আনিস আলমগীর বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট; নিয়মিত লিখেন বাংলা ট্রিবিউনে! সম্প্রতি তিনি কওমি স্বীকৃতি ও গ্রিক মূর্তি নিয়ে লিখেছেন; ইষৎ সংক্ষেপে আওয়ার ইসলামের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো
কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি, হাইকোর্ট প্রাঙ্গনে গ্রিক দেবি থেমিসের মূর্তি স্থাপন আর পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা ইত্যাদি নিয়ে গত এক সপ্তাহব্যাপী রাজনীতির ময়দান, সোশ্যাল মিডিয়া কিছুটা উত্তপ্ত ছিল। ভারত থেকে আসার পরের দিনেই গণভবনে গিয়ে হেফাজত প্রধান আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে একদল কওমি আলেম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের দাবির সঙ্গে ঐক্যমত পোষণ করে কওমি মাদ্রাসার দাওয়ারে-ই-হাদিসকে এমএ সনদের সমমূল্যের নির্ধারণ করতে সম্মত হয়েছেন। কওমি মাদ্রাসার বোধ উদয় হওয়ার জন্য তাদেরকে মোবারকবাদ জানাতে হয়।
গত শতাব্দীর ষাটদশকেও সরকার কওমি শিক্ষাকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিলেন এবং ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহকে হাটহাজারী মাদ্রাসায় পাঠিয়ে ছিলেন এ বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। তিনি তখন হাটহাজারী মাদ্রাসার মোহতামীম হযরত মওলানা আব্দুল ওহাব ও পটিয়া মাদ্রাসার মোহতামীম হযরত মওলানা হাজী ইউনুস-এর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু তারা উভয়ে সরকারের প্রস্তাব মানেননি। হাটহাজারী মাদ্রাসাকে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি করারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন ড. শহিদুল্লাহ্। তাও তারা মানেননি। তারা কখনও সরকারি সনদেরও পরোয়া করেননি আর সরকারি সাহায্যেরও মুখাপেক্ষী ছিলেন না। শিক্ষার্থীদেরকে দিয়ে মুষ্টি ভিক্ষাকে সম্বল করেই দেওবন্দী ওলামারা এ উপ-মহাদেশে কওমি ক্যারিকুলামের বিরাট এক ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থার পত্তন করেছিলেন।
কওমি ওলামারা ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তি। বালাকোর্টে, থানাবনে তারা ব্রিটিশের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। ব্রিটিশকে তারা কখনও ভারতের বৈধ শাসক বলে স্বীকার করেননি। সর্বাবস্থায় তারা ব্রিটিশের সঙ্গে অসহযোগের নীতি অবলম্বন করে চলেছিলেন। ব্রিটিশেরা ৫০ হাজারেরও বেশি কওমি আলেমকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন। হযরত মওলানা এমদাদুল্লাহ্, মওলানা কাসেম নানুতুবী, মওলানা রসিদ আহাম্মদ গাঙ্গাগোহা, শহীদ হাফেজ জামাল, মওলানা ফিরিঙ্গী মহল্লী, মওলানা জাফর আহাম্মদ থানেশ্বরী, মওলানা ফজলে হক করবাদী, মওলানা আব্দুল মজিদ সিন্দী প্রমুখরা ছিলেন কওমিদের নেতা। এ উপ-মহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কওমি ওলামাদেরও বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ছিল।
আমি ব্রিটিশ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে মওলানাদের অবদানের কথা লিখলাম এজন্য যে, তারা অপদার্থ ছিল না তা বুঝাবার জন্য। কারণ কিছু তথাকথিত প্রগতিশীল আছেন তারা মনে করেন মওলানারা শুধু অপদার্থ।
