শনিবার, ০৪ মে ২০২৪ ।। ২১ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫


পৃথিবীর পথে পথে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

jaha_didah3মুফতী তাকী উসমানী। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের শরীয়াহ আপিল বিভাগের সাবেক প্রধান বিচারপতি। জাগতিক ও ধর্মীয় দু’শিক্ষায় শিক্ষিত বিদগ্ধ পণ্ডিত। ঘুরেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। এশিয়া থেকে ইউরোপ। হিমালয় পাদদেশ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা। দেখেছেন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অসংখ্য নিদর্শন। নিরীক্ষণের আঁতশী কাঁচের নিচে রেখে দেখেছেন সময়ের চঞ্চল প্রবাহ। আওয়ার ইসলামের পাঠকবর্গের জন্যে তার সেই ভ্রমণকাহিনী অনুবাদ করেছেন  নন্দিন অনুবাদক মাওলানা আব্দুল্লাহ আল ফারুক। এখন থেকে প্রতি সোমবার প্রকাশিত হবে শায়খ তাকী উসমানীর  ভ্রমণ কাহিনী।

গোটা সফর মাস, আর এরপর রবিউল আউয়াল মাসের বেশ কয়েকদিন কেটে গেল বিদেশ সফরে। পাঁচ সপ্তাহের এই সফরে কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরব এবং ইরাক; এই চার দেশে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়। এই সফরের অনেকগুলো বিষয় অবশ্যই পাঠকবর্গের কাছে খুবই আকর্ষণীয় মনে হবে। এ কারণেই তার সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত ও অনুভূতি পেশ করছি।

শুরু হলো দক্ষিণ আফ্রিকা দিয়ে
কাদিয়ানীদের সঙ্গে একটি বিষয় নিয়ে স্থানীয় আদালতে মামলা ওঠে। সেই মামলার কার্যক্রমে সহায়তার জন্যে স্থানীয় মুসলমানগণ আমাকে নিমন্ত্রণ জানান। সেই সূত্রে শুরু হয় আমার দক্ষিণ আফ্রিকা সফর।

কেপটাউনে ১৫ দিন অবস্থান করি। এসময় এখানকার মুসলমানদের মাঝে যেই ঈমানী উদ্দীপনা ও দ্বীনি আবেগের বহিপ্রকাশ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল, সত্যি তা আমার জন্যে ছিল বিস্ময়কর শিক্ষাপ্রদ। কেপটাউনকে পৃথিবীর দক্ষিণপ্রান্তের সর্বশেষ ভুখন্ড মনে করা হয়। এমন এক দূররাজ্যে; যা কয়েক শতাব্দী যাবত পশ্চিমা গোষ্ঠীর করতলগত রয়েছে; যেখানে পদে পদে ধর্মহীনতা, অশ্লীল বিনোদন, নগ্নতা ও নোংরামির যাবতীয় উপকরণ দিনমান প্রতিক্রিয়াশীল; এতো কিছু সত্ত্বেও এখানকার মুসলমানগণ তাদের দ্বীনি ঐতিহ্য শক্তভাবে ধরে রেখেছেন। সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও তারা তাদের দ্বীনি স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে জীবনপণ সংগ্রাম করে চলেছেন। যখন দ্বীনকে কেন্দ্র করে কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তখন তার জন্যে তাদের ঈমানী সংবেদনশীলতা ও চেতনাবোধ সত্যি দেখার মতো।

এই মামলা কেন্দ্র করে দেশের তিনটি প্রদেশ -ট্রান্সভাল, নিটাল ও কেপ- থেকে মুসলমানদের প্রতিনিধিগণ কেপটাউনে সমবেত হন। এ সময় তাদের একে অন্যের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার ঈর্ষণীয় উদ্দীপনা খোলা চোখেই পরিলক্ষিত হচ্ছিল।
তারা নিরেট দ্বীনি আবেগের ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের জন্যে যেভাবে হৃদয় নিংড়ানো আতিথেয়তা ও সমাদর বিছিয়ে দিয়েছেন এবং যেই উঞ্চ ভালোবাসা ও হৃদসিঞ্চিত আন্তরিকতা ঢেলে দিয়েছেন, তা আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়পটে চির অমলিন স্মৃতি হয়ে থাকবে।

