হাসান আল মাহমুদ
প্রতিবেদক, আওয়ার ইসলাম
কওমি মাদরাসার শিক্ষাকার্যক্রম শুরু-শেষ হয় আরবি ভাষাকেন্দ্রিক। শাওয়াল থেকে শুরু করে বছরটির ইতি টানে শাবানে বার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে।
কওমি মাদরাসার তাখাচ্ছুছ (ডক্টরেট ডিগ্রি) ছাড়া ধারাবাহিক ক্লাসের সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিস আর হেফজ সমাপানীকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় বিদায়ি আবহ। সিহাহ সিত্তাহ (প্রসিদ্ধ ৬ কিতাব) এর মধ্য থেকে বুখারি কিতাবের খতম কেন্দ্র করে আয়োজিত 'খতমে কুরআন ও খতমে বুখারি অনুষ্ঠান'। হেফজ সমাপনকারী আর দাওরায়ে হাদিস সমাপনকারীদের শেষ সবকের অনুষ্ঠানটি কওমির একটি ঐতিহ্যবাহী আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান। এ দিনটির স্বপ্নে বিভোর হয় সব শিক্ষার্থীই। অনুষ্ঠানটি হয়ে থাকে তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য স্মৃতি।
অনুষ্ঠানে শিক্ষা সমাপনকারীদের সম্মানজনক পাগড়ি প্রদান করা হয়। মাথায় পেঁচিয়ে দেন আমন্ত্রিত অতিথিগণ। মাথায় পেঁচানো এ পাগড়ি যেন দেশ-জাতির দায়িত্ব পেঁচিয়ে দেয়া। এ এক অন্যরকম, ভিন্ন আমেজের পবিত্র আয়োজন হয়ে উঠে প্রতিটি কওমি মাদরাসায়।
সমাপনী এ আয়োজনের নানা দিকের একটি হল ছাত্রদের উদ্যোগে ডায়েরি প্রকাশ। প্রায় সব কওমি মাদরাসাই বিদায়ি স্মৃতি হিসেবে ডায়েরি প্রকাশ করে। যেখানে সমাপনী ছাত্রদের নাম-ঠিকানা, ফোন, মেইল, রক্তের গ্রুপ ছাড়া বিদায়ি সম্ভাষণ, প্রয়োজনীয় ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ থাকে। এছাড়াও কোনো কোনো মাদরাসায় ক্যালেন্ডার, চাবির রিং, মগও বানানো হয়। এ বাবদ খরচ হয় আনুপাতিক হারে লক্ষাধিক টাকা। এ টাকার যোগান পুরোটাই আসে ছাত্রদের থেকে। একেকজন সমাপনী ছাত্র নির্দিষ্ট সংখ্যক ডায়েরি পেয়ে তা বিদায়ি স্মৃতি হিসেবে উপহার প্রদান করে নিজের পছন্দের মানুষকে।
সম্প্রতি দাওরায়ে হাদিসের বিদায়ি উপলক্ষে ডায়েরি বের করার সনাতনী ধারা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে কওমি শিক্ষার্থীদের মনে। কালের এই সন্ধিক্ষণে ডায়েরি প্রকাশ কাম্য নাকি যুগ চাহিদার অনুপাতে গবেষণাধর্মী বই বা যুগপযোগী স্মারক! অনেকের অভিমত ডায়েরি এখন কেউ আর ব্যবহার করেন না। তাই এ খাতে ব্যবহৃত পুরো অর্থই বলা চলে অপচয়। অথচ এটি না করে একটি শিক্ষণীয় স্মরণিকা বা বই করা হলে উপকৃত হতো হাজারও মানুষ।
এসব বিষয়ে কথা হয় সারাদেশের কওমি মাদরাসার প্রাক্তন ও বর্তমান কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে।
জামিয়া দারুল মা'আরিফ আলইসলামিয়া (চট্রগ্রাম) এর দাওরায়ে হাদিসের ছাত্র আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, 'আমি মনে করি ডায়েরি করাটা এক প্রকার অর্থহীন। যা না করলেও চলে। তবে তা স্মৃতিময় এবং তাতে স্মৃতিটুকু ধরে রাখা হয়। তারচে যা ভালো হয়, গবেষণাধর্মী কিছু বের করলে। এতে দু'টি উপকারিতা। একটি হলো নিজেদের পুরনো রীতি ধরে রাখা; এক প্রকার স্মৃতির বিষয়টি এখানে চলে আসে। দ্বিতীয়ত, জাতির সামনে ভালো কিছু উপহার দেয়া যায়। যার দ্বারা তাদের অনেক অনেক উপকার হবে এবং ভালো কিছু শিখতে পারবে। সব মিলিয়ে বলা যায় গবেষণাময় কিছু একটা করা উচিত সমাপনী শিক্ষার্থীদের।
চট্রগ্রামের জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার দাওরায়ে হাদিসের প্রাক্তন ছাত্র মুহাম্মাদ মিসবাহ উদ্দিন জানান, 'আমরা তো ডায়েরি বের করেছি। তবে গবেষণাধর্মী বই বের করলে আরো ফলপ্রসু হতো মনে হয়'।
ঢাকার যাত্রাবাড়ী দারুল উলুম মাদানিয়ার ২০১৩ সালের ফারেগ মুহাম্মাদ সারোয়ার হোসাইন জানান, 'গবেষণাধর্মী কিছু কাজ হতে পারে এ উপলক্ষ্যে, তবে সাথে ডায়েরি স্মৃতি হিসাবে থাকতে পারে'।
ঢাকার তেজগাঁও মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের ছাত্র আমিন মুনশি জানান, 'সমাপনী উপলক্ষ্যে বইই বরং ভালো এবং অর্থপূর্ণ কাজ হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। ইতিমধ্যে যে চেষ্টাটি করে আমি ব্যর্থও হয়েছি। জাতির হেদায়াত হোক!'
