জহির উদ্দিন বাবর
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
কওমি মাদরাসা সনদের বহুল প্রতীক্ষিত স্বীকৃতি ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই ঘোষণা বাস্তবায়ন হলে কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিস ইসলামিক স্টাডিজ ও অ্যারাবিকে মাস্টার্সের মর্যাদা পাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন এই দুটি বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে যা যা করতে পারে দাওরায়ে হাদিস উত্তীর্ণরাও তাই করতে পারবেন। নিঃসন্দেহে কওমি মাদরাসাগুলোর জন্য এটি অত্যন্ত ইতিবাচক একটি দিক। যারা এতদিন সরকারি খাতায় অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন বলেও গণ্য হতেন না তারা এখন সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীর মর্যাদা পেলেন।
সাধারণ ধারার বেশ কিছু ক্ষেত্রে এখন থেকে মাদরাসাপড়ুয়ারাও ভূমিকা রাখতে পারবেন। এতে দেশ ও জাতি নিঃসন্দেহে উপকৃত হবে। কওমি শিক্ষার্থীরাও এখন থেকে মূলধারায় গণ্য হবেন।
এই স্বীকৃতির সবচেয়ে ইতিবাচক দিকটি হলো আপাতদৃষ্টিতে এখানে সরকারি কোনো হস্তক্ষেপ নেই। স্বীকৃতির ঘোষণা দেয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেছেন, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে এই স্বীকৃতি দেয়া হলো। আলেমরা যেভাবে চেয়েছেন সরকার আপাতদৃষ্টিতে সেভাবেই এই স্বীকৃতি দিচ্ছে। বাহ্যিকভাবে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলতে পারেনি। তবে ভবিষ্যতে তাদের কোনো দূরভিসন্ধি আছে কি না সেটা অবশ্য একটা শঙ্কার বিষয়। ভবিষ্যতে তো কত কী-ই হতে পারে, সেই শঙ্কায় এখনই কুকড়ে বসে থাকলে তো আর সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
স্বীকৃতির আরেকটি ইতিবাচক দিক হলো সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এটা নিচ্ছেন। এর আগে কওমি মাদরাসার আলেমদের কোনো প্রাপ্তির ব্যাপারে এভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে খুব কমই দেখা গেছে। স্বীকৃতি প্রশ্নেও আলেমরা বহুধা বিভক্ত ছিলেন। এই স্বীকৃতি নিয়ে অনেক রাজনীতিও হয়েছে। কে ক্রেডিট নেবে এটা নিয়ে অনেক কূটচালও হয়েছে। তবে যেভাবেই হোক সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বীকৃতি দিতে পারা এটা শেখ হাসিনার বিশেষ কৃতিত্ব।
যতদূর জানি, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহেই এভাবে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে। গণভবনে স্বীকৃতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আলেমদের প্রতি তাঁর যে সম্মান প্রকাশ করেছেন সেটাও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। আলেমদের পদচারণায় গণভবন ধন্য হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে কোনো প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় বাসভবন বা অন্য কোথাও দেশের শীর্ষ আলেমদের এভাবে আপ্যায়ন করেছেন বলে আমার জানা নেই। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যজুড়ে ছিল কওমি মাদরাসার গুণগান। রাষ্ট্রীয় সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিটির মুখে কওমি মাদরাসা সম্পর্কে এই ইতিবাচক বক্তব্যগুলো ভবিষ্যতের জন্য অনেক কাজে আসবে। সরকারের ভেতরে ঘাঁপটি মেরে থাকা বর্ণচোরা যারা সুযোগ পেলেই কওমি মাদরাসা সম্পর্কে আজেবাজে মন্তব্য করতো তারা এখন সাবধান হবে। কওমি মাদরাসার দিকে জঙ্গিবাদের অশুভ ইঙ্গিত করতেন সরকারের যেসব দায়িত্বশীল ব্যক্তি তাদের মুখে এতে চুনকালি পড়েছে। কওমি মাদরাসা এবং আলেম-ওলামা সম্পর্কে শেখ হাসিনার এই ইতিবাচক মানসিকতায় মনে মনে ক্ষেপবে দেশের কথিত প্রগতিশীলেরা।
কওমি মাদরাসা সনদের স্বীকৃতির দাবি দীর্ঘদিনের। প্রায় ১৬ বছর লেখাপড়া করার পরও কওমি মাদরাসাপড়ুয়ারা সরকারের সাক্ষরতার খাতায় নাম লেখাতে পারেন না। তাদের শিক্ষার স্বীকৃতিটুকু দেয়া এটা তো তাদের প্রাপ্য। এই স্বীকৃতি তাদের প্রতি কোনো করুণা নয়, বরং অধিকার। তবে কওমি মাদরাসার লাখ লাখ ছাত্র-শিক্ষকের সঙ্গে এই অধিকার নিয়ে অতীতে রাজনৈতিক খেলা অনেক হয়েছে। বিএনপি জোট সরকারের শেষ সময়ে এসে কওমি স্বীকৃতির মৌখিক ঘোষণা দিয়ে আলেমদের সামনে একটা টোপ ঝুলিয়েছিল তৎকালীন সরকার। স্বীকৃতি দেয়া তাদের উদ্দেশ্যও ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরও এটা নিয়ে কম রাজনীতি হয়নি।
