হাসান আল মাহমুদ
বাংলাদেশে উচ্চতর গবেষণামূলক ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম শাইখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার।
রাজধানী ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সন্নিকটে কুড়িল ফ্লাইওভার ও কুড়িল লেকের মনোরম পরিবেশ সংলগ্ন কুড়াতলী বাজারের আল-হেরা টাওয়ারে অবস্থিত এই রিসার্চ সেন্টারটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৪৩১ হিজরী মোতাবেক ২০১০ সালে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই অনেক কওমি শিক্ষার্থীর স্বপ্নের ক্যাম্পাসে পরিণত হয়ে আসা এই রিসার্চ সেন্টার থেকে উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করতে ছুটে আসে বাংলাদেশের নানা প্রান্তের শিক্ষার্থী। তেমনই একজন শিক্ষার্থী আবু রায়হান। সুদূর দিনাজপুরের নিজ জেলায় দাওরায়ে হাদিস শেষ করে উচ্চতর শিক্ষার পাঠ নিতে ছুটে আসেন রাজধানী ঢাকার এই রিসার্চ সেন্টারে।
এখানে এসে তিনি ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে 'আত্তাখাচ্ছুছ ফিল ফিকহীল ইসলামি' ( ইসলামিক আইন শাস্ত্র) বিষয়ে কোর্স করার সুযোগ পেয়ে তিনি আপ্লুত। তিনি জানান, বসুন্ধরা মারকায থেকে ইফতা করার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এসে জানতে পারি মুফতি মিযান সাবের মাদরাসার অত্যধিক ফলপ্রসূ শিক্ষার কথা। এ প্রতিষ্ঠানের গুণগত মান আর খুছুছিয়াতের কথা শুণে আমি আমার স্বপ্নের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ! ইফতা প্রথম বর্ষ শেষের পথে। দ্বিতীয় বর্ষ শেষ করে এখানেই আরো কিছু বিষয়ে কোর্স করার ইচ্ছা আছে।
কথা হয় আদব (আরবী সাহিত্য) বিভাগের ছাত্র মুজ্জাম্মিল হকের সাথে। এখানে কেন আদব পড়তে এসেছেন? জানতে চাইলে তিনি জানান- 'আসলে আমার দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন আদব বিষয়ে তাখাচ্ছুছ অর্জন করার। কিন্তু কই পড়বো-কোথায় পড়বো তা নিয়ে ছিলাম বেশ চিন্তিত। দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস সমাপন করে ঢাকায় এসে আমার স্বপ্নের ঠিকানার খোঁজে ঘুরাঘুরি-অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম আদবের জন্য মুফতি মিযান সাবের মাদরাসাই আমার স্বপ্নের ঠিকানা। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এখানে ভর্তি হয়ে এখন বছর শেষের পথে। সামনে বার্ষিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এক বছরের আদব কোর্স শেষ হবে। আলহামদুলিল্লাহ! এই এক বছরে আমি এমন অনেক কিছু শিখতে পেরেছি যা আমার জ্ঞানকে ব্যাপক সমৃদ্ধ করেছে'।
কথা হয় উচ্চতর তাফসীর বিভাগের ছাত্র আসাদুজ্জামানের সাথে। তিনি জানান- 'চট্রগ্রামের ঐতিহ্যবাহী নানুপুর মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করে ঢাকায় এসেছি মুফতি মিযান সাহেব দা.বা. এর তত্ত্বাবধানে থেকে কুরআন ও হাদিসের ব্যাপক বুৎপত্তি লাভের আশায়। আলহামদুলিল্লাহ! এ প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত এক বছরের তাফসীর বিভাগে বিজ্ঞ উস্তাদদের স্নেহছায়ায় কুরআন বিষয়ে অধ্যয়ন,গবেষণা করে নিজেকে ব্যাপক সমৃদ্ধ করছি। এখানের ইফতা বিভাগে যদি আল্লাহ চায় তো আরো দুই বছর অধ্যয়ন, গবেষণায় কাটাবো'।
উচ্চতর উলুমুল হাদিস বিভাগের ছাত্র মুহাম্মদ হেদায়েতুল ইসলামের সঙ্গে কথা বললে জানান- 'আমার নিজ জেলা ফেনীতে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করে ঢাকায় এসেছি মুফতি মিযান সাবের মাদরাসায় উলুমুল হাদিস বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করতে। আলহামদুলিল্লাহ! বিজ্ঞ উস্তাদদের স্নেহছায়ায় থেকে উলুমুল হাদিস শাস্ত্রে ব্যাপক বুৎপত্তি অর্জন করে চলেছি'।
