মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১০ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫


দৌলতপুরে নজরুল

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

'দৌলতপুর' ইতিহাসের পাতায় প্রজ্বলিত একটি গ্রামের নাম। রূপসী বাংলার আরো শত সহস্র গ্রামের মতোই একটি গ্রাম। আর সব গ্রামের মতো এখানেও বিস্তৃত সবুজ ধানের খেতে ঢেউ তুলে বসন্তের দখিণা হাওয়া। কৃষকের মাথার উপর সুদূর নীলিমায় ভেসে বেড়ায় শরতের সাদা মেঘ। বর্ষায় খালে-বিলে গান গেয়ে দাঁড় টেনে যায় মাঝি মাল্লার দলেরা। হেমন্তে গ্রামের কিশোরী আর নয়া বধূদের ব্যস্ততা চোখে পড়ে অন্যসব গ্রামের মতোই। সবইতো সাদাসিধা!

তাহলে কি আর এমন বিশেষত্ব বাকি আছে এই গ্রামের? যে বিশেষত্বের জন্যে ইতিহাসের পাতায় নিজেকে প্রকাশ করে দৌলতপুর অর্জন করেছে এক অনন্য গৌরব। কি সেই মহারত্ন? কে সেই পরশপাথর? যার স্পর্শে দৌলতপুরের মতো সাধারণ একটি গ্রাম আজ সোনায় সোহাগা।

কে সেই যাদুর বাঁশরী? যার মোহন বাঁশীর সুরে দোলায়িত হয়েছিল এই অজপাড়া গায়ের মানুষগুলোর তনু মন। যার প্রেমবসন্তের উতলা হাওয়া কাপন ধরিয়েছিল এক ইরানী পুষ্পের চিত্তে।

তিনি যে আর কেউ নন, তিনি হলেন প্রেমের কবি, দ্রোহ ও সাম্যবাদের কবি। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

কবি ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে (১৩২৭ চৈত্র) সর্বপ্রথম এই দৌলতপুর গ্রামে এসেছিলেন। শুধু আসাই নয়, দীর্ঘ ৭০ দিন অবস্থানের যে স্মৃতি মিশে আছে এই গ্রামের আলো-ছায়া, বৃক্ষ-লতা আর পত্রপল্লবে, তাকি কখনো মুছে যাওয়ার? নাকি ভুলে যাওয়ার?

না, তা কখনো ভুলার নয়। এই স্মৃতি ভুলতে পারেননি কবি নিজেও। নজরুল যেখানেই থাকুক না কেন, প্রিয়তমা নার্গিসের অমর প্রেমের স্মৃতি কবিকে তাড়া করেছে সবসময়। যে কথা কবি নিজেই বলে গেছেন তার মনের মানুষ নার্গিসকে লেখা চিঠিতে।

তিনি লিখেছেন- 'যেখানেই থাকি বিশ্বাস করো আমার অক্ষয় আশির্বাদ কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে।'

প্রিয় পাঠক! আসুন তাহলে জেনে নেই সেই অমর প্রেমের স্মৃতি বিজড়িত কবি তীর্থ দৌলতপুরে কবি আগমনের প্রেক্ষাপট, এবং ফিরে যায় কবির সেই ৯৫ বছর আগেকার দিনগুলোতে। যেখানে আমতলা থেকে ভেসে আসবে কবির বাঁশির সুর। কিম্বা দেখা যাবে কোনো এক জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা ইরানি পুষ্প, লাজনম্র নার্গিসের মুখ।

১৯২০ সাল। কবি হিসেবে নজরুল তখন মোটামুটি খ্যাতির আসনে সমাসীন। সে সময় তাঁর সঙ্গে পরিচয় ও কিছুটা ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে প্রকাশক আলী আকবর খানের। আলী আকবর খান কবিকে তাঁর গ্রামের বাড়ি দৌলতপুরে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব করেন। কবি তখন নবযুগ পত্রিকার কাজে ইস্তফা দিয়ে অবসর সময় পার করছেন। তাছাড়া উড়ন্ত স্বভাবটাওযে মিশে রয়েছে কবির রক্তের সাথে। কবি সহসা খানের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। অতঃপর ১৯২১ সালের এপ্রিল (১৩২৭ চৈত্র) মাসে আলী আকবরের সাথে কবি নজরুল সর্বপ্রথম মুরাদনগরের দৌলতপুরে পা রাখেন।

তখনকার সময়ে এলাকায় খান বাড়ির যথেষ্ট সম্মান ও প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। আলী আকবরের নির্দেশে কবির আগমন উপলক্ষ্যে তোরণ সাজানো হয়। ফুল ছিটিয়ে বরণ করা হয় কবিকে।

