মাওলানা জামিল আহমাদ: মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত কিন্তু কাজ অনেক বেশি। এজন্য উপরের জামাতের নেসাব কিছুটা দীর্ঘ রাখা হয়েছে। তাই এসব জামাতের ছাত্রদের বছরের শুরু থেকে হিসাব করে পড়ালেখা করা উচিত।
তাকমিল বা দাওরায়ে হাদিস সর্বোচ্চ জামাত। এ জামাতের নেসাব যেমন দীর্ঘ, সে তুলনায় পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক পড়ালেখার সময়-সুযোগ অনেক কম। যার ফলে পরীক্ষার পূর্বে সবক’টি কিতাব পূর্ণ শেষ করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য তাকমিল জামাতের ছাত্রদের ভাল ফলাফল করতে পরিকল্পিত নিয়ম-মাফিক পড়ালেখা করা অতি জরু রি।
সকল কিতাব সামনে রেখে প্রত্যেক কিতাবের পড়ার মতো বিষয়গুলো প্রথমে তিন ভাগে ভাগ করতে হবে।
১। প্রত্যেক কিতাবের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করতে হবে।
২। যে বিষয়গুলো একাধিক কিতাবে রয়েছে তা নির্ধারণ করতে হবে।
৩। প্রত্যেক কিতাবে কিছু স্বতন্ত্র বিষয় রয়েছে তা চিহ্নিত করতে হবে।
প্রথম প্রস্তুতি
১। গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো শফিক উস্তাদের পরামর্শ নিবে। এছাড়া বেফাকের প্রশ্নপ্রত্র দেখেও নির্ধারণ করা যেতে পারে। অত:পর গুরু ত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তালিকাভুক্ত করার পর যে বিষয়গুলো অতি গুরু ত্বপূর্ণ মনে হয় তা বিশেষ চিহ্নে চিহ্নিত করতে হবে। যাতে পড়ার সময় উক্ত বিষয়গুলো অতিগুরু ত্বসহকারেই পড়া হয়।
২। যে বিষষগুলো একাধিক কিতাবে রয়েছে, তা কিতাবের সূচি সামনে রেখেই তালিকা করবে। যেমন, কিতাবু তাহারাতের মাসআলা প্রায় সব কিতাবেই রয়েছে। কিতাবুল বুয়ূ-এর মাসআলা বুখারি-১ মুসলিম-২ এর মাঝে উল্লেখযোগ্য বিষয়। তেমনি কিতাবুস সালাত, কিতাবুয যাকাত ও একাধিক কিতাবে রয়েছে। যে সব বিষয় একাধিক কিতাবে রয়েছে তার মাঝে গুরু ত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইখতিলাফি মাসআলা।
ইখতিলাফি মাসআলা হল
ইখতিলাফি মাসআলা হল করার জন্য প্রত্যেক ছাত্রের করণীয় থাকবে প্রত্যেকটি মাসআলাকে পয়েন্ট ভিত্তিক জমা করা ইমামদের মাযহাব ও আকওয়াল এবং প্রত্যেকের দলিল ভালভাবে মুখস্ত করা।
সহযোগিতা
ইখতিলাফি মাসআলাগুলোকে হল করতে প্রথমে আরবি শরাহগুলোকেই গুরু ত্ব দেয়া। যেমন আওযাজুল মাসালিক এবং ইউসুফু বিননূরী রহ.-এর মাআরিফুস্ সুনান। যদি ‘আরবি শরাহ’দেখা সম্ভব না হয়, তাহলে উর্দু শরাহ দেখবে যেমন দরসে তিরমিযি ও তানযিমুল আশতাত ইত্যাদি মুতাআলা করা। কেউ বাংলায় উত্তর দিলে বাংলা শরাহগুলো পড়া ও বাংলা উপস্থাপনা সাজানো-গুছানোর পদ্ধতি সেখান থেকেই আয়ত্ব করা। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় হলো সম্ভব হলে আকওয়াল ও দালায়েল নোট করবে। যাতে পরীক্ষার দিন অতি সহজেই নজরে সানি করা যায়।
