কদর বাড়তে শুরু করেছে ইসলামী দল ও সংগঠনগুলোর। ভোটের রাজনীতিতে তাদের কাছে টেনে বাড়তি ফায়দা নিতে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বড় দলগুলো মরিয়া হয়ে উঠেছে।
সংবিধান উপেক্ষা করেই তারা এ প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। এতে ক্ষমতার রাজনীতিতে অধিকাংশ সময় অবহেলিত থাকলেও হঠাৎ করেই গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে ইসলামী দল ও সংগঠনগুলো। তবে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে কাছে টানার এ প্রক্রিয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের বেশির ভাগ শরিক। তাদের মতে এ চেষ্টা ভোটের রাজনীতিতে সুফল বয়ে আনবে না।
সংবিধান অনুযায়ী ধর্মভিত্তিক দলগুলোর রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই বলে দাবি করেন সাবেক আইন বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির সমিতি বা সংঘ করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না, যদি- (ক) উহা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়।’
জামায়াতসহ বেশির ভাগ ধর্মভিত্তিক দলের বিরুদ্ধে সমাজে ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের উদ্দেশ্যে উসকানি দেয়ার অভিযোগ আছে। এ অভিযোগের কারণেই ধর্মাশ্রায়ী দলগুলোর রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সাংবিধানিক বিধিনিষেধ সত্ত্বেও দেশের প্রধান প্রধান দলগুলো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে কাছে টানার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এর মূল কারণ ভোটের রাজনীতি। ভোটের মাঠে সুবিধা পাওয়ার জন্যই এ ধরনের দলকে কাছে টানার প্রতিযোগিতা শুরু করেছে বড় দলগুলো। ২ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সেই নির্বাচনে ইসলামী দলগুলোর কিছু নেতাকে ব্যবহারের জন্য তাদের প্রতি ঝুঁকছে। আর এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে শরিকদের ধরে রাখার পাশাপশি দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি কে কাকে কাছে টানতে পারে সেই লড়াইয়ে নেমেছে। তারা সকাল-বিকাল বৈঠক করছেন ইসলামী দল এবং সংগঠনের বড় নেতাদের সঙ্গে।
জানা গেছে, শাসক দল আওয়ামী লীগ ইসলামী দল এবং সংগঠনগুলোর বিভিন্ন দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে তাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে উদ্যোগ নিয়েছে। প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ইতিমধ্যে ইসলামী ঘরানার বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নিয়ে নতুন একটি জোট গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। দলটির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ইতিমধ্যে একাধিক ইসলামী দলের সঙ্গে এ ইস্যুতে কথাবার্তা চূড়ান্ত করেছেন। চলতি মাসেই তার নেতৃত্বে নয়া একটি জোটের রাজনীতির মাঠে আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এসব উদ্যোগের কারণে রাজনীতির মাঠে হঠাৎ করেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নানা ভাগে বিভক্ত ছোট ছোট ধর্মভিত্তিক ইসলামী দলগুলো। তারা মনে করেন, সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের দাবি ও চাপের মুখে স্কুলের পাঠ্যবইয়ে বেশকিছু সংশোধনী আনা হয়। সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মঙ্গলবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক এবং এ বৈঠকে শর্তহীনভাবে কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি প্রদান- প্রভৃতি ঘটনা ইসলামী দল ও সংগঠনগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সম্পর্কোন্নয়নেরই অংশ।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের ধারণা, ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ করাকে কেন্দ্র করে সরকারি দলের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের যে অবনতি হয়েছিল, সাম্প্রতিক ঘটনায় সেই ফাটল দূর হয়ে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়েছে। তবে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের এ প্রক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা। এ জোটের অন্যতম প্রধান দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এবং বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এ প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মাশ্রয়ী দল ও সংগঠনগুলোর সঙ্গে আপস অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ ক্ষতিগ্রস্ত করবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শরিক দলগুলোর আপত্তি সত্ত্বেও শুধু হেফাজতে ইসলামই নয়, আরও বেশ কিছু ধর্মভিত্তিক ইসলামী দল ও সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে উদ্যোগ নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। ধর্মভিত্তিক ইসলামী দল তরিকত ফেডারেশন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে দীর্ঘ দিন ধরেই আছে। আরেক ইসলামী দল জাকের পার্কির সঙ্গে আওয়ামী লীগের পুরনো সখ্য। এখন নতুন করে তারা মিত্র খুঁজছে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ধর্মীয় দলের গুরুত্ব বাড়ছে বলে মনে করি না। খুব যৌক্তিক কারণে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
এদের স্বীকৃতি না দিলে, কর্মসংস্থানের সুযোগ না করে দিলে তারা জঙ্গিবাদসহ ভুল পথে পা বাড়াতে পারে। তাই তাদের স্বীকৃতি দেয়া মানে ধর্মীয় দলকে কাছে টানা নয় বা ধর্মীয় দলের গুরুত্ব বাড়া নয়।মাঠের বিরোধী দল বিএনপির ২০ দলীয় জোটে জামায়াতসহ বেশ কয়েকটি ইসলামী রাজনৈতিক দল রয়েছে। তারা মিত্র বাড়াতে সক্রিয়। একই সঙ্গে যারা তাদের সঙ্গে আছেন তারা যাতে জোট থেকে বের হয়ে না যান সে ব্যাপারে সতর্ক দলটির হাইকমান্ড। বুধবার ২০ দলীয় জোটের বৈঠকেও ইসলামী দলের কদর বাড়ছে বা অনেকে তাদের জোটে নেয়ার চেষ্টা করছে বলেও আলোচনা হয়।