কবিকে থাকতে দেওয়া হয় পুকুরের ধারে একটি বৈঠকখানায়। আলী আকবরের বিধবা বড় বোন এখতারুন্নেসা ছিলেন খান বাড়ির কর্ত্রী। তার কোনো সন্তান ছিল না বলে কবি তাকে মা বলে ডাকলেন। এখতারুন্নেসাও পুত্রস্নেহে গ্রহণ করে নেন এই নজরুলকে। খাঁ-বাড়িতে নজরুলের দিনগুলো হয়ে উঠে উচ্ছ্বল ও আনন্দময়। পুকুরে সাঁতার কেটে, বুকপানিতে ভেসে উদাত্ত কণ্ঠে গান করে, আমগাছের নিচে বসে বাঁশি বাজিয়ে সময় কেটে যাচ্ছিল তাঁর।

খাঁন বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার উত্তরে মুন্সী বাড়িতে বিয়ে দেয়া হয়েছিল আলী আকবর খাঁনের বোন আসমতের নেসাকে। বাবার বাড়ি একই গ্রামে হওয়ায় আসমতের নেসা প্রায়-ই বাবার বাড়ি থাকতেন, তাঁর সাথে থাকতেন মেয়ে সৈয়দা খাতুনও। একসময় সৈয়দা খাতুনের বড় ভাই জব্বার মুন্সীর সাথে মামা নেজাবত আলী খানের মেয়ে আম্বিয়া খাঁনমের বিয়ে ঠিক হয়। দিন স্থির হয় ১৯২১ সালের ৫ মে (বাংলা ২২বৈশাখ)।
সেই বিয়েতে নজরুলও যোগ দেন ।

জনশ্রুতি এবং ঐতিহাসিকদের মতে ওই দিনই ভাইয়ের বিয়েতে আসা ষোড়শী সৈয়দা খাতুনের সাথে কবি নজরুলের প্রথম দেখা হয়। পরে ধীরে ধীরে তাদের মাঝে গড়ে ওঠে সখ্যতা। নজরুল ইরানি ফুলের নামে তাঁর নাম রাখেন নার্গিস আসার খানম। নার্গিসের রূপ মাধুরী ও প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে কবি নজরুল দৌলতপুরে অবস্থান করেন দীর্ঘ ৭০ দিন।

দৌলতপুরে একটানা থাকাকালে সৃষ্টি হয় নজরুল-নার্গিসের প্রেমের সম্পর্ক।

এক পর্যায়ে আলী আকবর ভাগ্নি নার্গিসকে নজরুলের সাথে ঢাকঢোল বাজিয়ে একই বছরের ১৭ জুন শুক্রবার রাতে বিয়ে দেন। বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন জমিদার রায় বাহাদুর উপেন্দ্র লোচন মজুমদার, কুমিল্লা থেকে আগত আলী আকবরের বন্ধু বীরেন্দ্র, তাঁর মা গিরিবালাসহ পুরো পরিবার।

বিয়ের দিনই কী এক কারণে নজরুলের সঙ্গে মতান্তর হয় আলী আকবরের। অনেকের মতে, কাবিননামায় স্থায়ীভাবে কুমিল্লায় বসবাস করতে হবে, এমন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল বলেই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন নজরুল। তার পর বিয়ের রাতেই দৌলতপুর ছেড়ে কুমিল্লায় চলে যান। এই আকস্মিক চলে যাওয়ার পর নজরুল কুমিল্লায় আরো কয়েকবার এলেও দৌলতপুরে আর কোনো দিন আসেননি। তবে প্রিয়তমার বিরহের দাবানলে জ্বলেছেন সর্বক্ষণ। যে কথা নজরুল নিজেই নিঃসংকোচে ব্যক্ত করেছেন নার্গিসকে লেখা চিঠিতে।

তিনি লিখেছেন- ...'আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি আসীম বেদনা ! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি— তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না—আমি ধুমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।'...

