বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


মূর্তিকে যারা মুক্তিযুদ্ধের সাথে মেলাচ্ছে তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল না

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আওয়ার ইসলাম: বিদগ্ধ আলেম ও মুক্তিযোদ্ধার সংগঠক আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। জমিয়তুল উলামা বাংলাদেশের সভাপতি, জাতীয় দ্বীনি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশ-এর সভাপতি ও জামিয়া ইকরার শায়খুল হাদিস ও মহাপরিচালক। এছাড়াও ইহসানুল মুসলিমিন নামে তার রয়েছে একটি সেবামূলক সংগঠন।

অন্যান্য জাতীয় ও ধর্মীয় ইস্যুর মতো  হাইকোর্টের গ্রিক মূর্তি নিয়ে সরব হয়েছেন দেশের শীর্ষ এ আলেম। গত ১১ এপ্রিল কওমি মাদরাসার শিক্ষা সনদের মান ঘোষণা অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে প্রথম স্পষ্ট ভাষায় গ্রিক মূর্তির অপসারণ দাবি করেন এবং সর্বশেষ তিনি একই ইস্যুতে প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করেছেন।

দেশের চলমান জাতীয় ও ধর্মীয় এ ইস্যুতে তার মুখোমুখি হন আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদক হুমায়ুন আইয়ুব। জানতে চান তার অবস্থান, দাবি ও দাবির যৌক্তিতা সম্পর্কে। খোলামেলা কথা বলেন তিনিও।

আওয়ার ইসলাম : প্রথমত গ্রিক মূর্তি সরানো এবং পুনরায় প্রতিস্থাপনে মুসলমানদের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বলুন?

আল্লামা মাসঊদ : সুপ্রিমকোর্ট একটি নিরপেক্ষ জায়গা। দেশের সকল মানুষের বিচারিক আশ্রয়স্থল। কোনো নিরপেক্ষ জায়গায় যদি এমন কিছু করা হয় যা কোনো বিশেষ কোনো সম্প্রদায় বা সমাজের একাংশ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের পরিপন্থী তখন মানুষের বিরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়াটা স্বাভাবিক।

সেক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্টের সামনে গ্রিক দেবির মূর্তি স্থাপনে মুসলমানরা স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। যখন সেটি অপসারণ করা হলো তখন তারা খুশি হলো। কিন্তু আবার যখন সেটা অন্য কোথাও প্রতিস্থাপন করা হলো তখন সাধারণভাবেই বিষয়টি তারা মেনে নিতে পারছে না।

কেননা মৌলিকভাবে মূর্তি পুজা, মূর্তি বানানো বা মূর্তি সংরক্ষণ ইসলামে নিষিদ্ধ। আবার এটাও সত্য কারো ধর্মীয় কাজে ইসলামে বাধা প্রদানও করে না। কিন্তু মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত করা হয় এমন কিছু মুসলমান স্বাভাবিকবাবেই মেনে নিতে পারে না।

এখানে বলা হচ্ছে মূর্তি নয় ভাস্কর্য। যারা বলছে তারা মানুষকে বোকা বানাতে চাচ্ছে। আসলে ভাস্কর্য হলেই যে মূর্তি হতে হবে তা না। ইসলামে বিমূর্ত ভাস্কর্য নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু এখানে যেটাকে ভাস্কর্য বলা হচ্ছে সেটা সু-সুস্পষ্ট একটা নারী প্রতিমূর্তি যা গ্রিক দেবি থেমিসের আদলে করা হয়েছে। মূলত ভাস্কর্য  ্সআর মূর্তিত ঘুরফিরে একই জিনিস। পার্থক্য শুধু ভাস্কর্য টা কিসের সেই প্রশ্নে। অবশ্যই মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত হানবে।

[মূর্তি আর ভাস্কর্য নামে যারা পার্থক্য করতে চায় তারাই জঙ্গি(ভিডিও)]

আওয়ার ইসলাম : পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশে বিশেষ করে সৌদি আরব, মিসরে তো এরকম অনেক মূর্তি আছে সেদেশের আলেম ওলামারা তো এরকম প্রতিবাদ করছে না!

আল্লামা মাসঊদ : সেটি আরব বা মিসর ইসলামের অনুকরণীয় নয়।অনুকরণ বা অনুসরণ করতে হবে কুরআন সুন্নাহর। তাছাড়া সৌদি আরবে মূর্তি আছে বলে আমার জানা নেই। তবে বিমূর্ত ভাস্কর্য আছে।

হাইকোর্টের সামনে এমন একটি মূর্তি স্থাপন করা হলো। যার সাথে জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনার কোনো সম্পর্ক নেই। এতো দিন এটা ছিলো না। কেনো তা স্থাপন করা হলো? এখানে জাতির নূন্যতম কোনো দাবি কী ছিলো?

