী করেছে, আমার নতুন বিএমডব্লিউ গাড়ির দরজা ভেঙে নিয়ে চলে গেছে।’ পুলিশ তাকিয়ে দেখল ভালো করে। বলল, ‘স্যার, আপনি এই রকম কেন? আপনার গাড়ির দরজা নেই, শুধু এটা দেখছেন। ট্রাকটা যে আপনার বাম হাত উড়িয়ে নিয়ে গেছে, এটা দেখলেন না?’ এমপি সাহেব তখন তাকালেন তাঁর হাতের দিকে। তাঁর একটা হাত নেই। সেখান থেকে রক্ত ঝরছে। সেদিকে তাকিয়ে তিনি কেঁদে উঠলেন, ‘আমার রোলেক্স ঘড়ি, আমার রোলেক্স ঘড়ি!’

পাঠকগণ, গল্পটা কিন্তু বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ন উল্টো। কেননা বাঙ্গালী এমপি দের এ রকম ১০/১২ টা বি এম ডব্লিউ ভেঙ্গে গেলেও তাদের কিচ্ছুই হবে না। কারনটা হচ্ছে, দেশী-বিদেশী ব্যাংকে এদের যে পরিমাণ টাকা মওজুদ আছে তা দিয়ে গাড়ী'র কোম্পানি ক্রয় করা অসম্ভবের কিছু নয়। তাছাড়া এদের হাতও বেশ লম্বা। এবার মূল গল্পে আসা যাক, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেট প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। বেশ ভালো অংকের বাজেট। যদিও অর্থনীতিবিদ দের ধারনা, এ বাজেট বাস্তবায়ন একেবারেই অসম্ভব। তারপরো,অর্থমন্ত্রীকে উয়েল্কাম টানা ১১ বার বাজেট পেশ করার জন্য।

এবারের বাজেটে দেখা গেছে , এই বিশাল অংকের ব্যয় মেটাতে নতুন অর্থবছরে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ঠিক করেছেন তিনি। এর মধ্যে কর হিসেবে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা আদায় করা হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে; আর তার ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ, অর্থাৎ ৮৫ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা রাজস্ব আসবে আয়কর ও মুনাফার উপর কর থেকে। এই বাজেটের মাধ্যমে ১৫ শতাংশ হার রেখে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের করতে যাচ্ছে সরকার। তবে, রাজস্ব বাড়ানোর জন্য ঢালাও ভাবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বাস্তবায়ন করে প্রত্যক্ষ করের তুলনায় দ্বিগুণ পরোক্ষ কর সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেটা অবশ্যই পরিতাপের বিষয়।রাজস্ব আয় বৃদ্ধির এ প্রস্তাব সকল পণ্য ও সেবার দাম বৃদ্ধি ঘটিয়ে মূল্যস্ফীতিকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যাবে,
এতে কোনো সন্দেহ নেই।

উদাহরণ স্বরূপ, রডের ওপর টনপ্রতি ৪৫০ টাকার পরিবর্তে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এখন এক টনের দাম যদি ৫০ হাজার টাকা হয়, তাহলে ভ্যাট দাঁড়াবে ৭৫০০ টাকা। রডের বাজার দখল করবে আমাদের দেশীয় পন্য বাশঁ এতে কোনো সন্দেহ নেই।

বাজেটের আগে সবার দৃষ্টি ভ্যাট নিয়ে। আর সরকারের চিন্তা ভোট নিয়ে। সরকার ভ্যাটও রাখবেন, ভোটের চিন্তাও করবেন। এই দুইয়ের টানাপোড়েনের কারনে বাজেটি হয়েছে পুরোপুরি ভারসাম্যহীন। বাজেটে খরচের খাত ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়েছে। মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এগোচ্ছে না বড় প্রকল্পের বাস্তবায়ন।নির্বাচনের আগে এমনিতেই রাস্তাঘাট নির্মাণে দলের ভেতর থেকেই চাহিদা বাড়ে। এসব নিয়েই অর্থমন্ত্রী যেতে চেয়েছেন উন্নয়নের মহাসড়কে।

ব্যাংকিং খাতে দেখলাম বছরের যেকোনো সময় ব্যাংক হিসাবে ১ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা জমা দিলে বা তুললে ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক কেটে রাখা হবে। যেটা আগে রাখা হতো ৫০০ টাকা। আবগারি শুল্ক বাড়ানোর ফলে আমানতকারীরা ব্যাংকবিমুখ হয়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। এর বদলে তারা ছুটবেন শেয়ারবাজার বা সমবায় সমিতিগুলোতে। এতে ছায়া অর্থনীতি আরও বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক রিপোর্টে দেখলাম- ব্যাংকগুলোতে ১ থেকে ২ লাখ টাকা রয়েছে এমন হিসাব ৩৩ লাখ ৬২ হাজার ৯১৪ টি অন্যদিকে ১ থেকে ৫ কোটি টাকার হিসাব রয়েছে মাত্র ৫১ হাজার ৭৮১ টি। এ থেকে স্পষ্ট- এদেশে ধনিক শ্রেনীর তুলনায় মধ্যবিত্ত এবং নিম্ম মধ্যবিত্তদের সংখ্যা অতুলনীয় ভাবে বেশি।