সত্যি! নজরুলের জীবনে নার্গিসই একমাত্র নারী ছিলেন, যার কল্যাণে পৃথিবীতে নজরুলের মতো একজন বিখ্যাত কবির সৃষ্টি হয়েছিলো। যার প্রেমের উষ্ণ আবেশে অসংখ্য অনবদ্য সৃষ্টিতে বিস্তৃত হয়েছে নজরুল সাহিত্যের পরিধি। শুধুমাত্র দৌলতপুরে বসেই কবি নজরুল লিখেছিলেন ১৬০টি গান এবং ১২০টি কবিতা। উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলো হলো- ‘বেদনা-অভিমান’, ‘অ-বেলা’, ‘অনাদৃতা’, ‘পথিক প্রিয়া’, ‘বিদায় বেলা’ প্রভৃতি।

নজরুল চলে যাবার পরও নার্গিস তাঁর জন্য ১৭ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু ১৯৩৭ সালে নার্গিসের মামাতো ভাই নোয়াজ্জস আলী টুক্কু খাঁন (তৎকালীন ইউপি ভাইস প্রেসিডেন্ট) কলকাতায় গিয়ে নজরুলের কাছ থেকে এক প্রকার জোর পূর্বক বিয়ের তালাক নামায় নজরুলকে স্বাক্ষর করান। অতঃপর জোর করেই নার্গিসকে বিয়ে দেন কবি আজিজুল হাকিমের সাথে।

আজ নজরুল, নার্গিস, আলী আকবর এদের কেউই বেঁচে নেই। তবে বেঁচে আছে একটি অমর প্রেম কাহিনী আর অসংখ্য স্মৃতি। রয়েছে নজরুল-নার্গিসের বাসর ঘর। তবে সেই আটচালা ঘরটি এখন আর নেই। সেটি সংস্কার করে রূপান্তর করা হয়েছে চৌচালা ঘরে। এ ঘরেই রাখা হয়েছে নার্গিসের ব্যবহার করা সেই কাঠের সিন্দুকটি।

এক সময় এ ঘরে নজরুল-নার্গিসের বাসর খাটটিও ছিল। সেটি এখন পাশের একটি সেমিপাকা টিনের ঘরে রাখা হয়েছে।

বাড়ির পাশেই রয়েছে কবির স্মৃতিবিজড়িত পুকুর ও পুকুরপাড়ের আমগাছ। আমগাছটিতে রয়েছে একটি সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডে কবি বুলবুল ইসলামের তথ্যের আলোকে লেখা রয়েছে নজরুল সম্পর্কে কিছু কথা। সেখানে বলা হয়েছে কবি এ আমগাছের নিচে শীতলপাটি বিছিয়ে লেখালেখি করতেন এবং খানবাড়ির ছেলেমেয়েদের নাচ-গান শেখাতেন। আর এ পুকুরে কবি গোসল করতেন, সাঁতার কাটতেন, মাছও ধরতেন।

খাঁনবাড়ি, আমগাছ, পুকুরঘাট ছাড়াও এ গ্রামে আছে নজরুলমঞ্চ ও মাঠ। কবির জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্রতিবছর এ মাঠে দুইদিন ব্যাপি গ্রামীণমেলা বসে। আয়োজন করা হয় নজরুল অনুষ্ঠানের। এছাড়া কবির স্মৃতি ধরে রাখতে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নার্গিস-নজরুল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও নার্গিস-নজরুল সংগীত নিকেতন। কিন্তু এই অসংখ্য স্মৃতির অনেক জায়গাতেই নেই কোনো স্মৃতিফলক। কবিতীর্থ দৌলতপুর ইতিহাসের পাতায় ঠাই পেলেও রক্ষা হয়নি তার ঐতিহ্য।

প্রতি বছর কবির জন্ম ও মৃত্যু-বার্ষিকীতে কবির স্মৃতি রক্ষায় সরকার ও নজরুল প্রেমীদের অনেক প্রতিশ্রুতি ও তৎপরতা দেখা গেলেও পরে আর তা বাস্তবায়ন হয় না। কবির স্মৃতিচিহ্ন রক্ষা কিংবা সংরক্ষণে নেয়া হয় না কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ। তাই বলা যায় দৌলতপুর আজও অবহেলিত ও উপেক্ষিত।

নজরুল দ্রোহ ও প্রেমে, কোমল-কঠোরে বাংলা সাহিত্য ও সংগীতে দিয়েছেন এক নতুন মাত্রা। তিনি ছিলেন মানবতার জয়গানে উচ্চকণ্ঠ। লিখেছেন,
'গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান...'।

সেই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আজ ১১৮ তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করছি হৃদয়ের গহীন থেকে। মাগফিরাত কামনা করছি কবির বিদেহী আত্মার। পাশাপাশি কবিতীর্থ দৌলতপুরে কবি নজরুলের মূল্যবান স্মৃতিগুলো রক্ষার্থে সুদৃষ্টির প্রত্যাশা করছি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।

লেখক : ইমাম, বাইতুল মামুর জামে মসজিদ, তালুক পাড়া, কুমিল্লা।
aminulislamhossaini15@gmail.com


সম্পর্কিত খবর