বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১১ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫


অন্তরালে...

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুস্তকীম বিল্লাহ মাসুম

কাঁদিস না সাদিকা৷আমি আছি তো! কিচ্ছু হবে না মায়ের৷

কথাগুলো যেন রাতের বুক চিরে বেরিয়ে এলো সাদিকের কণ্ঠ থেকে৷ সাদিকের বাড়ি বাঁশখালি গ্রামের উত্তর দিকে৷ ওদের গ্রামের নাম বাঁশখালি হলেও সেখানে বাঁশের কোন অভাব নেই৷ওদের নিজেদেরও একটা বাঁশঝাড আছে়৷ তবুও গ্রামের নাম বাঁশখালি হওয়ার কারণটা অন্য দশজনের মত সাদেকেরও অজানা৷

মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ও৷ মা খাদিজা বেগম আর ছোট বোন সাদিকাকে নিয়েই ওর পুরো পৃথিবী৷
বাবা মারা গেছেন গত বছর আশ্বিনের শেষ দিকে৷বাবা থাকতে সাদিকরা জোসনার রাতগুলোতে উঠোনে মাদুর পেতে বসত এবং গল্প করত বাবার সাথে৷মাঝে মাঝে বাবা এমন সব মজার মজার গল্প বলতেন যে, ওরা ভাইবোন হাসতে হাসতে কুটিকুটি হত৷গভীর রাত পর্যন্ত চলত তাদের এই আড্ডা৷

সেদিনও ছিল জোসনা রাত৷উঠোন ছিল চাঁদের আলোয় ভেজা৷ বাবার গল্পটাও জমে উঠেছিল বেশ৷আড্ডাটা আরো কতক্ষণ চলত কে জানে! অবশেষে মায়ের মিষ্টি বকুনিতে বাধ্য হয়েই সেদিনের মত শেষ করতে হয়েছিল৷
কিন্তু কে জানত, শেষ হওয়া এই গল্পের আড্ডাটা আর কখনই শুরু হবে না!

রাতে কী ঘটেছিল কেউ জানে না৷কিন্তু প্রতিদিনের মত সেদিন ভোরে বাবা আর ফযরের নামায পড়তে ওঠেননি৷ঘুমের মাঝেই হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি৷

আগের মত জোসনা রাতগুলো এখনো ফিরে ফিরে আসে৷দূর আকাশের চাঁদটা এখনো ক্ষণেক্ষণে হাসে৷খেজুর পাতার সেই মাদুরটা ঘরের কোণে পড়ে আছে এখনো৷শুধু বাবা নেই৷ নেই সেই গল্পের আড্ডাটাও৷
বাবার শোকে শয্যাশায়ী হলেন মা৷এই শোক কাটিয়ে উঠতে প্রায় তিনমাস লেগে গেল৷

ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন৷ নতুন উদ্যমে ফের শুরু হল জীবনের পথচলা৷
এটাই প্রকৃতির নিয়ম৷জগত সংসার কখন কারো অপেক্ষায় থেমে থেকেছে, এমন কথা আজো শোনা যায়নি৷সম্ভবত শোনা যাবেও না কোনদিন৷ এভাবেই হয়,হয়ে আসছে৷

তবে এখনো বাবার বিরহে মায়ের চোখ মাঝে মাঝেই ভিজে ওঠে৷ নারী অস্তিত্বের কতটা জায়গা জুড়ে স্বামীর অবস্থান, সেটা শুধু একজন বিধবায় উপলব্ধি করতে পারে৷ সাদা শাড়ীর আঁচলে লুকিয়ে রাখা কষ্টগুলো কজনই বা বোঝে৷ এটাকেই বোধহয় বলে বোবা কান্না৷বোবাকান্না বোঝার মত ক্ষমতা সব মানুষের থাকে না৷যাদের আছে, তারা বহু কষ্টের ঐশ্বর্য্যের মালিক! তারা কষ্টকে ঐশ্বর্য্যের মত ভোগ করতে পারে৷