বিশ্লেষণ করলে বোঝাই যাবে, প্রস্তাবিত বাজেট হচ্ছে গরিবের পেটে লাত্থি মারার বাজেট। গরিবের দেহে ইঞ্জেকশন পুশ করে রক্ত বের করে ঘাটতি পূরন করার বাজেট। বাজেটে রাজস্ব আয়ের ভারের সবটাই বহন করতে হবে গরিব মধ্যবিত্তসহ সাধারণ মানুষকে। বোঝাই যাচ্ছে, এ সরকার ধনিক শ্রেণির সরকার। গরিবের পকেট কেটে ধনীদের পকেট ভর্তি করার সরকার। প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মুফতী ফয়জুল_করীম দাঃ বাঃ এক আলোচনায় বলেছিলেন- এ সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা হচ্ছে গরিবের পেটে ৫ লাত্থি।

একটা কথা বলে রাখি, বর্তমানে কিন্তু বাংলাদেশে মোটা চালের দাম পৃথিবীর যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি। রোজাকে সামনে রেখে মজুতদাররা ডাল, তেল, চিনি, লবণসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। দাম বৃদ্ধি প্রতিরোধে সরকার সম্পূর্ন ব্যর্থ। মুহতারাম ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সাহেব'রা সরকার থেকেও বেশী প্রভাবশালী। এদেশের পরিবহণ সিন্ডিকেট, বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট, বাজার সিন্ডিকেট'রা অনেকক্ষেত্রে সরকারকে কোনোরকম তোয়াক্কাই করে না। যেমন, গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরিক্ষা'র জন্য সরকার অনেক চেষ্টাই করেছেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সরকারের এ সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙুলি প্রদর্শন করেছিলো। এছাড়াও সিটিং সার্ভিসের বেপরোয়া চিটিং আচারন কয়দিন আগেও দেখলাম। মোদ্দা কথা, এমন বহু সেক্টর বাংলাদেশে বিদ্যমান যেগুলার নিয়ন্ত্রণ মূলত সরকারের হাতে নেই।

এবার আসি ইসলামী প্রসঙ্গে-

ইসলামী  অর্থব্যবস্থা হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ, সফল ও কার্যকরী একটি অর্থব্যবস্থা। জাতীয় বাজেট ঘোষণার সময় এর ইসলামী দিকটি আমাদের অনেকেরই ভাবনায় আসে না। এমনকি ইসলামী মহলে, ওলামায়ে কেরামের মধ্যেও বিষয়টি অনালোচিত ও অকর্ষিত।

ইসলামের দৃষ্টিতে বাজেট একটি বড় আমানত। একটি দেশের বাজেটের ওপর নির্ভর করে দেশ ও জনগণের সুখ, শান্তি ও নিরাপত্তা। সরকারের দায়িত্বই হলো দেশ ও জনগণের কল্যাণে আমানতের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা। ঘাটতি বাজেট বলতে কোনো বাজেটকে ইসলাম অনুমোদন করে না। কারণ ইসলাম মানুষকে আয় বুঝে ব্যয় করার শিক্ষা দিয়েছে।

প্রথমে মোটা অঙ্কের ব্যয়ের হিসাব কষে এরপর নানা উপায়ে তা আয় করার মানসিকতা ইসলাম সমর্থন করে না। এর দ্বারা সমাজের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয়। প্রচলিত বাজেটে জনগণের ওপর করারোপের যে বিধিমালা জনগণের সে কষ্ট লাঘবের পথও রয়েছে ইসলামে। বর্তমান কর ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সবচেয়ে দরিদ্র ব্যক্তিকেও তার ভরণপোষণের জন্য কোনো না কোনোভাবে ট্যাক্স আদায় করতে হয়। অথচ ইসলামে গরিবের কাছ থেকে আদায় নয়, অকুণ্ঠ হাতে রাষ্ট্রকে তার পাশে দাঁড়াতে বলে।

হযরত মুয়াজ (রা.) কে গভর্নর হিসেবে ইয়েমেনে প্রেরণকালে মহানবী (সা.) বলেছিলেন, 'আর তুমি এর অধিবাসীদের থেকে সাদাকা আদায় করবে, যা ধনীদের থেকে নেয়া হবে এবং গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। বাজেটের একটি বড় অংশ জোগান দেয়া হয় বৈদেশিক ঋণ থেকে। মানুষের কাছে নিজে ছোট হওয়া, নিজের দেশকে ছোট করা কখনও ইসলাম পছন্দ করে না। তাছাড়া ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় আয়ের উৎস ও ব্যয়ের খাতগুলো যেরূপ জোরালো, স্বচ্ছ ও স্পষ্ট, প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় সেটি নেই। অপ্রয়োজনীয় ও অনর্থক খাতে যে বিশাল অঙ্কের অপব্যয় হয়, ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় সে সুযোগ নেই।

সর্বোপরি সুদনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ইসলামের সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। জাতীয় বাজেটে সুদনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ার কারণেই দিন দিন আমাদের দেশের অর্থনীতি রসাতলে যাচ্ছে। রাতারাতি শতভাগ সুদমুক্ত অর্থনীতি চালু করা হয়ত সম্ভব নয়। তবে একটি মুসলিমপ্রধান দেশ যথাসম্ভব ঘৃণিত এ কাজ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা থাকতে হবে কর্তৃপক্ষের।

পরিশেষে একটা কথাই বলব- আমাদের কর্তৃপক্ষকে একটা বিষয় অনুধাবন করতে হবে, টাকা দিয়ে হয়ত রোলেক্স ঘড়ি কিংবা বিএমডব্লিউ কেনা যাবে কিন্তু ট্রাকে উড়ে যাওয়া বাম হাতটি কিন্তু আর পাওয়া যাবে না।

এসএস/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