আওয়ার ইসলাম : তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্বাধীনতার সাথে সম্পর্ক রাখে এমন ভাস্কর্য়ে আপনাদের কোনো প্রশ্ন ছিলো না?

আল্লামা মাসঊদ : হ্যাঁ এটাও একটি প্রশ্নের দিক। ইসলামের কথা তো আমি বললামই। আমি বলতে চাচ্ছি, দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্ক থাকলে হয়তো সাধারণ বাঙালি এটা পছন্দ করতো। বাঙালি তো আর শুধু মুসলমান না। গ্রিক মূর্তিটা বাহির থেকে এনে চাপিয়ে দেয়া হলো। এতে জাতির কী উন্নতি হলো? এটা না হলে জাতির কী ক্ষতি হতো?

এ গ্রিক মূর্তিকে ন্যায় বিচারের প্রতীক বলা হচ্ছে। এটা এক প্রকার মূর্খতাই বলবো। মানুষ মূর্তি দেখে ন্যায় বিচার শিখবে? দেশের মানুষ ৯০ ভাগ মুসলিম মূর্তি দেখে তাদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে।

আওয়ার ইসলাম : জাতীয় সংসদের নকশা অবিকৃত রাখার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। বাংলাদেশের হাইকোর্টও তো একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান। আপনার কী মনে হয়, মূর্তি স্থাপন করায় আদালতের ঐতিহ্য নষ্ট হয়েছে?

আল্লামা মাসঊদ : হ্যা, আমি মনে করছি আদালত আমাদের দেশের একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। সুতরাং তা অবিকৃত রাখা উচিৎ। ঐতিহ্যে হস্তক্ষেপ করা উচিৎ নয়।

আওয়ার ইসলাম : হাইকোর্ট তো একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান...

আল্লামা মাসঊদ : স্বাধীনতার একটা সীমা আছে। স্বাধীনতা মানে তো পাগলের ইচ্ছে নয়। আগে প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ হতে হবে। তার পর পরিবর্তন। তাছাড়া হাইকোর্ট আমাদের দেশের ঐতিহ্যের অংশ সুতরাং তাতে বিচার বিভাগের স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।

আওয়ার ইসলাম : আপনি প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করেছেন। কোন যুক্তি থেকে? এজন্য প্রধান বিচারপতিকে কতোটা দায়ী মনে করছেন আপনি?

আল্লামা মাসঊদ : আমি আমার বিবৃতিতে যা বলেছি তাহলো, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট জাতির আস্থা ও ভরসার একটি জায়গা। ঐক্যের প্রতীক। কিন্তু বর্তমান ইস্যুতে জাতি বিভক্ত! এজন্য এ প্রতিষ্ঠানের যিনি প্রধান তাকেই তো দায়িত্ব নিতে হবে। তিনি তো দায় এড়াতে পারেন না।

আওয়ার ইসলাম : জাতি বিভক্তির বিষয়টি স্পষ্ট করবেন প্লিজ!

আল্লামা মাসঊদ : জাতির  বিভক্তির বিষয়টি স্পষ্ট। কাল রাতে শুনলাম সারা রাত দু’দল মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলো। এ বিভক্তি বাড়বেই। জাতিকে বিভক্ত রেখে তো দেশ এগুতে পারে না। যারা একটি অনর্থক জিনিস স্থাপন করে জাতিকে বিভক্ত করেছে এজন্য তাদের দায় নিতে হবে।

আওয়ার ইসলাম : বিভক্তি তো আগেও ছিলো। ডান-বাম, সেক্যুলার-ধর্মীয় গোষ্ঠি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও চেতনা বিরোধী এমন বহু বিভক্তি সমাজে বহুকাল ধরে চলে আসছে। আপনি বিষয়টাকে প্রধান বিচারপতির উপর চাপাচ্ছেন কেনো?

আল্লামা মাসঊদ : আমি আবারও বিষয়টা স্পষ্ট করতে চাই, সমাজে বিদ্যমান বিভক্তি ও বর্তমান বিভক্তির মাঝে কিছুটা পার্থক্য আছে। বর্তমান বিভক্তি হাইকোর্টের প্রতি আস্থা  ও বিশ্বাস নিয়ে। সুপ্রিম কোর্টের ঐক্যের প্রতীক থাকা নিয়ে।

ইসলামের দৃষ্টিতে মূর্তি ও ভাস্কর্য

আওয়ার ইসলাম : প্রধানমন্ত্রী বলছেন, তিনি মূর্তি স্থাপনের বিষয়টি জানতেন না। এ কথা বলে তিনি কী দায় এড়াতে পারেন?

