শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


আল্লামা বিজনুরি: ছিলেন দেওবন্দি চেতনার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা আবুল ফাতাহ কাসেমী : আবেগে আনন্দে মথিত অবাক! দু’হাজার চৌদ্দের কোন এক সকালে। ঐতিহাসিক দারুল উলুম দেওবন্দের হাদীসের মসনদে প্রথম সাক্ষাৎ পেলাম  ক্ষণজন্মা মনীষী প্রিয় শিক্ষক আল্লামা রিয়াসাত আলী বিজনুরী রহ. এর। এরপর থেকে থেকে অনেক স্বৃতি।

হুজুর দেওবন্দে হাদীসের প্রসিদ্ধ কিতাব সুনানে তিরমিযির ১ম খণ্ড পড়াতেন। শিক্ষাসচিবও ছিলেন দীর্ঘ দিন। তিনি বিশিষ্ট আরবী সাহিত্যিক মাওলানা রহমাতুল্লাহ কিরানভী রহ. এর একান্ত শিষ্যও বটে। তাছাড়া ভারতের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সহসভাপতি ছিলেন। ছিলেন দেওবন্দের মুশিরে মুহতামিমও। বিশেষত ফখরুল মুহাদ্দিসিন আল্লামা ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী-এর বুখারী ক্লাসের আলোচনা সংকলন ‘ইযাহুল বুখারী’ তার ঐতিহাসিক র্কীতি। এতবড় একজন আলিমের ছাত্র হতে কার না গর্ব হয়।

জীবনে প্রথম কিভাবে নাম শুনেছিলাম তা মনে নেই। তবে ‘ইয়েহ ইলমে হুনারকা গেহওয়ারা’ এমন চয়িত শব্দের সানিন্দ উচ্চারণ কওমিয়ান কেউ শুনে নি, তা ভাবার উর্ধ্বে।

আমাদের চেতনার পিদিম দেওবন্দের প্রবাদপুরুষ আর নেই এমন খবর অপ্রত্যাশিত। দারুল উলুম দেওবন্দ তার সু সময়ে যে ক’জন প্রবাদতুল্য আলিমকে নিয়ে গর্ব করে থাকে হযরত বিজনুরী তাদের একজন।

তিনি অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। শ্বেতশুভ্র বসন। মাদানী দু’পাল্লা টুপি। হঠাৎ দেখলে মনে হবে আলোর ঝটকা প্রভা ছড়াচ্ছে। খর্বকায় তবে ততটা নয়। হেটে চলার দৃশ্য দেখলে যে কেউ বিনয় প্রভার সাক্ষ্য দিবেন। আমাদের সময়ে হুজুর দরস ছাড়া কোন প্রোগ্রামে যেতেন না। বাসা টু মসজিদ এ ছিল নিত্য দিনের রুটিন।

২০১৪ সালে ঐতিহাসিক রেশমি রুমাল আন্দোলনের শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের উদ্যোগে আয়োজিত আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে হুজুর শান্তির পক্ষে ইসলামের ভূমিকার উপর কী নোট পাঠ করেন। তখন দেওবন্দের ইদগাহে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশে বিনয়ির বেশে হুজুরকে দরসের বাহিরে দেখেছি। হুজুরের শারীরিক অসুস্থতা ছাড়া কোন ক্লাস মিস হয়েছে বলে মনে পড়ে না।

আমি কয়েক দিন সাহস করে একা একা হুজুরের বাসায় গিয়েছি সুহবতের জন্য। সাধারণত বিকালটায় হুজুর সময় দেন। সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে চা আপ্যায়ণ। আলেমদের পারষ্পরিক গিবত চর্চা নিয়ে হুজুরকে আক্ষেপ করে একদিন অনেক কথা বললাম। হুজুর আমায় সোনার হরফে লেখা কিছু কথা বললেন। যা আজও কানে গুঞ্জরিত হচ্ছে থেকে থেকে।