২০১২ সালেই হতে পারতো এই স্বীকৃতি। তবে সেদিন অনেকে স্বীকৃতি দিলে লাশ পড়ার হুমকি দেয়ায় সরকার পিছু হটেছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যারা লাশ পড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তারাই আজ খুশিতে বাগবাগ হয়ে স্বীকৃতির ঘোষণা শুনেছেন। এটাকেই বলে গাদা পানি খায় ঘোলা করে।
স্বীকৃতি ঘোষণার পর পক্ষে-বিপক্ষে চলছে তুমুল আলোচনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে বিষয়টি। এই স্বীকৃতিতে অধিকসংখ্যক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও কেউ কেউ ভবিষ্যতে শঙ্কার কথাও বলছেন। যারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন তাদের বেশির ভাগই নিজেদের প্রাপ্তির কথা ভেবে উচ্ছ্বসিত। কওমি মাদরাসাপড়ুয়া লাখ লাখ তরুণ এখন নিজেদের শিক্ষিত ভাবছে। এই স্বীকৃতি দিয়ে কিছু করতে না পারুক এর ফলে অন্তত তারা হীনম্মনতায় ভুগবে না। তারাও নিজেদেরকে স্বাধীন দেশের শিক্ষিত নাগরিক ভাববে। শত যোগ্যতা থাকার পরও যারা বিভিন্ন জায়গা থেকে ছিটকে পড়তেন একটি সার্টিফিকেট বা স্বীকৃতির অভাবে তাদের অন্তত এর মুখোমুখি হতে হবে না।
আর যারা শঙ্কিত তাদের এই শঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে। আলিয়া মাদরাসার করুণ পরিণতি আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছে। এক সময় আলিয়া মাদরাসা থেকেও যোগ্য আলেম তৈরি হতো, আলিয়ায় পড়েও দীনের সব বিষয়ে যোগ্যতা অর্জিত হতো; যা এখন আর হচ্ছে না। এর একমাত্র কারণ সরকারি স্বীকৃতি। এখানে দীন শেখার জন্য নয়, সার্টিফিকেট অর্জনের জন্যই সাধারণত সবাই পড়ে। এজন্য এখানে নেই নীতি-নৈতিকতার বালাই। লেবাস-পোশাক আর অবয়বে নেই আলেমসুলভ কোনো ছাপ। অনিয়ম ও অন্যায়ের ঘটনা ঘটে অহরহ। কওমি মাদরাসা সনদ যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল্যায়িত হবে তখন এখানেও যে অনিয়ম হবে না সে গ্যারান্টি কি কেউ দিতে পারবে? এখানেও যে প্রশ্নপত্র জালিয়াতি ঘটবে না; এখানেও যে টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট মিলবে না; এখানেও যে দুর্নীতির নতুন দুয়ার খুলবে না, এখানেও যে ছাত্ররা শিক্ষকদের সঙ্গে বেয়াদবিমূলক আচরণ করবে না এর কি কোনো গ্যারান্টি আছে?
কওমি মাদরাসা একটি ঐতিহ্যবাহী ও পরীক্ষিত শিক্ষাব্যবস্থা। দেড়শ বছরের বেশি সময় ধরে এই উপমহাদেশে দীনের প্রকৃত ধারাটির প্রতিনিধিত্ব করে আসছে কওমি মাদরাসা সংশ্লিষ্টরা। এই শিক্ষাব্যবস্থার একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে; আছে গৌরবময় ইতিহাস। সেই ইতিহাস কারও কাছে মাথা নত না করার; কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেয়ার; দীনের পথে অবিচল থাকার। সরকারি স্বীকৃতির কারণে যদি কওমি শিক্ষাধারা তার কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায় তাহলে এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এমন পরিণতির শিকার হলে কওমি মাদরাসা আজীবন স্বীকৃতিহীন থাকাই বরং ভালো। তবে ভবিষ্যতে কী হবে সেটা আমরা কেউই বলতে পারি না। আমরা একটা ভাবছি ভবিষ্যতে এর উল্টোটাও হতে পারে। আবার আমাদের যা ভাবনায়ও নেই সেটাও ঘটে যেতে পারে। তবে যেহেতু সম্মিলিত একটি সিদ্ধান্ত আশা করা যায় এটা ইতিবাচক হবে। কারণ ইসলামের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর অনুসারীরা সম্মিলিতভাবে কোনো বাতিলের ওপর স্থির থাকে না। যেহেতু দেশের শীর্ষ আলেম প্রায় সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বীকৃতি নিচ্ছেন তাই আশা করা যায় আল্লাহ এতে বরকত দান করবেন। আর এর ভবিষ্যতকেও শঙ্কামুক্ত রাখবেন।
আরআর
দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেয়া হলো: প্রধানমন্ত্রী
পহেলা বৈশাখে ইলিশ নয় সবজি, মরিচ পোড়া ও বেগুনভাজি খান