আজকাল কেন জানি খুব অল্পতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন মা৷সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকেন তিনি৷ তবুও আরগ্যের দেখা মেলে না৷ সম্ভবত রোগের আলাদা কোন ধর্ম নেই৷ কর্মরত বা কর্মহীন, যে কাউকেই স্পর্শ করতে পারে৷
আজ বিকেলে হঠাৎ করে মায়ের বুকের ব্যথাটা বেড়ে গেছে৷সন্ধ্যার পর থেকে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে৷তাই মাকে হাসপালে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল সাদিক৷

বাঁশখালি থেকে সদর হাসপালের দুরত্ব প্রায় দশ কি: মি:৷ গাড়ি ভাড়া করতে বের হল সাদিক৷বাঁশখালিতে অনেকেই সিএনজি চালায়৷ কিন্তু আজ কেউ যেতে রাজি হল না৷ কয়েকদিন ধরে বাঁশখালির বর্তমান চেয়ারম্যানের সাথে সাবেক চেয়ারম্যানের গোণ্ডগোল চলছে৷গতকাল রামদার কোপে খুন হয়েছে দুজন৷তাই গ্রামে পাহারা বসিয়েছে পুলিশ৷সন্ধ্যার পর রাস্তায় বের হওয়া নিষেধ৷কখন কী হয় এই ভয়ে কেউ বের হতে সাহস করল না৷

অগত্যা পাশের গ্রাম থেকে কবির মামাকে ডেকে আনল সাদিক৷কবিরের প্রাইভেট সিএনজি আছে৷ ওরা যখন মাকে নিয়ে সিএনজিতে উঠল, রাত তখন আঁধারকে নিয়ে নেমে এসেছে পৃথিবীতে৷

হেডলাইটের আলোয় পথ চলছে সিএনজি৷ মায়ের বুকের ব্যথা আরো বেড়েছে৷এখন শ্বাস নিতেও বড্ড কষ্ট হচ্ছে তাঁর৷হার্টবিড বেড়ে চলেছে দ্রুত৷ মায়ের করুণ অবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে উঠল সাদিকা৷ওকে সান্তনা দিতে গিয়ে সাদিক বলল,কাদিস না,আমি আছি তো! কিচ্ছু হবে না মায়ের৷কিন্তু কথাটা বলে সাদিক বোনকে সান্তনা দিল,না নিজেকে প্রমোধ দিল বোঝা গেল না৷

সিএনজির স্পিড আরেকটু বাড়িয়ে দিল কবির৷গ্রামের আঁকাবাঁকা পথে এর চে' বেশি স্পিড বাড়ান সম্ভব না৷ছুটে চলল সিএনজি৷মায়ের শিয়রে বসে তখনো কেঁদে চলেছে সাদিকা৷বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না থামাবার চেষ্টা করল সাদিক৷কিন্তু অন্ধকারে সাদিকের ভেজা চোখ দেখতে পেলনা কেউ৷

প্রায় শহরের রাস্তার মুখে এসে পড়েছে সাদিকরা৷হঠাৎ রাস্তার পাশের একটা ঝোপ থেকে যমদূতের মত উদয় হল একদল পুলিশ৷হাত উঁচিয়ে ওদেরকে থামার নির্দেশ দিল৷ধক করে উঠল কবিরের মন৷ হার্ডব্রেক কষে থামিয়ে দিল সিএনজি৷পুলিশের দলটা সিএনজিকে ঘিরে দাঁড়়াল৷ পুলিশ অফিসার একটু এগিয়ে এসে বলল,এত রাতে কৈ যাও? জানো না,সন্ধ্যার পর বের হওয়া নিষেধ’৷

কবির বলল, হাসপাতালে যাচ্ছি স্যার৷আমার বোন খুব অসুস্থ৷
না, যাওয়া যাবে না৷উপর থেকে নিষেধ আছে৷

ওদিকে যন্ত্রণায় কাঁতরাতে শুরু করেছেন খাদিজা বেগম৷ সাদিক অস্থির হয়ে বেরিয়ে এল সিএনজি থেকে৷অফিসারের হাত দুটো চেঁপে ধরে বলল, আমার মা খুব কষ্ট পাচ্ছে স্যার! দয়া করে আমাদের হাসপালে যেতে দেন৷

অফিসার সাদিকের পকেটের দিকে ইশারা করে বলল,ওকে,আমাদের জন্য হালকা চা নাস্তার ব্যবস্থা কর৷ আমি দেখি কী করা যায়৷

অফিসারের মুখে চতুর হাসি৷

এতক্ষণে থলের বিড়ালটা যেন বেরিয়ে এল৷পুরো ব্যাপারটা বুঝতে আর কষ্ট হল না সাদিকের৷ পকেট থেকে পাঁচশো টাকার একটা নোট বের করে অফিসারের হাতে গুঁজে দিল ৷ একটা ক্রড় হাসি ফুটে উঠল অফিসারের মুখে৷ অবজ্ঞা ভরে বলল,ব্যাটা ফকির না কি আমরা!দশ হাজার টাকা লাগবে৷

চমকে উঠল সাদিক৷চা নাস্তা খেতে এত টাকা লাগে! সাদিক পকেট থেকে দুৃহাজার টাকা বের করে বলল,স্যার,এটাই রাখেন,এর চে’বেশি দিলে মাকে হাসপাতালে ভর্তি করা যাবে না৷
‘প্যাচাল পাইরো না৷পুরাটা দিয়ে দাও, ল্যাঠা চুকে যাক!

কবির একটু এগিয়ে এসে বলল,সার,এখন এটাই রাখেন৷বাকিটা না হয় কালকে দেব৷
‘শালা মজা নাও!তুমি যে কাল আসবা তার গেরান্টি কি? সি এনজি রাইখা হাইটা যাও৷

এ সময় সিএনজি থেকে সাদিকা চিৎকার করে উঠল,ভাইয়া! আম্মু কেমন যেন করছে৷তুমি তাড়তাড়ি আস৷
সাদিক যেন পাগল হয়ে গেল৷উন্মাদের মত চিৎকার করে বলল,রেখে দে সিএনজি!আমার মাকে আমি কাঁধে করে নিয়ে যাবো!

তোরা তো শালা জারজ সন্তান৷ মায়ের কষ্টের কী বুঝবি!

সাদিকের আর্তচিৎকারে পুলিশদের মাঝে কোন পরিবর্তন দেখা গেল না৷যারা একজন অসুস্থ মায়ের আর্তচিৎকারকে উপভোগ করতে পারে, সামান্য কটা টাকার জন্য জারজ উপাধি নেয়াটা তাদের কাছে নস্যি!
অসুস্থ মাকে কাঁধে তুলে নিয়ে এগিয়ে চলল উন্মাদ ছেলে সাদিক৷ অব্যক্ত যন্ত্রণায় মুহ্যমান সাদিকা পাগলিনীর মত ছুটে চলল ভাইয়ের পিছু পিছু৷নির্বাক কবির ভাবতে থাকে,সত্যি কি এরা মানুষ!!?