দেখ, কারো সমালোচনা করা উচিৎ নয়। কেউ সমালোচনা করলে এর পিছনে না পড়ে নিজের কাজ নিজে করা উচিৎ। আমাদের ইন্ডিয়ার একটি সাপ্তাহিক ‘আখবারে নুহ’ তে হযরত আসআদ মাদানী রহ. কে নিয়ে বাজে মন্তব্য করা হলো। আমি হযরতকে বললাম, হযরত এরা আপনার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছে আপনি পত্রিকায় একটি বিবৃতি দেন। তখন হযরত আমাকে উত্তর দিলেন তারা তো আমার কাছে পয়সা চায়। আমার কাছে তাদের মুখ বন্ধ করার পয়সা নেই। দুনিয়ার কারো কাছে সমালোচনা বন্ধ করার পয়সা নেই। হুজুরের এ মুল্যবান বাণী শুনে যারপরনায় পুলকিত হলাম।

তার অনেক গুণের মধ্যে সারল্যতার গুণটিই অনেকের মতো আমাকে অবাক করেছে। যে কেউ কাছে গিয়ে অনায়েসে কথা বলতে পারতো। মালিবাগ জামিআর মাদানী দর্শনে আপ্লুত হযরত কাজী সাহেব রহ. এর মৃত্যু সংবাদ ও হুজুর সম্পর্কে বাণী আনার জন্য একবার বিজনুরী হুজুরের কাছে গিয়েছিলাম। হাসিতে সারল্যের দীপ্তি টেনে অনেক স্মৃতি বললেন। প্রতি মুহূর্ত অভাবিত শ্রদ্ধায় স্যালুট করতাম আমাদের এ শ্রদ্ধাষ্পদেষুকে।

বাংলাদেশের প্রথিতযশা অনেকেই হুজুরের শাগরিদ। এর মধ্যে সব্যসাচি লেখক আমাদের উস্তাদ মাওলানা যাইনুল আবেদীনও একজন। তিনি অভাবিত আকর্ষণে স্মৃতিচারণ করলেন অনেকটা এভাবে, হুজুরের ভদ্রতা ও আখলাকি উদারতা আমাদের দেশের মানুষকে বুঝানো যাবে না । হুজুর ছিলেন সাদামাটা শুচিময়। আমি হুজুরের কাছে ইবনে মাজাহ, সাবয়ে মুআল্লাকা ও আল বালাগাতুল ওয়াজিহাহ পড়েছি। হুজুর ইবনে মাজাতে ঈমানের আলোচনায় যে তাকরির করতেন তা আমরা বুখারি মুসলিমের ব্যাখ্যা গ্রন্থেও খুঁজে পেতাম না।

আরবী সাহিত্যের কিতাব সাবয়ে মুআল্লাকা পড়ার সময় তিনি কবিদের ফিকরি চিন্তা ও মানসের উচ্চতা আলোচনা করতে গিয়ে উর্দু সাহিত্যের বিখ্যাত কবিদের কবিতা অনর্গল বলে যেতেন।

তিনি ছিলেন আমাদের দেওবন্দি চেতনার বলিষ্ঠ চিন্তাবীদ। আমি মনে করি দীনী শিক্ষা বিষয়ে পৃথিবীর প্রথমসারির এক দু’জনের একজন। যে কোন সংকট উপলব্ধি করার ক্ষমতা ছিলো অতুলনীয়। হুজুরের ভাষায় মুঝ সে মিট্টি বাত করতি হ্যায়...অর্থাৎ মাটি আমার সাথে কথা বলে। দেওবন্দের র্স্বণ সন্তানদের তালিকায় হুজুর শীর্ষস্থান। হুজুরের সেরা সৃষ্টিকর্ম হচ্ছে ঐতিহাসিক তারানায়ে দারূল উলুম দেওবন্দ।
পাঠক, কালের কর্ষণে জীবনে যেভাবে বেগ বাড়ছে আমরা সেভাবে হারাচ্ছি আবেগও। বিশষণের ক্লান্তিকর কবিতা নয়। চেতনার কবিতা গেয়ে বলি, তিনি আমাদের লালিত শ্রদ্ধার পাঠস্থান। আজ থেকে আমরা নববী ইলমের দৃশ্য ছায়া হয়ে দেখবো আমাদের এ মাহফিলে।

-এআরকে


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