সিলেটের জামেয়া নয়াসড়ক মাদরাসার ছাত্র জাহেদ আহমদ জানান, ' আমি মনে করি ডায়েরি বা ক্যালেন্ডার বের করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আমি কোন সময়ই এর পক্ষে নই। ক্লাসের সবাই যেহেতু একমত হয়ে উদ্যেগ নিয়েছেন ক্যালেন্ডারের জন্য, ঐক্য ঠিক রাখার জন্য জাস্ট টাকা দিয়ে শরিক থেকেছি'।
মুহাম্মাদ সানোয়ার জানান, 'সখের বসে ডায়েরি, ক্যালেন্ডার করা নিতান্ত বোকামি। এ ক্ষেত্রে সাহিত্য সাময়িকী নিশ্চয় প্রশংসার যোগ্য বলে আমি মনে করি'।
হাটহাজারী মাদরাসার সাবেক ছাত্র প্রবাসী জুলফিকার ফুয়াদ মনে করেন, 'ডায়েরি বের করাকে আমি অর্থহীন মনে করি না। যদি তত্ত্ব-উপাত্ত্বসহ বিশেষ আঙ্গিকে প্রয়োজনীয় বিষয়াদী সম্বলিত হয়ে থাকে। যেমন ইসলাম, মুসলিম , বিশেষ ব্যাক্তিবর্গ এবং আলেম উলামার ইতিহাস ঐতিহ্যের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ইত্যাদি ।
তবে সময় উপযোগী গবেষণাধর্মী যা সর্বসাধারণ এবং বিশেষ করে জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিতদের দ্বীনি ইসলামের সঠিক পথে রাখতে কার্যকার ভূমিকা রাখতে পারে এমন বই বের করাই বেশি ফায়দা বা ফলপ্রসু হবে বলে আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি'। জানালেন ফুয়াদ।
দারুল উলুম দেওবন্দ (ভারত) এর দাওরায়ে হাদিসের শিক্ষার্থী নেছারুদ্দীন বিন মিজান বলেন, 'তাকমীল জামাতের বিদায়ী শিক্ষার্থীরা তাদের বর্ষসমাপনী অনুভুতিটা প্রকাশের জন্য যে ডায়েরি, ক্যালেন্ডার, চাবির রিং ইত্যাদি বানায় সেটা মূলত তাদের দীর্ঘদিন একসঙ্গে পথচলার স্মৃতিগুলোকে এক ফ্রেমে বেঁধে রাখারই একটা ক্ষুদ্র প্রয়াস৷ তাই এ ব্যাপারে কোন আপত্তি না করা উচিৎ। তবে আমি মনে করি ডায়েরি না হয়ে যদি তার স্থানে কোন গবেষণাধর্মী গ্রন্থ (হোক কোন অনুবাদগ্রন্থ) প্রকাশ করা হয় তবে সেটা যেমন জাতির জন্য ফলপ্রসু হবে তেমনি বিদায়ীদের স্মতিচারণের উদ্দেশ্যটাও পুর্ণমাত্রায় আদায় হবে৷
ডায়েরি কিংবা নোটবুকের একটা সীমাবদ্ধতা থাকে, পৃষ্ঠাগুলো শেষ হলে একসময় তার স্থান হয় কাগজের ঝুড়িতে৷ পরবর্তীদের জন্য সেখান থেকে নেয়ার কিছুই থাকে না৷ কিন্তু একটি কিতাব যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকে পাঠকের পাঠ্যতালিকায়, সাথে সাথে লেখক প্রকাশকরাও অমর হয়ে থাকেন তার পাতায় পাতায়৷
তাই দাওরায়ে হাদিসের বিদায়ী বন্ধুদের প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে আপনারা জাতির সামনে রেখে যান আপনাদের যোগ্যতার স্বাক্ষর, আপনাদের সারা বছরের একটি গবেষণা। ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রতিটি হৃদয়ের মনিকোঠায় অমর হয়ে থাকুক আপনাদের স্মৃতি।
আরআর