দূর আকাশের চাঁদটা তখন মুখ লুকোলো মেঘের আড়ালে৷আজ পৃথিবীর জোসনার কোন প্রয়োজন নেই৷ আমাবস্যার আঁধারে যেন ঢেকে ফেলতে চায় নিজেকে৷ হয়ত এমন করুন দৃশ্য দেখতে প্রস্তুত নয় প্রকৃতি৷

তখন রাতের শেষ প্রহর৷নিঝুম প্রকৃতি৷ বাঁশখালির পথ ধরে একটা এ্যাম্বুলেন্স আসতে দেখা গেল৷অর্ধঘুমন্ত পুলিশের দলটা সতর্ক হয়ে উঠল৷এ্যাম্বুলেন্সটা তাদের বরাবর হলে হাত উঁচিয়ে থামার নির্দেশ দিল অফিসার৷
থেমে গেল এ্যাম্বুলেন্স৷অফিসারটি ভারি টর্চের আলো ফেলল এ্যাম্বুলেন্সের খোলা জানালায়৷টর্চের আলোয় জানালার পাশে বসে থাকা সাদিককে চিনতে কষ্ট হল না অফিসারের৷

মাকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে পৌঁছতে পেরেছিল সাদিকরা৷ কিন্তু কর্তব্যরত ডাক্তার নার্ভ পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেছে৷

মাকে হাসপালে ভর্তি করানোর সেই টাকাগুলো দিয়েই এ্যাম্বুলেন্স নিয়েছে সাদিক৷

হাসপাতালে যেতে মায়ের অনেক কষ্ট হয়েছে,অন্তত কবরে যেতে যেন তাঁর কোন কষ্ট না হয়!

মায়ের লাশের পাশে নিথর হয়ে পড়েছিল সাদিকা৷চোখ দুটি ভেজা৷এলোমেলো চুল৷বিদ্ধস্ত চেহারা৷এ্যাম্বুলেন্স থামার শব্দে চকিতে মুখ তুলে চায়লো সে৷জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অফিসারকে দেখে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না৷অদ্ভুত এক কণ্ঠে বলে উঠল,টাকা লাগবে সার, টাকা! কিন্তু টাকা তো নেই! আমার আম্মুর লাশ আছে সার,লাশটা দিলে কি আমাদের ছেড়ে দেবেন?

এতক্ষণে অফিসারের চোখ দুটিও যেন ভিজে উঠলো৷প্রতিটা মানুষের ভেতরে আরেকটা মানুষ বাস করে৷ উপরের মানুষটা খারাপ কিছু করলে ভেতরের মানুষটা তার সাক্ষী দেয়৷ তাই মাঝে মাঝে উপরের মানুষটা ভাল হয়ে যায়৷অথবা ভাল হয়ে যাওয়ার ভান করে৷ অফিসারের ক্ষেত্রেও সম্ভবত সেটাই ঘটেছে৷

পুনশ্চ: তুমি আমাদের গ্রামের সন্তান৷পুলিশ হইছো জেনে ভাল লাগতিছে৷ কিন্তু এক বছরের মধ্যে আমার ছয় লাখ টাকা দিতি না পারলি নিয়ম অনুযায়ী তোমাদের বাড়িটা আমার নামে হিয়া যাবি৷এই চিন্তাটাও মাথায় রাইখো’৷ চেয়ারম্যানের কথাই চিন্তার বলিরেখা গাঢ় হলো সেলিমের কপালে৷ চাকরিটা পেতে ছয় লক্ষ টাকা দিতে হয়েছে৷ অসুস্থ বাবার চিকিৎসা আর সংসারের খরচ যোগাতে চাকরিটা তার খুবই প্রয়োজন ছিল৷ তাই বাধ্য হয়েই বাড়িটা বন্ধক রেখে ছয় লক্ষ টাকা নিয়েছে সে৷ কিন্তু এক বছরের মধ্যে কীভাবে শোধ করবে এতগুলো টাকা! চিন্তার অথৈ সাগরে ডুবে যায় সেলিম৷ সারাটা জীবন সৎ পথে চলেছে সেলিমের বাবা৷ হয়ত সেই বাবাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাকে আজ অসৎ পথ অবলম্বন করতে হবে৷এ ছাড়া আর উপায়ই বা কি!
টাকার কাছে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হল সেলিমের৷

ছোটগল্প: জীবনকাহন

 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