শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


একই দিনে রোযা পালন সম্পর্কে আরবের আলেমদের ফতোয়া

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ লুৎফেরাব্বি

ইসলামী শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিধান চন্দ্রমাসের সাথে যুক্ত। তাই মাসের শুরুতে চাঁদ দেখা যাওয়া না যাওয়া অত্বন্ত জরুরি বিষয়। রাসুলুল্লাহ সাঃ চাঁদ দেখে রোযা রাখতে ও রোযা শেষ করতে বলেছেন। হজ্বের বিধানও যিলহজ্বের চাঁদ দেখার সাথে সম্পৃক্ত।

যুগেযুগে প্রত্যেক দেশের মুসলমানগণ তাদের দেশে চাঁদ দেখার উপর ভিত্তি করেই রোযা-ঈদ পালন করে থাকে।

আমরা নিম্নে সৌদি আরব ও অন্যান্য দেশের কয়েকজন উলামা–মুফতির মতামত উল্লেখ করছি-

১- ইসলামিক ফিকহ একাডেমি মক্কা: রাবিতাতুল আলামিল ইসলামির অন্তর্গত "ইসলামিক ফিকহ একাডেমি"র ১৪১১ হিঃ চতুর্থ বার্ষিক সম্মেলনে এই বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তা হলো-

'' ইখতিলাফুল মাতালি' বা চাঁদের উদয়-উৎসের ভিন্নতাকে গ্রহন করা মানুষের জন্য সহজতর। আর এটাই সুচিন্তিত মতামত। তাই একই দিনে রোযা ও ঈদের কথা যারা দাবি করছেন তাদের বক্তব্য শরিয়ত ও যুক্তি বিরোধী।''

সেখানে আরো বলা হয়েছে, ''ইসলামিক ফিকহ একাডেমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, পুরা ইসলামি বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদের দাবির কোন প্রয়োজন নেই। কারণ এই দাবি মুসলমানদের ঐক্যের কোন মাধ্যম নয়, (যেমনটা দাবি করা হচ্ছে)। বরং চাঁদ দেখার বিষয়টি প্রত্যেক দেশের কেন্দ্রীয় ফতোয়া বিভাগ, আদালত ও চাঁদ দেখা কমেটির হাতেই ছেড়ে দেয়া উচিৎ। আর মুসলমানদের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে সম্মিলিতভাবে আল্লাহর বিধান ও রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সুন্নত যথাযথ পালনের মাধ্যমেই''।

http://www.alifta.net/Fatawa/fatawaDetails.aspx?BookID=2&View=Page&PageNo=1&PageID=4118

এছাড়াও ১৪২১ হিঃ ২০০১ সনের বৈঠকে এই বিষয়ে আরেকটি সিদ্ধান্ত হয় যার ক্রমিক নং ৩৪। এই সিদ্ধান্তের ৫ম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেঃ

"নির্দিষ্ট কোন দেশ বা শহরকে – যেমন মক্কা – চাঁদ দেখার জন্য নির্ধারণ করা যাবেনা। কেননা তার অর্থ হবে যদি কোন দেশে চাঁদ দেখা যায় তাও মূল দেশে না দেখা যাওয়ার কারণে তাদের রোযা রাখতে হবেনা। (আর এটি সঠিক নয়)।''
http://www.alifta.net/Fatawa/FatawaChapters.aspx?languagename=ar&View=Page&PageID=258&PageNo=1&BookID=1

২- কেন্দ্রীয় দারুল ইফতা, মিসর: 'মিসরে চাঁদ দেখার নিয়ম ও মূলনীতি' এই শিরোনামে ১৬/০৬/২০১৬ একটি ফতোয়া প্রকাশ করে দারুল ইফতা মিসর, যার ক্রমিক নং ৩৪২০। এই ফতোয়ার ৩য় ধারায় বলা হয়েছেঃ

''প্রত্যেক দেশের জনগণের উপর ওয়াজিব হলো, চাঁদ দেখা বা না দেখা সাব্যস্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের ইমাম (সরকার প্রধান, বা সংশ্লিষ্ট বিভাগ) এর অনুসরণ করা। তবে শর্ত হলো, বৈজ্ঞানিকভাবে ওইদিন চাঁদ উঠার বিষয়টি সম্ভব হতে হবে।''
http://www.dar-alifta.gov.eg/ar/ViewFatwa.aspx?sec=fatwa&ID=12825