কেপটাউন ও দুই সাগরের মিলনস্থল
কেপটাউন হলো পৃথিবীর নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর স্থানগুলোর একটি। এখানে সাগর, পাহাড়, ঝিল, সবুজ-শ্যামল প্রান্তর তথা সর্বধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য রয়েছে। শহরটির দক্ষিণে আনুমানিক ৭০-৮০ কিলোমিটার দূরত্বে একটি ঐতিহাসিক পর্বত রয়েছে। আরবীতে সেটির নাম رأس الرجاء الصالح। ইংরেজিতে বলা হয়, কেপ অফ গুড হোপ তথা উত্তমাশা অন্তরীপ। এটি পৃথিবীর দক্ষিণ প্রান্তের সর্বশেষ জনপদ। এখান থেকেই ভাস্কো দা গামা ভারতবর্ষের রাস্তা আবিষ্কার করেছিলেন। এ স্থানেই পৃথিবীর দুটি বৃহৎ সমুদ্র আটলান্তিক মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরের মোহনা; যেখানে কুরআনুল কারীমের সেই আয়াত مَرَجَ الْبَحْرَيْنِ يَلْتَقِيَانِ এর দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য দেখা যায়। যদিও ইতোপূর্বে এখানে এসেছিলাম। কিন্তু সেসময় ধুলোধুসরিত মৌসুম হওয়ার কারণে দুই সমুদ্রের স্বতন্ত্র রূপ ভালোভাবে ফুটেনি। কিন্তু এখন আবহাওয়া খুবই স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। যার কারণে পার্থক্যকারী সেই রেখা কয়েক মাইল পর্যন্ত চোখে পড়ে। এ বিষয়টিকেই কুরআনুল হাকীম بَيْنَهُمَا بَرْزَخٌ لاَّ يَبْغِيَانِ এর শব্দে ব্যক্ত করেছে। যা দেখে যে কোনো মানুষ স্বতষ্ফূর্তভাবে বলে উঠবে : فَتَبَارَكَ اللَّهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ ○
[কতইনা বরকতময় সেই সত্তা, যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ সুনিপূণ স্রষ্টা]

সৌদি আরব
কেপটাউনের মোকাদ্দামা থেকে অবসর পাওয়ার পর একদিন জোহান্সবার্গ ও আযাদবেলে অবস্থান করি। এখানে বিভিন্ন পুরনো বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সাক্ষাৎ হয়। ১১ নভেম্বর সন্ধায় নাইরোবি ফেরার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। রাত ১২ টায় নাইরোবি পৌঁছি। সেখানকার ভিআইপি লাউঞ্চে ঘণ্টা দুয়েক অতিবাহিত করি। রাত ২টায় সৌদি এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে জেদ্দা রওয়ানা হই। আনুমানিক সকাল ৭টায় জেদ্দা এয়ারপোর্টে আমাদের বহনকারী বিমান অবতরণ করে। প্রতিনিধি দলের অভ্যর্থনার জন্যে এখানে রাবেতা আলমে ইসলামির প্রটোকল অফিসার উপস্থিত ছিলেন। জেদ্দায় কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে মক্কা মুকাররমার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। যোহর নামাযের বেশ পূর্বে মক্কা মুকাররমায় পৌঁছে যাই। যোহরের পূর্বেই ওমরার কার্যক্রম শুরু করি। বাদ যোহর ওমরাও পূর্ণ হয়ে যায়।

দেড় বছর পর অধম এই পূণ্যভূমিতে আসার সুযোগ পেয়েছে। এ সময় সেই অনুভূতি পুনরায় সজাগ হয়ে উঠে যে, এখানকার চালচিত্র কখনই বলে বুঝানোর মতো নয়। নিজে চাক্ষুশ না দেখলে কোনো স্বাদই পাওয়া যাবে না। আবহাওয়া ছিল খুবই মনোমুগ্ধকর। ভীড়ও ছিল নেহায়েতই কম। মহান আল্লাহ বড্ড শান্তি ও প্রশ্বস্তির সাথে এখানে হাজির হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। নিজের অবর্ণনীয় দূরবস্থার প্রতি চোখ পড়তেই বরাবরের মতো এবারও সেই ভাবনাও আমার ওপর চেপে বসল :

كہاں ميں؟ اور كہاں يہ نگہت گل؟
نسيم صبح! تيرى مہربانى
কোথাকার আমি আর কোন সুদূরের এই পুষ্প-সৌরভ?
ওগো প্রভাতী সমীরণ! তোমার দয়ায় এ মিলন হল সম্ভব।

আল্লাহ তাআলা এই পূণ্যভূমিকে যে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং এ মহান স্থানকে তার অতিপ্রাকৃতিক নূর ও তাজাল্লির প্রকাশস্থল বানিয়ে যেভাবে সম্মানিত করেছেন; তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের মতো লোকদের এখানে আসার অনুমতি না পাওয়াই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু তার মহানূভবতা আর রাসূলে আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সদকার বদৌলতে বারংবার এখানে আসার সৌভাগ্য পেয়ে চলেছি। আল্লাহ তাআলা অধমের এই উপস্থিতিকে একান্তভাবে তাঁর উদ্দেশ্যে একনিষ্ঠ বানিয়ে দিন এবং তাঁর রাজদরবারে গ্রহণ করে নিন। আমীন! সুম্মা আমীন!

