গত ৮ মে সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো দেশের ৪০৮ বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। বিবৃতি নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে চলছে আলোচনা।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে মূলত ইসলামপন্থীদের সঙ্গে সরকারের সমঝোতাকে ইঙ্গিত করা হয়।
তারা শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘ক্ষমতায় থাকতে অথবা আবার ক্ষমতাসীন হতে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে সঙ্গে রাখার অশুভ প্রতিযোগিতায় নেমেছে সরকার। তাদের এই মনোভাব দেশকে নিয়ে যাবে ভয়াল অন্ধকারে।’
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘নববর্ষ ও মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে আক্রমণের পাশাপাশি ভাস্কর্য অপসারণের দাবি জানানো মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে আপস করছে সরকার। এজন্য কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমান দেওয়া, পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিজনিত পরিবর্তন এবং পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান সংকুচিত করা হয়েছে। এমন আত্মসমর্পণের ঘটনায় দেশের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক নাগরিকরা ব্যথিত, ক্ষুব্ধ ও হতাশ।’
বিশিষ্টজনরা সরকারকে ‘আত্মঘাতী খেলা’ থেকে বেরিয়ে আসার দাবি জানান বিবৃতিতে। এমন ‘অশুভ তত্পরতা’র বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সব দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রতিও আহ্বান জানানো হয়েছে এতে।
সম্প্রতি দেশের বেশকিছু ঘটনায় বিশিষ্টজনরা উত্কণ্ঠিত বলে উল্লেখ করা হয় যৌথ বিবৃতিতে। তবে সুপ্রিম কোর্টের সামনে নির্মিত ভাস্কর্যটি মানসম্পন্ন হয়নি বলে স্বীকার করেছেন তারা। তবে বিবৃতিতে বিশিষ্টরা প্রশ্ন করেছেন, ‘ঢাকাসহ সারাদেশে নির্মিত ভাস্কর্যগুলোর সবকটি কি মানসম্পন্ন?’ তাদের পরামর্শ— যদি ভাস্কর্যগুলো মানসম্পন্ন না হয়ে থাকে এবং শিল্পমানের ঘাটতি থেকে থাকে, তাহলে দেশের প্রতিভাবান শিল্পীদের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে এর মানোন্নয়নের জন্য। কিন্তু হেফাজতের দাবির সঙ্গে সুর মেলানো কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন তারা।
মৌলবাদের তোষণনীতির কারণেই পাঠ্যপুস্তকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে বলে অভিযোগ বিশিষ্টজনদের। বিবৃতিতে তারা বলেছেন, ‘এ বছর প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে যেসব পরিবর্তন এসেছে, তা স্বাভাবিক নিয়ম মেনে হয়নি। পাঠ্যপুস্তকের ১৩ জন সম্পাদক গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, এগুলো করা হয়েছে তাদের অজান্তে। পাঠ্যপুস্তকের এই সাম্প্রদায়িকীকরণের ঘটনায় ম্লান হয়ে গেছে বিনামূল্যে সব শিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য। ছাপার ভুল, বানান-তথ্য-ইতিহাসের বিকৃতির ঘটনা প্রাথমিকভাবে দায়িত্বে অবহেলা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসেছে এসবের পেছনের অভিসন্ধি।’
বিবৃতিতে বলেন, ‘উগ্র সাম্প্রদায়িক এই চিহ্নিত গোষ্ঠী বাঙালির প্রতিটি ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রেই এটি পরিলক্ষিত হয়েছে। কেবল বিরোধিতা নয়; বিদেশি কায়েমি স্বার্থ, সাম্রাজ্যবাদ ও হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হয়েছিল। সেই চিহ্নিত গোষ্ঠী পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আনুকূল্য পেয়ে দানবে পরিণত হয়েছে।’
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে আছেন আহমদ রফিক, কামাল লোহানী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যতীন সরকার, সৈয়দ হাসান ইমাম, হাসান আজিজুল হক, ডা. সারওয়ার আলী, মফিদুল হক, সনৎ কুমার সাহা, অজয় রায়, অনুপম সেন, কবি নির্মলেন্দু গুণ, আবুল মোমেন, শিল্পী আনোয়ার হোসেন, দ্বিজেন শর্মা, বেগম মুশতারী শফি, লায়লা হাসান, মামুনুর রশীদ, রফিউর রাব্বি, ড. ইনামুল হক, লাকী ইনাম, চলচ্চিত্রকার মসিউদ্দিন শাকের, এ এন রাশেদা, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, আবেদ খান, চিত্রশিল্পী আবুল বারক আলভী, অধ্যাপক কাবেরী গায়েন, সঞ্জীব দ্রং, আবৃত্তিশিল্পী রূপা চক্রবর্তী, নৃত্যশিল্পী তামান্না রহমান, নাট্যজন রোকেয়া রফিক, অধ্যক্ষ আকমল হোসেন, ডা. রশিদ ই মাহবুব, নিখিল সেনসহ অনেকে।
এছাড়া বিবৃতিতে রংপুর, যশোর, ময়মনসিংহ, বগুড়া, রাজশাহী, গোপালগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নাম রয়েছে বিবৃতিতে।
তবে দেশের ইসলামপন্থী রাজনীতিকগণ এই বিবৃতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ বিষয়ে ইসলামী রাজনীতিক মাওলানা আহমাদ হাসান বলেছেন, ইসলামপন্থীরাও দেশের নাগরিক। তাদের দাবি মেনে নেয়া কোনো খারাপ বিষয় নয়। মূলত ওই নাগরিকরা স্বার্থবাদী বলেই তা মেনে নিতে পারছেন না।
শবে বরাত: না বাড়াবাড়ি, না ছাড়াছাড়ি