আল্লামা মাসঊদ : দেখেন, আপনি সাংবাদিক হিসেবে অনেক কিছু জানেন। কিন্তু আপনার সেই জানার কোনো দায় থাকে না। তারপরও প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছেন, জানতেন না। আমরা তার কথা বিশ্বাস করতে চাই। আমি মনে করি না তিনি মিথ্যা বলেছেন।

আওয়ার ইসলাম : মূর্তির পুনঃস্থাপন হলো, কিভাবে দেখছেন বিষয়টি?

আল্লামা মাসঊদ : স্থাপন করা যেমন অপরাধ ছিলো, পুনঃস্থাপনকেও একই পরিমাণ ঘৃণার জায়গা থেকে দেখছি।

আওয়ার ইসলাম : আপনারা কোনো আন্দোলন যাবেন কী?

আল্লামা মাসঊদ : এ দেশের মানুষের অধিকার আছে অহিংস আন্দোলন ও প্রতিবাদের মাধ্যমে অধিকার ও দাবি আদায় করার।

আওয়ার ইসলাম : হেফাজতে ইসলাম দাবি করছে, সারা দেশের মূর্তি ও ভাস্কর্য অপসারণ করতে হবে। বিষয়টা আপনি কিভাবে দেখেন?

আল্লামা মাসঊদ : আমি একটি প্রশ্ন করতে চাই, সিরিয়ায় তো সাহাবা কেরামের যুগেই ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। হজরত ওমর রা. এর সময়ে। এরপর তিন খলিফার যুগ গেলো, উমাইয়া যুগ গেলো, আব্বাসি যুগ গেলো;  এরপর থেকে এ পর্যন্ত কেউ পালমিরা ধ্বংসের প্রয়োজনবোধ করলো না, প্রয়োজন বোধ করলো আইএস। একইভাবে আফগানিস্তানেও ইসলামি শাসন এসেছে হাজার বছর আগে। এখন কেউ মূর্তি ধ্বংসের প্রয়োজনবোধ করলো না তালেবান তা বোধ করলো। তারা কী আল্লাহর রাসুলের সাহাবিদের চেয়ে বেশি মুত্তাকি ও খোদাভীরু?

আওয়ার ইসলাম : আপনার মতামত কী?

আল্লামা মাসঊদ : আমি সব সময় চাই, মানুষ আগে ঈমানের জায়গাতে ঠিক হোক। মানুষের ঈমানের জায়গা ও ভীত ঠিক না করেই যদি মূর্তি সরানোর দাবি করি তবে সমাজে ভুল বোঝাবুঝি ও বিভক্তিই বাড়বে।

গ্রিক দেবীর মূর্তি বাংলাদেশের কোথাও স্থাপন করা যাবে না

আওয়ার ইসলাম :  বামপাড়ার একদল মানুষ মূর্তিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রমাণ করতে চাইছে...

আল্লামা মাসঊদ : বামপাড়ার যারা এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক হয়েছে তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন না। তাদের কোনো জনসম্পৃক্ততা নেই এবং জনগণের ভাষাও তারা বোঝে না। জনসম্পৃক্ততাহীন মানুষের কথায় গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন নেই।

আওয়ার ইসলাম : মূর্তি পুনঃস্থাপন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আপনার কোনো বক্তব্য আছে কী?

আল্লামা মাসঊদ : না, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমার কোনো বক্তব্য নেই। আমি তাকে এ ব্যাপারে দায়ী মনে করি না। যার দায় আছে তার ব্যাপারে আমি আমার বক্তব্য দিয়ে দিয়েছি।

আওয়ার ইসলাম :  যদি স্বেচ্ছায় সরে না যায়?

আল্লামা মাসঊদ : আমি দাবি জানাতে পারি। সরিয়ে দেয়ার শক্তি তো নেই।

আওয়ার ইসলাম :  আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আল্লামা মাসঊদ : আপনাকে এবং আওয়ার  ইসলামের সব পাঠকে ধন্যবাদ।

মূর্তি ধ্বংস করুন নতুবা আপনারা ধ্বংস হয়ে যাবেন: চরমোনাই পীর

এসএস/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