মদিনার পথে
মক্কা মুকাররমায় একদিন অবস্থান করে পরদিন মদিনা মুনাওয়ারার উদ্দেশে রওয়ানা হই। মক্কা মুকাররমা থেকে মদিনা মুনাওয়ারায় যাওয়ার জন্যে নতুন যে সড়ক সে বছরই নির্মিত হয়েছিল, সেটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতের সফরের রাস্তা অনুকরণে তৈরি হয়েছিল। এ পথটি কুবা হয়ে মদিনায় প্রবেশ করেছে। এ কারণেই সড়কটির নাম রাখা হয় ‘তরিকুল হিজরাহ’। নতুন এ রাস্তার কারণে দূরত্বও বেশ কমে গেছে। দুই লেনের প্রশস্ত হাইওয়ে হওয়ার কারণে গাড়িগুলো বেশ গতিতে ছুটছে। যদি মাঝপথে কোনো যাত্রাবিরতি না নেয়া হয়, তাহলে অনায়াসে প্রায় ঘণ্টা চারেকের মধ্যে মদিনা মুনাওয়ারায় পৌঁছা যাবে।

আমরা যখন মদিনা তাইয়্যেবায় পৌঁছি তখন মুয়াযযিনের কণ্ঠে এশার আযান ধ্বনিত হচ্ছিল। সামানগুলো গাড়িতে রেখেই নামাযে শামিল হই। একেতো মসজিদে নববীর নূরের বিভায় প্রদীপ্ত পরিবেশ। সাথে সাথে শায়খ হুযায়ফির সরল অথচ খুবই চিত্তাকর্ষক তিলাওয়াত। মনে হচ্ছিল, ব্রক্ষাণ্ডের প্রতিটি অণু কুরআনুল কারিমের নূরানী বিভায় ডুবে গেছে। গোটা ভুবনকেই মনে হয়েছিল, তার তিলাওয়াতের আবেশে মোহাবিষ্ট।
প্রতিনিধিদলের অন্যান্য সহযাত্রীগণ পরদিন মক্কা মুকাররমায় এবং সেখান থেকে পাকিস্তানে ফিরে যান। আমার যেহেতু ১৮ নভেম্বর ইসলামি ফেকাহ একাডেমির সেমিনারে অংশগ্রহণ করার কথা ছিল, এ জন্যে আরো কিছু দিন মদিনা তাইয়্যেবায় অবস্থান করার সৌভাগ্য পেয়ে যাই। মুক্তোর চেয়ে দামী এই দিনগুলো শ্রদ্ধেয় আব্বাজান রহ.এর ভাষায় এই অনুভূতি সহকারে কেটে যায় :

پهر پيش نظر گنبد خضرا ہے، حرم ہے پهر نام خدا، روضۂ جنت ميں قدم ہے
پهر منت دربان كا اعزاز ملا ہے يہ ان كا كرم، اُن كا كرم، اُن كا كرم ہے
দৃষ্টির সীমা জুড়ে গুম্বদে খাযরা
হারামের আঙ্গিনায়
খোদার কসম, কদম রেখেছি
জান্নাতী বাগিচায়;
আহা মরি মরি! ফটক ছোঁয়ার
সৌভাগ্যতিলক লভেছি
জানি ওগো প্রভু! এ সব তোমার
করুণাবলেই পেয়েছি।

পাঁচ দিন পর এই অনুশোচনাবোধের সাথে মদিনা তাইয়্যেবা থেকে বিদায় নেই যে, মহান প্রভুর অসীম দয়া ও করুণাবলে যেই অতীব মূল্যবান মুহূর্তগুলো পেয়েছিলাম, সেগুলোর প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জানিয়ে সঠিক স্থানে ব্যয় করতে পারি নি। তাঁর পক্ষ থেকে রহমতের বৃষ্টি বর্ষণকালে কোনো ধরণের কার্পণ্য হয়নি, কিন্তু যদি মাটির মাঝে সেই বৃষ্টির জল ধরে রাখার যোগ্যতা না থাকে, তাহলে কী আর করা? এতো কিছুর পরও সেই রহমতের কাছে পুনরায় প্রত্যাশার চাদর এ মর্মে বিছিয়ে দেই যে, তিনি যখন এই দয়া ও করুণার উৎসস্থলে উপস্থিত হওয়ার তাওফীক দিয়েছেন, তিনি অবশ্যই শত অযোগ্যতা সত্ত্বেও ইনশাআল্লাহ বঞ্চিত করবেন না।

চলবে....

উৎসবমুখর পরিবেশে লেখক, প্রকাশক ও সম্পাদকদের সম্মিলনী অনুষ্ঠিত


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