প্রধানমন্ত্রী যে তাদেরকে স্বীকৃতি দিয়ে ধীরে ধীরে কাছে টানার চেষ্টা করছেন, তাদেরকে রাষ্ট্রের মূল স্রোতে আনার চেষ্টা করছেন তা হচ্ছে উত্তম সিদ্ধান্ত। প্রধানমন্ত্রী কওমি ক্যারিকুলামে হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সনদের স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু কওমি মাদ্রাসাগুলোতে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটানো যে দরকার যে বিষয়ে তাদেরকে বুঝানো উচিৎ। মওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী তার শেষ জীবনে এসে কওমি ক্যারিকুলাম বদলানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। নিশ্চয়ই এ বিষয়টি আহমদ শফী সাহেব জানেন। কারণ তিনি হোসাইন আহমদ মাদানীর শিষ্য।
বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসাগুলোর কোনও এক কেন্দ্রীক শিক্ষা বোর্ড নেই। দুই চারটা মাদ্রাসা মিলে এক একটা বোর্ড করার প্রবণতা আছে। এটার কারণ হলো তাদের মাঝে অনৈক্য বেশি। সুতরাং আমরা আহমদ শফী সাহেবকে অনুরোধ করবো বাংলাদেশের সব কওমি মাদ্রাসাগুলোকে নিয়ে যেন একটা গ্রহণযোগ্য শিক্ষা বোর্ড গঠন করা হয়। বর্তমানে তাদের যে শিক্ষা বোর্ড আছে সেটি পূর্ণাঙ্গ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। ধীরে ধীরে সব মাদ্রাসাগুলোকে একটা কেন্দ্রীয় কাঠামোর মাঝে নিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজনে এ বিষয়ে আইনের সহায়তা দরকার হলে সরকারের সঙ্গে আলোচনাও করা যেতে পারে। সারা দেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। এতো বড় সংখ্যক শিক্ষার্থীদের মূল স্রোতের বাইরে রেখে একটি সুস্থ সমাজ এগুতে পারে না।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কওমিদের শীর্ষ ব্যক্তি ছিলেন হযরত হাফেজজী হুজুুর। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে বলেছিলেন জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই। কওমিরা ঈমান আকিদার কথা বলে, রাজনীতি আসলে তাদের কাছে মূখ্য নয়। হেফজাতও কোনও রাজনৈতিক দল নয়। এ কথাটা তারা নিজেরাই বলে।
হেফাজতের দাবির স্বীকৃতিতে আমাদের সব বামপন্থীরা সমস্বরে রেগে গেলেন কেন বুঝা মুশকিল। একসময়ে এ উপ-মহাদেশে বামপন্থীদের বেশ বড় সড় উপস্থিতি ছিল। এখন ক্ষীণকায় স্রোতধারার মতো হয়ে বিলুপ্তির পথে। এর জন্য আন্তর্জাতিক পরিসরে তাদের পতন মূখ্য কারণ হলেও আরও কিছু কারণ স্থানীয়ভাবেও রয়েছে। আর তা হচ্ছে এ উপমহাদেশে বামপন্থীরা ধর্মওয়ালাদের সঙ্গে বৈরি আরচণ করে।
তবলীগও কওমিদের একটা শাখা। তবলীগের টঙ্গী সমাবেশ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের লোক এসে যোগদান করে। অনেকটা বিশ্বায়িত ব্যবস্থা। এরা ঈমান-আকিদার কথা বলে বেড়ায়। এত বড় একটা শক্তিকে বৈরি করে তোলা তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ধর্মচর্চা এখানে বলতে গেলেতো মায়ের গর্ভ থেকেইতো শুরু হয়। মায়ের গর্ভে থাকতে মুসলমানের সন্তানেরা মায়ের কোরাআন পড়ার আওয়াজ শুনে ভূমিষ্ঠ হয়। সহজে তো মুসলমান মায়ের সন্তানকে ধর্মবিমুখ করা যাবে না। এ বাস্তবতাকে ভুলে যাওয়া বাস্তবতাকে অস্বীকারের সামিল। এতে কারও কোনও লাভ হবে না।
২.