ব্যাপ্তিমান ইসলামের নানা বিষয়ে গবেষণার সূতিকাগার শাইখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন শাইখে সানী মুফতী তৈয়ব। তিনি জানান- 'হুজুরের (মুফতি মিযান সাহেব) সাথে আমি এবং আরো বেশ ছাত্র বসুন্ধরা মাদরাসা থেকে বের হয়ে আল্লাহর দয়ায় হুজুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কুড়িল-কুড়াতলী নিবাসী বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও দ্বীনের মজবুত দাঈ কাজী কামাল সাহেব নিজের আল-হেরা টাওয়ারের দ্বিতীয় তলাটি মাদরাসার জন্য (ওয়াক্ফক করে) দেওয়ায় আল্লাহর উপর ভরসা করে আমরা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি। আলহামদুলিল্লাহ! প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত আমরা অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।
তিনি জানান, এখানে আমরা কওমি মাদরাসা শিক্ষা সিলেবাসের সর্বোচ্চ দুই ক্লাসসহ তাখাচ্ছুছের চারটা বিভাগ ও হেফজ বিভাগ খুলেছি। প্রথম দিকে তাখাচ্ছুছের পাঁচটা বিভাগ ছিল। বিভাগগুলো হচ্ছে ১.হিফয বিভাগ। ২.মিশকাত ও দাওরায়ে হাদিস। ৩.উলুমল কুরআন (তাফসীর) বিভাগ (এক বৎসর)। ৪. উচ্চতর ইসলামী আইন গবেষণা (ইফতা) বিভাগ (দুই বৎসর)। ৫. উচ্চতর হাদিস (উলূমুল হাদিস) বিভাগ (দুই বৎসর)। ৬. আরবী সাহিত্য (আদব) বিভাগ (এক বৎসর)।
এছাড়া আরো রয়েছে বক্তৃতা প্রশিক্ষণ, নামায ও কিরাত প্রশিক্ষণ ও বিশেষ কারিকুলামে ইংরেজি ভাষার উপর দক্ষতা অর্জনের ইংরেজি প্রশিক্ষণ কোর্স। রয়েছে একটি উচ্চমানের দারুল মুতালাআ (পাঠাগার) এর ব্যবস্থা। তাতে ২০ লক্ষ টাকার কিতাব রয়েছে। প্রতি বছর ৫/৭ লাখ টাকার কিতাব কেনা হয়। অধ্যয়নের ফাঁকে ফাঁকে ফিকহী মজলিস অনুষ্ঠিত হয়। এতে মারকাযের মুহতারাম মুদির মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ আধুনিক ও জরুরি মাসআলার বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক সারগর্ভ আলোচনা পেশ করেন।
এই রিসার্চ সেন্টার থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত ও সমসাময়িক মুসলিম উম্মাহর জটির সমস্যাবলীর মৌখিক ও লিকিত সমাধান এবং ফাতওয়া প্রদান করা হয়। online এ ফাতওয়া প্রদানের আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণের কাজও এগিয়ে চলছে। www.muftimizan.com নামে একটি Website এর মাধ্যমে ইসলামের যে কোনো বিষয়ে জ্ঞান আহরণ ও প্রশ্নের জবাবসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালু রয়েছে। যুগশ্রেষ্ঠ ফকীহ, শাইখুল ইসলাম আল্লামা তাকী উসমানি’র সার্বিক দিক নির্দেশনায় এ বিভাগটির আরো উন্নতির প্রচেষ্টা চলছে।
রয়েছে মৃত ব্যক্তির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ওয়ারিসদের মধ্যে ইসলামী শরীয়া মোতাবেক সুষ্ঠু বন্টনে ফারায়েয বিভাগ। সাধারণ জনগণের বিশাল চাহিদা ও ছাত্রদের আমলি উন্নতির লক্ষ্যে ২৪ ঘন্টার জামআত বেরকরণসহ বিভিন্ন সময়ে তাবলীগের কাজ আঞ্জাম প্রদান, ইসলাহি ও তাযকিয়া কার্যক্রমের সর্বাঙ্গীণ সফলতার জন্য শাহ আবরারুল হক রহ: এর অন্যতম খলিফা মারকাযের মুদির মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ দা.বা. এর মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইসলাহি বয়ানেররম আয়োজন। রয়েছে online এ ফাতওয়া প্রদান ও দ্বীনি দাওয়াতি কর্যক্রম মিডিয়াতে সম্প্রচারের সুবিধার্থে কম্পিউটার ও ল্যাপটপের ব্যবস্থাপনা।
শাইখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারটি মূলত যে নামে বহুল প্রচলিত তিনি হচ্ছেন ব্যক্তি মুফতি মিযানুর সাঈদ। মুফতি মিযান সাবের মাদরাসা নামেই চিনে সারা বাংলাদেশের কওমি শিক্ষার্থীরা। মুফতি মিযান আর ব্যক্তি থাকেননি, তিনি হয়ে উঠলেন একটি প্রতিষ্ঠান। একটি জামিয়া। একটি বিশ্ববিদ্যালয়। একটি উচ্চতর গবেষণামূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কারিগর।