বৈঠকে উপস্থিত ইসলামী দলের এক নেতা বলেন, ইসলামী দলগুলোকে জোট থেকে বের করে নিতে সরকার নানামুখী চাপ দিচ্ছে। আবার কোনো কোনো দল তাদের জোটে টানতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে। এই বিষয়টি জোটকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া উচিত। তাই জোট যাতে আবারও ভাঙনের মুখে না পড়ে সেদিকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। জোটের মধ্যে যোগাযোগ আরও বাড়াতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, রাজনীতির হিসাব-নিকাশ থেকে ইসলামী দলগুলোকে বিভিন্ন দল টানার চেষ্টা করছে। রাজনীতিতে লোক টানা, দল টানা ভোট টানা এটা তারই অংশ। তিনি বলেন, তবে যাই হোক রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করা উচিত নয়। ধর্ম ধর্মের জায়গায় রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় থাকা উচিত।
এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিও নতুন জোট করছে। এতে ধর্মভিত্তিক বেশ কিছু দল যোগ দেয়ার কথা আছে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমীন হাওলাদার বলেন, আওয়ামী লীগের ১৪ দলীয় জোট আছে, বিএনপির আছে ২০ দলীয় জোট। জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে কোনো জোট নেই। তাই আমরা নতুন জোট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জাতীয় পার্টি যেহেতু ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাস করে তাই আমাদের জোটে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী ২০টির বেশি রাজনৈতিক দল সম্পৃক্ত হচ্ছে।
সর্বশেষ ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ধর্মভিত্তিক দলের মোট ভোট ৬ শতাংশের কম। তবে ধর্মভিত্তিক দল সব আসনে নির্বাচন করেনি। ২০০৮ সালে জামায়াত সর্বোচ্চ ৩৯ আসনে নির্বাচন করে। দলটি ১৯৯৬ সালে ৩০০ আসনে লড়ে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পায়। ৯১ সালের নির্বাচনে পেয়েছিল ১২ দশমিক ১ শতাংশ ভোট। এ হিসাবে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর কমবেশি ৬ শতাংশ ভোট রয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ৪ দশমিক ৭ শতাংশ, ইসলামী আন্দোলন ০.৯৪ শতাংশ, জমিয়তে ইসলাম ০.২৫ শতাংশ, ইমলামী ঐক্যজোট ০.১৫ শতাংশ, ইসলামী ফ্রন্ট ০.০৫ শতাংশ, খেলাফত মজলিস ০.০৪ শতাংশ এবং খেলাফত আন্দোলন ০.০২ শতাংশ ভোট পায়।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ভোটের ক্ষেত্রে ফ্যাক্টর না হলেও ধর্মভিত্তিক ইসলামী দলগুলোর সমর্থন নির্বাচনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব দলের মাঠপর্যায়ে যে সমর্থন রয়েছে তা একজন প্রার্থীর জয় পরাজয়ে ভূমিকা রাখে। এ কারণেই প্রধান তিন রাজনৈতিক দল তাদের দিকে ঝুঁকছে। এ চিন্তা থেকেই দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নতুন মিত্রের সন্ধানে নেমেছে। ১৪ দলীয় জোট এবং ২০ দলীয় জোট নামে ভিন্ন দুটি রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্বে থাকলেও তারা আরও কিছু ধর্মভিত্তিক দলকে নিজ নিজ জোটে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে। এর বাইরে শরিক দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে ঐক্য সংহত করার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। ইসলামী দলগুলোর রাজনৈতিক অবস্থান যা-ই থাকুক, রাজনৈতিক গুরুত্বের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই এসব দলকে জোটে টানছে তিন প্রধান দল।
তবে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে কাছে টানার এই বিষয়টিকে আদর্শহীনতারই নামান্তর বলে মনে করছেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিশ্বের সব দেশেই রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু আদর্শ থাকে। আমাদের এখানকার দলগুলোরও নিজস্ব আদর্শ আছে। কিন্তু তারা যেভাবে নিজেদের নীতি ও আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে ধর্মভিত্তিক ইসলামী দল এবং সংগঠনগুলোকে কাছে টানার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে, তা আদর্শহীনতারই বহিঃপ্রকাশ।’ তিনি আরও বলেন, ‘ধর্মীয় অনুভূতি ও ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে সমাজে যে অপরাজনীতির ধারা চলছে, ইসলামী দল এবং সংগঠনগুলোকে কাছে টানার মধ্য দিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলো আরও প্রকটভাবে সেই অপরাজনীতিতে নিমজ্জিত হচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান যুগান্তরকে বলেন, দেশের সংসদীয় রাজনীতিতে ইসলামী দল এবং সংগঠনগুলোর তেমন একটা গণভিত্তি নেই। কিন্তু এসব দল এবং সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের মাঠপর্যায়ে ব্যক্তি সমর্থন রয়েছে। তাই খুব সঙ্গত কারণেই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সমর্থন নিশ্চিত করতে চায়। তিনি আরও বলেন, অপ্রিয় হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, এ দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য নয়। এদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ইসলামী দল এবং সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের ব্যবহার করে নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ প্রশস্ত করা।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর