নোমান বিন আরমান
সাংবাদিক
দেশে প্রচলিত শিক্ষাধারার অন্যতম কওমি মাদরাসা শিক্ষা। সমাজ-উদ্যোগে পরিচালিত এ মাদরাসাগুলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি কখনোই। ছিলো না শিক্ষার স্বীকৃতিও। স্বীকৃতির দাবি উচ্চকিত হচ্ছিল দীর্ঘদিন থেকে। বিগত বিএনপি জোট সরকারের আমলে এই দাবিতে মাঠের আন্দোলন-অবস্থান কর্মসূচিও পালন হয়। ক্ষমতা ছাড়ার আগ মুহূর্তে ওই সরকার একটি উদ্যোগ নেয়। ২০০৬ এর ২০ ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। জোটের শরিক একটি দলের আপত্তিকেই এ জন্যে দায়ী মনে করেন কওমিপন্থীরা। এরপর কেটে গেছে প্রায় ১১ বছর।
১১ বছরের মাথায় এসে চলতি চছরের ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছেন। গণভবনে আলেমদের নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এই ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে জোর বিতর্ক, মিশ্রপ্রতিক্রিয়া এখন সবখানে। বহুল আলোচিত ও প্রত্যাশিত স্বীকৃতি সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা বইয়ে দিয়েছে। নতুন আশা স্বপ্ন ও সম্ভাবনার ডানা মেলেছে। শাপলাসহ অপরাপর ঘটনায় সরকারের প্রতি সৃষ্ট ক্ষোভও ধুমায়িত হয়েছে। দেশের বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠির সঙ্গে জিইয়ে থাকা সরকারের দূরত্ব কয়েক ঘণ্টার বৈঠকে বানের পানির মতো ভেসে গেছে। বিএনপি জোটের বলয়ে থাকা কওমিপন্থীরা নিজেদের অবস্থান নতুন করে বিবেচনায় নিচ্ছেন। তারা অনুধাবন করছেন রাজনীতিতে চিরস্থায়ী শত্রু-মিত্র বলতে কিছু নেই। শেখ হাসিনার এই কুশলাতার কাছে হেরে গিয়েছেন তার বিরোধীরা। হারার ক্ষোভেই এখন তাদের জ্বলন শুরু হয়েছে। অন্তত দৃশ্যত তাই মনে হয়।
কওমি মাদরাসাগুলোকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার জন্যে এতোদিন যারা বলেছিলেন, স্বীকৃতি ঘোষণার পর দেখা যাচ্ছে তারাই সরকারের ওপর রুষ্ট হয়েছেন। গণভবনের বৈঠককে ‘অশনিসংকেত’ হিসেবে দেখছেন। প্রগতিশীলের দাবিদার এই ‘বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠী’র বিকৃতি দেখা দিয়েছে। তাদের অতিমাত্রার প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় কাঠামো নয়, তারা চেয়েছিলেন কওমি মাদরাসা ধারাকে রাষ্ট্রীয় গ্রাসের শিকার করতে। স্বীকৃতি না দিয়ে সরকার কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিলে তারা পরিতৃপ্ত হতে পারতেন। এর নামই কি তবে প্রগতিশীলতা। কাউকে রুদ্ধ করে, থামিয়ে দিয়ে, হত্যা করে প্রগতির চাষবাস সম্ভব?
কওমি মাদরাসা শত বছরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশদের ‘আমলা-কামলা’ বানানোর শিক্ষাধারা যখন চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন স্রোতের বিপরীতে গিয়ে, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ১৮৫৭ সালে গোড়াপত্তন হয় কওমি মাদরাসার। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার বদলে সমাজ-উদ্যোগেই এর যাত্রা শুরু। সামাজিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো কওমি মাদরাসা। ভারতের দেওবন্দে শুরু হওয়া সেই মাদরাসার আদলেই ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে হাজারো কওমি মাদরাসা। শুরু থেকেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাকে বর্জন করে আসছে কওমি মাদরাসাগুলো। রাষ্ট্রীয় কোনো সহায়তা নেওয়া হবে না- এমন ভিত্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত হয় দারুল উলুম দেওবন্দ। প্রশ্ন হলো, এখন কেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্যে এই দৌড়ঝাঁপ-উদ্যোগ।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় আলেমরা স্বীকৃতির জন্যে নিজেরা উদ্যোগী হননি। তাদের উদ্যোগ নিতে এক ধরনের বাধ্য করা হয়েছে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ও সাধারণ শিক্ষিতরা ‘চলনে-বলনে-আচরণে’ কওমি শিক্ষার্থীদের এই বার্তা দিয়েছেন, তোমরা শিক্ষিত নও। রাষ্ট্রীয় নথি ও কাগজপত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতায় তাদের জ্ঞানার্জনকে মূল্যায়ণ করা হয়নি। প্রাইমারিতে পড়ে, মাধ্যমিকে পড়ে একজন যদি নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা লিখতে পারেন, তবে সাধারণ শিক্ষার সর্বোচ্চস্তর মাস্টার্স পর্যন্ত পড়েও- একজন ব্যক্তির শিক্ষার মূল্যায়ণ করা হবে না- এমন উজবুকনীতি ও অবিদ্যানসুলভ মনোভাব থেকে ‘শিক্ষিতরা’ বেরোতে পারেননি। রাষ্ট্রকেও বেরোতে দেননি। নিজেদের খোলসে রাষ্ট্রকে তারা বেঁধে রাখতে চেয়েছেন। চাইছেন। চাইছেন বলেই কওমির সর্বোচ্চস্তর দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের মান দেওয়ার ঘোষণায় তাদের মর্মপীড়া শুরু হয়েছে।
১১ এপ্রিল রাতে গণভবনে বৈঠকে ঘোষণার পর ১৪ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে স্বীকৃতি বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। এতে দাওরায়ে হাদিসের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিয়ে মাস্টার্সের সনদ প্রদান করার জন্যে একটি কমিটি করে দিয়েছে সরকার। কমিটিতে কওমি মাদরাসার পাঁচটি বোর্ডের দশজনকে রাখা হয়েছে। এতে সরকারি কোনো কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্ট কাউকে রাখা হয়নি। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কওমি মাদরাসার পরিচালিত হবে দারুল উলুম দেওবন্দের আদলে, তার স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট অক্ষুণ্ন রেখে। এটা স্বীকৃতি নেওয়ার অন্যতম শর্ত ছিল আলেমদের। আলেমরা যেভাবে চেয়েছেন সরকার বলতে গেলে হুবহু তাদের মতো করে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এর মধ্যে অনেকে নানা ধরনের রাজনীতির হিসেব কষছেন। রাজনীতির দেশে রাজনীতি নেই, হবে না, থাকবে না- এমন ‘বস্তু’ পাওয়া ভার। কওমি সনদের স্বীকৃতি ঘোষণায়ও কোনো রাজনীতি নেই, তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না। তবে যে রাজনীতি কল্যাণের, যে রাজনীতি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে উপকৃত করবে, রাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁদের বন্ধনকে মজবুত করবে- সেই রাজনীতিতে আপত্তি কেনো। জ্বলন কেনো!
কওমি স্বীকৃতি বাস্তবায়নের আহ্বান জানাল জামায়াত
কওমির শিক্ষার্থীরা কি অন্য দেশের মানুষ? তাদের চাকরি করার অধিকার নেই?
আরআর