বাংলাদেশের তাখাচ্ছুছ শিক্ষা চর্চা, প্রসারের অন্যতম স্বপ্নপুরুষ মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ বাংলাদেশে হেদায়া পর্যন্ত পড়ে মিশকাত (মারহালাতুল ফযীলত) থেকে উচ্চ শিক্ষার প্রতিটি ধাপ অর্জন পাকিস্তানের বিশ্বখ্যাত জামিয়া করাচীতে। তুখোর মেধা শক্তি মুফতি মিযান দাওরায়ে হাদিসের বার্ষিক পরীক্ষায় পাকিস্তানের বেফাকুল মাদারিসিল বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দারুল উলূম করাচী কেন্দ্রে ১ম এবং সমগ্র পাকিস্তানে ৩য় স্থান অধিকার করেন। তাখাচ্ছুছ অর্জনে বিশ্বনন্দিত ফকীহ, যুগশ্রেষ্ঠ আলেম, জাস্টিস আল্লামা তাকী উসমানির প্রিয় ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে নিজেকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। পাকিস্তানে বিশ্ববিখ্যাত মুফতি তাকী উসমানির স্নেহছায়ায় 'তাখাচ্ছুছ ফিল ফিকহীল ইসলামি'র উচ্চ শিক্ষার পাঠ চুকাতেই ইমাম মুহাম্মদ বিন সউদ আল ইসলামি ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে স্কলারশীপসহ ভর্তির সুযোগ পেয়ে মক্কা-মদিনার ইশারায় সেখানে ছুটে যান তাঁর উস্তাদ আল্লামা তাকী উসমানি সাহেবের বরকতময় নির্দেশ নিয়ে। সেখানে এক বছর আরবী ভাষার উপর ডিপ্লোমা কোর্স সমাপ্ত করে পরবর্তী বছর জামিয়াতুল ইমাম মদিনা শাখায় 'কুল্লিয়াতুদ্দাওয়া ওয়ার ইলম' সাবজেক্টে লিসান্স ডিগ্রি কৃতিত্বের সঙ্গে অর্জন করেন। এ সময় তাকী উসমানি সাহেবের নির্দেশে বিশ্ববিখ্যাত ইসলামিক ব্যক্তিত্ব শাইখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ সাহেবের স্নেহধন্য অনেক ইস্তিফাদা অর্জন করেন। বিশ্ব নন্দিত মুহাক্কিক,গবেষক ইসলামিক স্কলার শাইখ আব্দুল্লাহ বিন
বাযসহ মদিনা বিশ্ব বিদ্যালয়ের বিশ্ববিখ্যাত মহামনীষীদের কাছে পাঠ গ্রহণ করে নিজের ভেতরে ইলমের ব্যাপক ভান্ডার গড়ে তুলেন।
উচ্চ শিক্ষা আর জ্ঞান-ভান্ডারে নিজেকে সমৃদ্ধিরত মদিনায় থাকাবস্থায় ফকিহুল মিল্লাত মুফতি আব্দুর রহমান রহঃ এক সাক্ষাতে তাঁকে দেশে ফিরে এসে একটা উচ্চতর গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার তাকিদ দেন। ফলে কিছুদিন পর দেশে ফিরে এলে মুফতি আব্দুর রহমানের সাথে একতাবদ্ধ হয়ে ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকা বসুন্ধরায় মারকাযুল ফিকরীল ইসলিমী নামে একটি উচ্চতর গবেষণামূলক মারকায প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে তার প্রধান শিক্ষক, শিক্ষা সচিব ও প্রধান মুফতির দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘ ২৩ বছর যাবত। তারপর তিনি তাঁর উস্তাদ আল্লামা তাকী উসমানি সাহেবের পরামর্শক্রমে কুড়িল বিশ্বরোড সংলগ্ন আল-হেরা টাওয়ারে 'শাইখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার' নামে একটি উচ্চতর গবেষণামূলক ইসলামিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন।
উচ্চতর বা তাখাচ্ছুছ শিক্ষা প্রসারের সাথে সাথে তিনি 'আহকামে যাকাত, আহকামে সালাত, আহকামে কুরবানী, আহকামে রমজান,আহকামে লেবাস,আহকামে সুন্নাত ওয়াল জামাত ও ভ্রান্তমতবাদ,ছবি ও ভিডিও এর শরয়ী বিধান, কুরআন ও হাদিসের আলোকে শবেবরাত, কুরআন-সুন্নাহর দৃষ্টিতে নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১,আহলে হাদিসের জন্মকথা ও সীরাতে মুস্তাকীমসহ অনেক মূল্যবান গবেষণামূলক রচনা করেন। বাংলাদেশের তাখাচ্ছুছ শিক্ষার সাথে তিনি কর্ম জীবনের সূচণালগ্ন থেকে লেগে আছেন।
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে এসব বিষয়ে মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ কথা বলেছন দীর্ঘক্ষণ। জানিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ অনেক কথা।
সাক্ষাৎকার পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন
বাংলাদেশের তাখাচ্ছুছের মান দেওবন্দ-করাচীর তুলনায় কোনো অংশে কম নয়