স্বতন্ত্র বিষয়
প্রতিটি কিতাবেই কিছু স্বতন্ত্র বিষয় রয়েছে এগুলো আলাদা সময় নিয়ে ‘হল’ করতে হবে। যেমন: বুখারি-১ম খন্ডে কিতাবুল ওহি, কিতাবুল ঈমান, কিতাবুল ইলম-এর হাদিসগুলোর এ’রাব, তরজমা, তাশরিহ, তরজমাতুল বাব ও হাদিসের সঙ্গে তার মুনাসাবাত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বুখারির তরজমাতুল বাব, মুনাসাবাত ও কিতাবুল ওহি হল করার জন্য শায়খ যাকারিয়া রহ.-এর ‘আল আবওয়াব ওয়াত্বারাজিম’ খুবই উপকারী। বুখারি-২-এর মধ্যে স্বতন্ত্রভাবে পড়ার মতো বিষয়গুলো হলো ‘কিতাবুল মাগাজি’, ‘কিতাবুত তাফসির, এবং কলা বায়াজুন্নাস। এছাড়াও হাদিসের সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনা জানা থাকা আবশ্যক।
মুসলিম-১ এর জন্য ‘মুকাদ্দামায়ে মুসলিম’ আলাদাভাবে পড়তে হবে। এছাড়া অন্যান্য বাব যেমন ‘কিতাবুল ঈমান’ ইত্যাদি অন্য কিতাবের সাথে মিল রেখে পড়লে অনেকাংশে সহজ হবে।
আবু দাউদ শরিফে ‘কলা আবু দাউদ’ বিশেষ গুরু ত্ব দিয়ে হল করতে হবে। তিরমিযির মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় ‘কল আবু ইসা’ রয়েছে এবং ইমাম তিরমিযি রহ.-এর বিশেষ বিশেষ ব্যাখ্যাও রয়েছে। এগুলো ভিন্নভাবে হল করতে হবে। সাথে সাথে ইমাম তিরমিযি রহ. এর স্বতন্ত্র ইসতিলাহাত হা’যা’ হাদিসুন সাহিহুন গারিবুন ইত্যাদির মতলব জানা থাকতে হবে। শামায়েলে তিরমিযির জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রস্তুতি লাগবে। এর বিষয়বস্তু অন্য কিতাবের সঙ্গে যেহেতু মিল নেই, তাই গুরু ত্বপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করে কঠিন কঠিন শব্দগুলোর তাহকিকসহ পড়তে হবে। বিশেষ করে হযরত হিন্দা ইবনে আবি হালা রা.-এর দীর্ঘ হাদিসটি হল্লে লুগাতসহ পড়বে। এছাড়া সমস্ত হাদিসের তরজমা ও বিভিন্ন শব্দের মতলব অবশ্যই পড়তে হবে।
ইবনে মাজাহ-এর মুশকিল হাদিসগুলোর এ’রাব ও তরজমা উভয়টি হল করতে হবে। তহাবি শরিফে নজরে তহাবি বিশেষ গুরু ত্বের সাথে হল করতে হবে। আর ইখতিলাফি মাসআলা অন্যান্য কিতাবের সাথে মিল রেখেই পড়বে। মুয়াতায়ে মুহাম্মদ ও মুয়াতায়ে মালিক থেকে বিষয়ভিত্তিক কিছু হাদিস মুখস্ত করবে।
বি:দ্র: ফিকহি মাসআলার ক্ষেত্রে ইমামগণের ভিন্ন ভিন্ন মতামত দলিল এবং তাদের দলিলের জবাবসহ নিজের মাজহাবের প্রাধান্যতার কারণগুলো বিশেষভাবে জেনে নিতে হবে।
রিভিশন
রিভিশন শুরু করার আগে পরীক্ষা পর্যন্ত কতো সময় হাতে আছে সে হিসাব কষতে হবে এবং কোন কিতাব কখন রিভিশন করতে হবে, সেই পরিক-না নিতে হবে। তারপর অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে রিভিশন শুরু করবে।