৩ – শায়েখ আব্দুল্লাহ বিন হুমাইদ, সাবেক মহাব্যবস্থাপক, হারামাইন শরিফাইন:
ইসলামিক ফিকহ একাডেমিতে যখন চাঁদের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল তখন তিনি "তিবয়ানুল আদিল্লাহ ফি ইসবাতিল আহিল্লাহ'' নামে একটি পুস্তিকা রচনা করেন। সেখানে তিনি পুরা ইসলামি বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদের দাবি অস্বীকার করে বলেনঃ "এই মতটি রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সহিহ হাদিস, চার মাযহাবের বিশেষজ্ঞ উলামায়ে কেরাম ও আধুনিক জিউগ্রাফি ও ভূ-ত্বত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের মতের বিপরীত। যদিও কেউ কেউ এই দাবি করেছেন তবে তার পক্ষে কোন আকলি বা নকলি দলিল নেই।'' (তিবয়ানুল আদিল্লাহঃ ৩)

৪- শায়েখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসাইমিন: একই দিনে রোযা ও ঈদ পালন বিষয়ে তাঁর একাধিক ফতোয়া রয়েছে। এক ফতোয়ায় তিনি বলেনঃ '' এক্ষেত্রে বিশুদ্ধ মত হলোঃ যদি দুই দেশের চাঁদের উদয়-উৎস এক হয় তাহলে তা একই দেশের হুকুমভুক্ত, অর্থাৎ এক জায়গায় চাঁদ দেখা গেলে অন্য জায়গায়ও তা ধর্তব্য হবে। আর যদি চাঁদের উদয়-উৎস ভিন্ন হয় তাহলে প্রতি দেশের হুকুম ভিন্ন ভিন্ন হবে। এটাই ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর মত। কুরআন, সুন্নাহ ও কিয়াসের দাবীও এটাই''।

মক্কা বা সৌদি আরবের সাথে মিলিয়ে রোযা বা ঈদ করার ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেনঃ '' চাঁদের অক্ষরেখা হিসাবে এটি অসম্ভব। কারণ চাঁদের উদয়-উৎস যদি ভিন্ন হয় তাহলে শরিয়াহ ও যুক্তির দাবী হলো প্রত্যেক দেশের হুকুম ভিন্ন হওয়া''। (মাজমুয়া ফাতাওয়া ইবনে উসাইমিন ১৯/৪৫-৪৮)

৫ – শায়েখ আব্দুল আযীয ইবনে বায রহ. : "যদি চাঁদের উদয়-উৎস ভিন্ন হয় তাহলে প্রত্যেক দেশের হুকুম ভিন্ন হওয়ার মতটি শক্তিশালী, এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদ এই মততিই গ্রহন করেছেন''।
''তাই যদি সৌদি আরবে চাঁদ দেখা যায় ও সেই আলোকে শাম ও মিসরের মানুষ রোযা রাখে তাহলে ঠিক আছে। আর যদি তারা নিজেরাই চাঁদ দেখে সেই ভিত্তিতে রোযা রাখে তাতেও কোন সমস্যা নেই''।

অপর এক ফতোয়ায় তিনি বলেন, ''সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সিদ্ধান্ত মতে, চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে প্রত্যেক দেশের হুকুম ভিন্ন ও এবিষয়ে তারা তাদের উলামায়ে কেরামের শরণাপন্ন হবেন''। (মাজমুয়ায়ে ফাতাওয়া ওয়া মাকালাত ১৫/৮৪-৮৫)

৬- শায়েখ আহমদ খলিলী, কেন্দ্রীয় মুফতী, ওমান: ১৪৩০ হিজরীতে চাঁদ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে 'ইখতিলাফুল মাতালি' ওয়া আসারুহু ফি ইখতিলাফিল আহিল্লাহ' শিরোনামে দীর্ঘ এক পুস্তিকা রচনা করেন। সেখানে তিনি বলেনঃ ''চাঁদের উদয়-উৎসের ভিন্নতার কারণে চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে ভিন্নতা হতে পারে। তাই বিশুদ্ধ মত হলো, সেই আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহন করা। এটাই শরিয়তের দলিল ও বৈজ্ঞানিক যুক্তির দাবী।

এই বিধান শুধু রোযা বা ঈদের ক্ষেত্রে নয়; বরং চাঁদ দেখার সাথে সম্পৃক্ত সকল ইবাদতের ক্ষেত্রেই একই কথা।যেমনঃ হজ্ব, কুরবানী''।('ইখতিলাফুল মাতালিঃ ৭৭)

লেখক: শিক্ষার্থী আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় মিশর

পুরো বিশ্বে একই দিনে রোজা-ঈদ: একটি অসম্ভব ও ব্যর্থ চেষ্টা


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