হেফাজতে ইসলাম সুপ্রিম কোর্টের সামনে গ্রিক দেবীর মূর্তি স্থাপনের বিষয়টি উত্থাপন করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তা অপসারণের দাবি তুলেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তিনি নিজেও এ মূর্তি স্থাপনের পক্ষে নন। তিনি সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে বিষয়টি উপস্থাপন করে শেষ করার আশ্বাস দিয়েছেন। সর্বশেষ খবরে দেখলাম প্রধান বিচারপতির সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে দেখা হলে তিনি মূর্তি সরাতে বলেছেন বা এমনভাবে রাখতে বলেছেন যাতে ঈদগাহের মুসল্লিদের চোখে না পড়ে।
সুপ্রিম কোর্টের এ ভবন তৈরি হয়েছে ৫০/৬০ বছর হতে চলেছে। তার মূল গম্বুজের নিচে ন্যায়ের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা ছিল। ভারতের বিভিন্ন হাইকোর্টেও দাঁড়িপাল্লা আছে কোনখানে গ্রিক দেবীর মূর্তি দেখিনি। তবে পৃথিবীর নানা দেশেই এই মূর্তি আছে। এখানে এ মূর্তিটি স্থাপন করে এ বির্তকের সূত্রপাত করলেন কে? যারা এ মুর্তিটি স্থাপনের হুকুম দিয়েছেন তারা কি ভুলে গিয়েছিলেন যে এদেশের সাধারণ মানুষ ভাস্কর্য আর মূর্তির তফাত বুঝে না। যা ভাস্কর্য তাই তাদের কাছে মূর্তি। তবে এটাও ঠিক বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত ভাস্কর্যগুলো রক্ষার জন্য আবার তাদের মধ্যেই লোক আছে জীবন দিতে পারে।
দেখা যাচ্ছে ভাস্কর্য নিয়ে প্রগতিশীলদের মধ্যেও বিরোধ। বিষয়টিকে অনেকে হেফাজত বনাম গ্রিক ভাস্কর্য-এর পর্যায়ে নিতে গেছেন। ভাস্কর্যটির প্রযোজনীয়তা, নান্দনিকতার চেয়ে তাদের কাছে হেফাজতকে ঠেকাও মূখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। সুপ্রিমকোর্টের ভাস্কর্য-এর নামে আবর্জনাটি প্রগতির ঝাণ্ডা হয়ে দেখা দিয়েছে। কৌশলে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে এখানে ট্যাগ করে দিচ্ছেন অনেকে। শুরু করেছেন মোল্লাদের জুজুর ভয়। এটা কেউ বিবেচনা করছি না যে, যেখানে যা এতো বছর ছিল না সেখানে রাতারাতি তা স্থাপনের মতো আনপ্রোডাক্টটিভ বিষয় নিয়ে জাতিকে বিভক্ত করছি আমরা। হানাহানিও উসকিয়ে দিতে চাচ্ছি।
চরমোনাইর পীর বলেছেন ২০ তারিখের মাঝে মূর্তি না সরালে তিনি ২১ তারিখ মহাসমাবেশ করবেন সোহরাওয়ার্দীতে। যারা মূর্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তারা কোনও মিটিং মিছিল সমাবেশ করবেন না। তাদের দাবি তাদের হয়ে সব কাজ করতে হবে সরকারকে। আমি জানি না সরকারের কোন ঠ্যাকা পড়েছে তা করার। এটাতো কালী মন্দির নয় যে সরকার এটাকে রক্ষা করার জন্য পুলিশ পাহারা মোতায়েম করবে। যারা এ মূর্তি বসিয়েছেন আর যারা এ মূর্তি রাখার পক্ষে তাদের উচিৎ হানাহানি সৃষ্টির আগেই মূর্তিটা সরিয়ে ফেলা।
আমার মনে হয় সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে পারে। এ বার যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা তো সবাই বিএনপির লোক। আমরা শুনেছি যখন এ মূর্তিটি বসানো হয় তখন বারের সেক্রেটারি ও বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মাহাবুব উদ্দীন খোকনের নাকি সমর্থন ছিল। কথাটা সত্যি কিনা জানি না তবে এখন বার এসোসিয়েশনের উচিৎ বিষয়টা নিষ্পত্তি করার উদ্যোগী হওয়া এবং মূর্তিটা সরানোর বিষয় নিয়ে কোনও রাজনীতি না করা। মানুষের প্রগতিশীলতার নিদর্শন দেখানোর বহু ক্ষেত্র আছে। যেহেতু মূর্তি সাধারণ মানুষের মন মেজাজের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তা পরিহার করে চলাই তো উত্তম। এই মানুষদের কেউ কেউ হয়তো হৃদয়ের অন্ধত্ব নিয়ে রাতের অন্ধকারে হিন্দুদের প্রতিমা ভাঙে কিন্তু তারা কেউ ঢাকেশ্বরী মন্দিরের মূর্তি সরাতে বলতে শুনিনি। সে ধরনের কারও খায়েস, ধৃষ্টতা অন্য মানুষ, রাষ্ট্রও সহ্য করবে না