প্রথম রিভিশন
প্রথমে প্রত্যেক কিতাবের সববিষয় রিভিশন দিবে। তারপর গুরু ত্বপূর্ণ বিষয়গুলো রিভিশন দিবে। সম্ভব হলে চিহ্নিত করা অতি গুরু ত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মুখস্ত লিখে অনুশীলন করবে। একাধিক কিতাবে যেসব বিষয় রয়েছে তা তালিকা অনুযায়ী রিভিশন দিবে। বিশেষ করে ইমামদের মতামত এবং দালায়েল ভালভাবে পূণরায় পড়বে। আর প্রত্যেক কিতাবের স্বতন্ত্র বিষয়গুলো রিভিশন করার সময় চিহ্নিত করে রাখবে। যাতে পরীক্ষার দিন অতি সহজেই পড়া যায়।
দ্বিতীয় রিভিশন
কিতাবের সববিষয় রিভিশন করার চেয়ে শুধু সারাংশ রিভিশন দিবে। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখবে নতুন কোন বিষয় গুরু ত্বপূর্ণ মনে হলে তা অবশ্যই নোট করবে। যা পরীক্ষার দিন অনেক সহায়ক হবে বলে মনে হয়।
সর্বশেষ রিভিশন
সর্বশেষ রিভিশন করার সময় শুধু মৌলিক পয়েন্টসমূহ দেখাই যথেষ্ট। এক্ষেত্রে একা একা রিভিশন করার চেয়ে কোন ছাত্রের সাথে মিলে রিভিশন করা ভাল। এভাবে রিভিশন করলে একে অপরকে জিজ্ঞাসা করা যায় এবং পরস্পরের দুর্বলতা নির্ণয করা সহজ হয়।
বি: দ্র: অধিকগুরু ত্বপূর্ণ স্থানসমূহ ভালভাবে প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে কি না দ্বিতীয়বার নিজে নিজে যাচাই করা।
পরীক্ষার দিনগুলোতে পড়া-লেখা
পরীক্ষার দিনগুলোতে পরীক্ষার রু টিন মাথায় রেখেই পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে হবে। রু টিন অনুযায়ী যে দিন যে কিতাবের পরীক্ষা প্রথমে ঐ কিতাবের গুরু ত্বপূর্ণ স্থানগুলো ভাল করে কয়েক বার পড়ে নিবে। অত:পর ঐ কিতাবের স্বতন্ত্র বিষয়গুলো মনযোগসহকারে পড়বে। সর্বশেষ যেসব বিষয়গুলো একাধিক কিতাবে রয়েছে তা তালিকা অনুযায়ী গুরু ত্বসহকারে পড়বে। বিশেষ করে ইখতেলাফি মাসআলা, ইমামদের মতামত ও দালায়েল পরীক্ষার হলে যাওয়ার পূর্বে সকাল বেলা অবশ্যই দ্বিতীয়বার দেখে যাবে।
সতর্কতা
পরীক্ষার আগের দিন পরীক্ষার সময়সূচি ও পরীক্ষার স্থান ভালভাবে জেনে নিবে। পরীক্ষার রাত বেশি সময় জাগ্রত থাকার চেয়ে পরিমিত ঘুমানো উচিৎ। যাতে করে পরীক্ষার হলে ঘুমের ভাব না থাকে এবং মস্তিষ্ক শান্ত থাকে। পরীক্ষার আগের রাতে শরীর ও মনকে পরিমিত বিশ্রাম দেয়া দরকার । পড়তে পড়তে মাথা জ্যাম করে পরীক্ষার হলে যাওয়ার চেয়ে ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষার হলে যাওয়া উত্তম। কারণ পরীক্ষার রাতে অধিক রাত জেগে পড়াশোনা কারলে কারো কারো বমি বমি ভাবও থাকে, যার কারণে ভালভাবে পরীক্ষার উত্তর লিখা সম্ভব হয়না।
পরীক্ষার হলে করণীয়
