শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


আল-কারউইন: পৃথিবীর প্রাচীনতম মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

শাহনুর শাহীন: জ্ঞান অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। পৃথিবীর জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্রমবিকাশে বিশ্ববিদ্যালয় স্বীকৃতি পেয়েছে জ্ঞান অর্জনের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসেবে। পৃথিবীর প্রচিনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন ঘটেছে মুসলমানদের হাতেই। হাজার বছর ধরে স্বগৌরবে দাড়িয়ে আছে মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন’ আল-কারউইন বিশ্ববিদ্যালয়’।

ইউনেস্কো এবং গ্রিনিজ ওয়ার্ল্ড কর্তৃক বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্ত মরোক্কর  ‘আল-কারউইন বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয় ৮৭৯ সালে।

মোহাম্মেদ বিন আব্দুল্লাহ আল ফিহরি ছিলেন  মরক্কোর ফেস নামক শহরের একজন সফল ব্যবসায়ী। তার ছিল দুই কন্যাসন্তান- মারিয়াম এবং ফাতিমা।

দুই বোনই বাবার বিশাল অর্থের ভাগীদার হয়ে উঠেন। দুই বোনের মধ্যে ফাতিমা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া  বিপুল সম্পত্তি দিয়ে এমন কিছু করে যেতে চাইলেন যার দ্বারা সাধারণ মানুষও উপকৃত হবেন, অন্যদিকে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতিও প্রকৃত আনুগত্য দেখানো হবে। অনেক চিন্তা করে তিনি ঠিক করলেন, তার এই বিপুল ধন-সম্পদ দিয়ে তিনি একটি মসজিদ বানাবেন যেখানে সাধারণ মানুষজন সালাত কায়েমের সুযোগ পাবেন, পাশাপাশি তা জ্ঞানচর্চার আশ্রয়স্থল হিসেবেও গড়ে উঠবে। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ! মনে মনে শপথ নিলেন যতদিন মসজিদের কাজ সমাপ্ত হবে না, ততদিন তিনি রোজা রাখবেন।

আল-কারউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা

ফাতিমা আল ফিহরি মসজিদে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রচলন করেন। মাদ্রাসা শিক্ষার পাশাপাশি ইসলাম চর্চা এবং মসজিদে নিয়মিত কোরআন শরিফ পাঠের ব্যবস্থা করা করেন। বিভিন্ন ধর্মীয় কার্যকলাপের জন্য ধীরে ধীরে এর খ্যাতি চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

ক্রমান্বয়ে জায়গাটিতে ইসলামিক আদর্শ চর্চা, আরবী ব্যাকরণ, গণিত, রসায়ন, চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক এবং আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন হতে থাকল। কিছু সময় পরই মসজিদটি শহরের প্রাণকেন্দ্র হয়ে গড়ে উঠতে লাগল। এর চারপাশ ঘিরে বাজার, স্কুল, থাকার জায়গা, হামাম বিভিন্ন কিছু গড়ে উঠতে লাগল। ধীরে ধীরে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন ধরনের মানুষের সমাগম বাড়তে লাগল।

ফেজ শহর থেকে অনেক জ্ঞানী-গুণী লোক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল যারা আল-কারউইন মসজিদের নাম চারদিকে প্রসারিত করতে লাগলেন। ফলশ্রুতিতে দিনকে দিন মসজিদটিতে দেশ-বিদেশ হতে প্রচুর শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ দেখা গেল। মসজিদটি আফ্রিকার মধ্যে সবচাইতে বড় মসজিদ হিসেবে চিহ্নিত হলো যেখানে ২২,০০০ এর ওপর মানুষ একসাথে সালাত আদায় করতে পারতো। সেই সময়ে ব্যাপারটা ছিল বেশ আলোচিত একটি ঘটনা। এভাবেই যশ-খ্যাতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে আজকের আল-কারউইন বিশ্ববিদ্যালয়।

বর্তমানে মসজিদের যে রূপটি রয়েছে সেটা হলো হাজার বছরের তিল তিল করে গড়ে তোলা একটি সভ্যতার প্রতিমূর্তি। মসজিদটির মূল গঠন ছিল ৩০ মিটার লম্বা। সাথে আছে একটা গোল চত্বর এবং চারটি তির্যক স্তম্ভ পরিবেষ্টিত ঘোরানো গলি। ৯৫৬ সালে মসজিদটির সংস্কার কাজে প্রথম হাত দেন করোডোবার খলিফা তৃতীয় আব্দুর আর রাহমান। নামাজ কক্ষটি আরো বাড়ানো হয় এবং মিনারগুলোকে পুনরায় স্থানান্তরিত করা হয়। এ সময় এটাই নিয়ম হয়ে গিয়েছিল যে, ফেজের অন্যান্য মসজিদগুলো আজানের ডাক দিত শুধুমাত্র আল-কারউইন মসজিদে ডাক শোনার পর। মসজিদে একটি আলাদা ঘর ছিল যার নাম ‘দার-আল-মুয়াকিত’ যেখানে নামাজের সময় ঠিক করা হত।

