শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


কাজী নজরুলের কবিতা যেভাবে এসেছে বৈশাখ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

রোকন রাইয়ান

বাংলাদেশ এক রূপময় দেশ। ফুল-ফলে শোভিত দৃষ্টিনন্দন এর প্রকৃতি। এখানে দোয়েল কোয়েল মুখরিত করে রাখে সারাবেলা। আছে টলটলে জলের পদ্মপুকুর আর অবিরাম ঝর্ণাধারা। সবমিলিয়ে বাংলাদেশ হলো রূপের রাণী। এই রূপের রাণী ছয়বার পরিবর্তন হয় বিভিন্ন রূপে। আমরা বলি ঋতু বৈচিত্র্য। শীত শেষে এমনই গ্রীষ্ম এসেছে আমাদের কাছে। সামনেই বৈশাখ। বৈশাখ পুরাতনের বিদায় দেয়। আনে নতুন কাব্য। বৈশাখ আসে ঝড় নিয়ে। তাই বৈশাখ সাহসী, ক্ষ্যাপা, বৈরী, অশান্ত, অসীম, মারমুখো, নির্দয়। কিন্তু তার সৃজনক্ষমতা শিল্পীর সুনিপুন সৌকর্যকে হার মানায়। তার নতুন সৃষ্টি প্রকৃতির সকল পারক্ষমকে হার মানায়। বৈশাখের এমনই আজব রূপ দিয়েছেন কবি-

কাল-বৈশাখি আসিলে হেথায় ভাঙ্গিয়া পড়িত কোন সকাল,
ঘুণ-ধরা বাঁশে ঠেকা দেয়া ঐ সনাতন দাওয়া, ভগ্ন চাল।
এলে হেথা কাল-বৈশাখি
মরা গাঙে যেত বান ডাকি
বদ্ধ জাঙ্গাল যাইত ভাঙিয়া, দুলিত এ দেশ টালমাটাল।

বৈশাখকে নিয়ে অনেকেই লিখেছেন। লেখায় বৈচিত্র্য এসেছে। এসেছ নতুন ধারা। কিন্তু আমাদের জাতীয় কবি সেখানে একদমই ব্যতিক্রম। তার রেখে যাওয়া বৈশাখের ছন্দমালা এখনো দুলে বাতাসের ভেলায়। শিশুর কচি ঠোটে কিংবা গাঁয়ের কৃষকের ধানকাটা ব্যস্ত মুখে। নজরুল ছিলেন বৈশাখের প্রতীক। তিনি সাহিত্যে আবির্ভুত হয়েছেন কালবৈশাখীর মতো। তার বিদ্রোহী কবিতায় আমরা সেটাই দেখি বারবার

‘আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকালবৈশাখীর।
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী সূত-বিশ্ব বিধাত্রির।’

প্রতি বছর ফিরে আসে বৈশাখ। নতুন বছর। নতুন সূর্যের আভায় বিচ্ছুরিত আলোকণা দুলে ওঠে হৃদয়ে। আর কবিমনে আলোড়ন জাগাতে আসে বৈশাখ। গাছে নতুন পাতা যোগ করার মতোই আমাদের মনকে নতুন করে বৈশাখ। নির্লিপ্ত আকাশ চুইয়ে গ্রীষ্মের দাবদাহ যখন জীবন মরুময় করে, চৈতালি রোদে যখন কাঁদামাটি ঠনঠনে, মাঠে-ঘাঠে কৃষক-কৃষাণীর যখন নাভিশ্বাস, তখনই বৈশাখ আনে ঝড়। সাথে নির্মল পানির ফোয়ারা। আনে প্রশান্তির শীতল বাতাস। ঘরময় তৈরি হয় এক নীরব আবহ।

সেই ঝড় শুষ্ক পাতা ঝড়িয়ে দেয়। নবীন জন্মকে তরান্নিত করে। তবে এই গড়ার মাঝে অনেককিছু ভেঙ্গেও দিয়ে যায়। বাড়ি ঘর তছনছ করে দিয়ে যায়। তার তীব্র স্রোতময় গতি দ্বারা। এজন্য ঝড়কে ধ্বংসেরও প্রতীক বলা হয়। তবে সেটা নিছক ধ্বংসই নয় এই ঝড় সৃষ্টিও করে অনেক কিছু। রাখে অফুরন্ত সম্ভাবনা। কবি নজরুল তাই ঝড় দেখে ভীত না হতেই উৎসাহিত করেছেন

ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখীর ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? প্রণয় নুতন সৃজন বেদন
আসছে নবীন জীবন হারা অসুন্দরের করতে ছেদন
তাই সে এমন কেনো যেনো
প্রলয় বয়েও আসছে হেসে মধুর হেসে
ভেঙ্গে আবার গড়ছে জানে সে চির সুন্দর।

বৈশাখের আগে আছে চৈত্র। মূলত বৈশাখি ঝড়ে চৈত্রের বাতাস অনেকটাই প্রভাব ফেলে। নজরুল চৈত্র মাস নিয়েও আবেগী ছিলেন। লিখেছেন চৈতি হাওয়া। সেখানে উঠে এসেছে বাঙলার অনন্য রূপলাবন্য। কবুতর-বুলবুলি আর সজনে ফুলের কথা কি চমৎকার করেই না কবি লিখেছেন

চৈতী রাতের গাইত’ গজল বুলবুলিয়ার রব
দুপুর বেলায় চবুতরায় কাঁদত কবুতর!
ভুঁই-তারকা সুন্দরী
সজনে ফুলের দল ঝরি
থোপা থোপা লা ছড়াত দোলন-খোঁপার পর।
ঝাজাল হাওয়ায় বাজত উদাস মাছরাঙার স্বর!

বৈশাখ ঝড়ের রূপ নিয়ে আসে। তবে ঝড় হয় অন্য মাসেও। বাংলাদেশে আশ্বিনেও বেশ ঝড় দেখা যায়। তবে ঝড়ের ফল হিসাবে আমরা ভয়ঙ্কর কোনো কিছুকেই চিন্তা করি। ঝড় আসছে শুনলে দৌড়ে পালাই আমরা। ঘরের কোণে আশ্রয় নেই। মাঝিরা নৌকা বেঁধে বাড়ি ফেরেন। রাখালরা গরু চরানো বন্ধ করে। এমন ভয়ঙ্কর ঝড়কে কবি শক্তি হিসেবেই উল্লেখ করেছেন তার ভাষার গানে। ঝড় থেকে তিনি শক্তি সঞ্চয় করতে বলেছেন, পড়ুন

নাচে ঐ কালবৈশাখী
কাটাবি কাল বসে কি?
দে রে দেখি
ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি।
লাথি মার ভাঙরে তালা
যতসব বন্দিশালায় আগুন জ্বালা
আগুন জ্বালা ফেল উপারি।

ছড়া কবিতা নতুন সৃষ্টিতে সর্বদাই সচেতন। অচল ভেঙ্গে সচল করার জন্যই তৈরি হয় ছড়া। থাকে নতুন কিছু। থাকে জীর্ণ আর পুরাতনকে ছেড়ে যাওয়ার আহ্বান। নজরুল কাব্যে সেটাই মূর্ত হয়ে ওঠতে দেখি বারবার। তিনি পুরনোকে পিছু ফেলে নতুনের ডাক দিয়েছেন তার গজলে

এল এলরে বৈশাখি ঝড়
ঐ বৈশাখি ঝড় এল এল মহীয়ান সুন্দর।
পাংশু মলিন ভীত কাঁপে অম্বর
চরাচর থরথর
ঘন বনকুন্তলা বসুমতী
সভয়ে করে প্রণতি,
পায়ে গিরি-নির্ঝর
ঝড় ঝড়।

বৈশাখি ঝড় নিয়েও কবিকে সচেতন দেখা যায়। সেখানে নতুনের রয়েছে আরেক রূপ-

ঝড় এসেছে ঝড় এসেছে কারা যেন ডাকে
বেরিয়ে এলো তরুণ পাতা পল্লবহীন শাখে।
কচি পাতার লাগল নাচন ভীষণ ঘূর্ণিপাকে।
মন মেতেছে আজ নূতনের ঝড়ের মহোৎসবে।
কিশলয়ের জয়-পতাকা অম্বরে আজ মেলল পাখা
প্রণাম জানাই ভয়-ভাঙানো অভয়-মহাত্মাকে।

আবার বৃষ্টি-বাদলকে তিনি কল্পনা করেছেন এক ভিন্ন রূপে। তার আগমনকে তিনি তুলনা করেছেন নুপুরের ধ্বনির সঙ্গে। বৃষ্টিও ঠিক তাই। নুপুরের রিনিঝিনি ছন্দতালে দুলিয়ে যায় আমাদের। টিনের চালে সেটা অন্যরকম এক আবহ তৈরি করে। নজরুল লিখেছেন-

বাদলা-কালো স্নিগ্ধা আমার কান্তা এলো রিমঝিমিয়ে
বৃষ্টিতে তার বাজলো নুপুর পায়জোরেরই শিঞ্জিনী যে।

ঝড়-বৃষ্টি ও বৈশাখ সবার জীবনকেই নাড়িয়ে তোলে। শিশু-কিশোরদের জন্য সেটা হয় মজার অনুসঙ্গ। আর বড়দের জন্য স্মৃতিকাতর। কাল বৈশাখ কিংবা বৃষ্টি বাদল প্রতিটি মানুষকেই আকৃষ্ট করে। তৈরি করেন স্মৃতির ডালি। ছোটবেলার সেই বৃষ্টিঝরা দিনগুলি হৃদয়কোণে জমে থাকে। এক সময়ের গ্রামীন বৈশাখি মেলাগুলো এখন নেই। কলাগাছের ভেলা বানিয়েও আর শিশুরা ঘুরে বেড়ায় না খুব একটা। এসব তাই ধীরে ধীরে যাদুঘরেরই অংশ হয়ে যাচ্ছে। সেখানে নজরুলের ছড়া-কবিতাগুলো কিছুটা হলেও মানুষকে আনন্দ দেবে। দেবে শান্তির পরশ।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