পরীক্ষার নির্দিষ্ট সময়ের আধা ঘণ্টা আগে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছা উত্তম। যাতে একটু রেস্ট নিয়ে পরীক্ষার হলে যাওয়া যায়। পরীক্ষার হলে প্রবেশের পর আপনাকে যে উত্তরপত্র দেওয়া হয়েছে তা যথাযথ কি না তা প্রথমে দেখে নিন। প্রশ্ন ভালভাবে পড়–ন। আপনাকে কয়টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে তা দেখে নিন। প্রশ্নপত্রে উল্লেখিত সকল প্রশ্নেরই উত্তর দিতে হবে, না অতিরিক্ত প্রশ্ন আছে? অতিরিক্ত প্রশ্ন থাকলে আপনার কাছে অধিক সহজ প্রশ্নগুলোতে টিক চিহ্ন দিন। প্রশ্ন দেখার সময় ভালভাবে লক্ষ্য করবেন, এমন কোনো প্রশ্ন আছে কি না যার জবাব দেয়া বাধ্যতামূলক। উত্তর লেখার পূর্বে প্রত্যেক প্রশ্নের ছোট-বড় উত্তরের জন্য সময় নির্ধারণ করু ন। তথা প্রথম প্রশ্নের আলিফের জন্য দশ মিনিট বা-এর জন্য সাত মিনিট ইত্যাদি।
পরীক্ষার খাতায় অপ্রয়োজনীয় কিছু লিখবেন না। লেখা সুপাঠ্য হওয়া দরকার। অনেক সময় ভালছাত্রের লেখাও পড়তে কষ্ট হয়। তাই তারা ভাল লিখেও কম নম্বর পায়। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আপনার কাছে খুব কঠিন মনে হলেও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়বেন না। কারণ মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লে আপনার জানা বিষয়ও ভালভাবে লিখতে পারবেন না। বরং আপনার জানা সহজ বিষয়ও কঠিন মনে হবে।
কোনো প্রশ্নের উত্তর লেখার সময় হঠাৎ কোনো তথ্য মনে না এলে তার জন্য চিন্তা করতে করতে সময় অপচয় করবেন না। লেখা চালিয়ে যাবেন, পরবর্তী সময় স্বরণ হলে উক্ত তথ্য যোগ করে দিবেন। আপনি একটি প্রশ্নের উত্তরের জন্য যে সময় বরাদ্দ করবেন উক্ত সময়ের মধ্যে কোনো প্রশ্নের উত্তর শেষ করতে না পারলে জায়গা খালি রেখে পরবর্তী প্রশ্নের উত্তর লেখা শুরু করবেন। কোনো প্রশ্নের উত্তর লেখার পর সময় বেচে গেলে পূর্বের প্রশ্নে খালি থাকা উত্তর পূর্ণ করবেন। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর চিন্তা করা উচিৎ নয়। কারণ, যা হওয়র তা হয়ে গেছে। এখন এ নিয়ে চিন্তা করতে থাকলে পরবর্র্তী পরীক্ষাও খারাপ হওয়ার আশঙ্খা রয়েছে। এজন্য পিছনের পরীক্ষার চিন্তা না করে সামনের পরীক্ষাটা কীভাবে ভাল করা যায়, সে চিন্তা মাথায় নিয়ে নবোদ্যমে পড়ালেখা করবেন।
বি: দ্র : বিশিষ্ট রাবিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ভিন্নভাবে সংগ্রহ ও ইয়াদ করে নিতে হবে। এটা সকল কিতাবের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আর মুসান্নিফগণের জীবনী আগে থেকে মুতাআলা করে রাখলেও পরীক্ষার দিন আবার পড়ে নিবে।
পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার কার্যকরি ১০ উপায়