মসজিদের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সাধিত হয় ১১৩৫ সালে সুলতান আলী ইবনে ইউসুফের সময়। তিনি মসজিদের মধ্যকার বারান্দার সংখ্যা ১৮ থেকে ২১ এ করার আদেশ দেন। মসজিদের কাঠামো ৩,০০০ বর্গমিটারে উন্নীত করেন। এভাবেই পালাক্রমে মসজিদটি অনেক ধরনের সংস্থাপন আর পুনঃসংস্থাপনের মধ্যে দিয়ে যায়।

মুসলিম এবং ইউরোপিয়ানদের মধ্যে এক ধরনের যোগসূত্র স্থাপন করতে এই বিশ্ববিদ্যালয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চতুর্দশ শতকের দিকে মাগরেব এবং মিশর থেকে প্রায় ৮,০০০ ছাত্রকে ফেজে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ১৯৬৩ সালে আল-কারউইন মরক্কোর আধুনিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি মরক্কোর শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠছিল এবং শুধুমাত্র সুলতানই শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারতেন।

উপর থেকে আল-কারউইন বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল মুসলিম বিশ্বে নেতৃত্বদানকারী অন্যতম একটি আধ্যাত্মিক ও শিক্ষাবিষয়ক কেন্দ্র। এটি মূলত ইসলাম শিক্ষাবিষয়ক ধর্মভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়। মধ্যপ্রাচ্যে আল-কারউইন বিশ্ববিদ্যালয়টি ইসলামিক বিশ্ব এবং ইউরোপের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মানচিত্রকার মোহাম্মদ আল ইদ্রিসী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন, যার মানচিত্র রেনেসাঁর সময় ইউরোপীয়দের গবেষণা করতে সাহায্য করেছিল।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুল সংখ্যক পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবী পড়ালেখা করেছিলেন, যারা মুসলিম ও ইহুদি বিশ্বকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম হন। ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা মহাপণ্ডিতের মধ্যে অন্যতম হলেন ইবনে খালদুন, ইবনে রাশেদ আল-সাবতি, মোহাম্মদ ইবনে আলহাজ আল আবদারি আল-ফাসি, আবু ইমরান আল-ফাসি, বিশিষ্ট তাত্ত্বিক মালিকী, বিখ্যাত পর্যটক ও লেখক রাব্বি মুসিবিন মায়মন।

এই বিশ্ববিদ্যালয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল ক্ষমতাধর সুলতানদের কাছ থেকেও। প্রতিষ্ঠানটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে রয়েছে বিশ্বখ্যাত লাইব্রেরি, যেখানে রয়েছে বিপুলসংখ্যক পাণ্ডুলিপি। আজকের দিনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব মূল্যবান পাণ্ডুলিপি রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আছে হরিণের চামড়ার ওপর ইমাম মালেক (রহ.)-এর লেখা মুয়াত্তার পাণ্ডুলিপি, ১৬০২ সালে সুলতান আহমদ আল মনসুরের দেওয়া কোরআনের কপি, সিরাতে ইবনে ইসহাক, ইবনে খালদুনের বই ‘আল-ইবার’-এর মূল কপি।

৮৫৯ সালে নির্মিত আল-কারউইন বিশ্ববিদ্যালয়টি সন্দেহাতীতভাবে পৃথিবীর প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়, কেননা এর খুব কাছের সময়কার মিশরের আজাহার বিশ্ববিদ্যালয় নির্মিত হয় ৯৭০ সালে। ইউরোপীয় সভ্যতার দিকে নজর দিলেও দেখা যায় ইংরেজি ভাষাভাষীদের সবচাইতে প্রাচীন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১০৯৬ সালে।  ইতালির বোলোগ্না বিশ্ববিদ্যালয়, যেটিকে বহু পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ধরা হয়ে থাকে, সেটি  প্রতিষ্ঠিত হয় ১০৮৮ সালে। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড এর মতে ফেজের এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রাচীনতম, কেননা অনেক আগে থেকেই এটি শিক্ষায় ডিগ্রি প্রদান করা শুরু করেছিল।

অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে হাজার বছর ধরে এখনো বীরদর্পে   শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলছে আল-কারউইন বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র: রোয়ারবাংলা, উইকিপিডিয়া


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