শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ইসলামি সংগীতে দেশ ও মুক্তিযুদ্ধ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

islami_song

আতাউর রহমান খসরু: ইসলামি সংগীত বৃত্ত ভেঙ্গেছে বহুদিন হলো। এখন এগিয়ে যাওয়ার পালা। আসমানের উপর ও জমিনের নিচে আটকে নেই আর ইসলামি সংগীত। তাতে স্থান পেয়েছে মাটি, মানুষ, দেশ ও স্বাধীনতা। তরুণ প্রজন্মের সংগীত শিল্পীরা দেশ, মাটি ও মানবতার মাঝে তারা খুঁজে পান ঐশী ঐশ্বয। দেশপ্রেম ও স্বাধীনতা মূর্ত হয় তাদের সুরের মূর্ছনায়।

বিশুদ্ধ ইসলামি ধারার সংগীতে দেশ, মানুষ এবং সচেতনভাবে রাজনৈতিক উচ্চারণ প্রথম নিয়ে আসেন মরহুম আইনুদ্দীন আল আজাদ। তার সংগীতে দেশপ্রেম ধরা দিয়েছে প্রধানত প্রতিবাদের ভাষায়। যেমন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মানবতার কথা বলেছেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরে। মরহুম আইনুদ্দীন আল আজাদ মাতৃভূমির ভালোবাসায় ব্যাকুল হয়ে বলেছিলেন, ‘ও আমার মাতৃভূমি নয়তো ‍তুমি জুলুমবাজির আড্ডাখানা...।’ একইভাবে গণমানুষের মুক্তিচিন্তা থেকেই তিনি ‘স্বাধীনতা চাই নি আমি এ স্বাধীনতা’ বলে আমার বিশ্বাস।

তার রেখে যাওয়া কলরব অবশ্য দেশের গানে আরও কোমল ও শৈল্পিক। তারা দেশ খুঁজেছে সবুজ শ্যামল বাংলার প্রকৃতিতে। যেমন তারা গেয়েছে,

ধানে ভরা গানে ভরা
আমার এই দেশ ভাই
এই ধরণীর মাঝে দেখো
এমন দেশ আর নেই
রূপে ভরা বাংলা আমার খোদার সেরা দান
সারাটা সময় গাইতে থাকি তারই গুণগান।

বরং তারা বাঙালি বা বাংলাদেশি পরিচয়ে এক পতাকা তলে এক জাতি হিসেবে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সকলে শান্তিপূর্ণ ও সম্প্রীতির সাথে বসবাস এবং মাতৃভূমির জন্য কাজ করার কথা বলেছে। দেশের প্রয়োজনে নীরবতা ভেঙ্গে এক সাথে গর্জে ওঠার অঙ্গীকার করেছে। যেমন,

এক দেশ এক পতাকা
এক জাতি, আছে একতা
সময়ের প্রয়োজনে ভেঙ্গে নিরবতা
শান্তিতে সংগ্রামে গর্জে ওঠা

**
এক বন্ধনে সুখে দুঃখে কাটাবো
আনবো সোনালি প্রভাত
হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান
হাতে রেখে হাত।

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধেও ঠিক এমনটিই হয়েছিলো। এদেশের মুসলমানের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিলো হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও প্রাকৃতিক ধর্মের অনুসারী উপজাতিরা। তাই বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে প্রচার সমাজে রয়েছে তারও প্রতিফলন ঘটেছে এ গানটিতে।

তবে স্বাধীনতার প্রশ্নে এখনো কলরবের বিক্ষুব্ধতা এখনো মিলিয়ে যায় নি। তারা স্বাধীনতার দলীয়করণ, সাধারণ মুসলিম জনতার অবদান পাশ কাটিয়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শ্রেণি বিশেষের বাণিজ্যের প্রতিবাদ করেছে। যেমন তারা গেয়েছে,

এই পতাকার জন্য রক্ত দিয়েছে এদেশের অযুত মুসলমান
লাখো মুক্তিযোদ্ধ ঈমানদার আছে, শিক্ষানীতিতে থাকবেই ইসলাম

সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, ইসলামি ধারার দেশাত্মবোধক গানে দেশ ও স্বাধীনতা এসেছে প্রধানত তিনভাবে। ক. প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে, খ. মুক্তিযুদ্ধে শহিদ ও নিযাতিত মা-বোনদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, গ. স্বাধীনতার প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় ক্ষোভ জানিয়ে।

প্রথম ও দ্বিতীয় বিষয়টি বিপুলভাবে পরিলক্ষিত। যেমন,

বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধ যখন নাকে আসে
মনটা আমার অন্য রকম আনন্দতে ভাসে
প্রভাত রবি আধার চোখে পুব আকাশে হাসে
মনটা আমার চায় হারাতে সোনার বাংলাদেশে।

তৃতীয় বিষয়টির সবচেয়ে বড় উদাহরণ আইনুদ্দীন আল আজাদের তুমুল জনপ্রিয় ‘স্বাধীনতা চাই নি আমি এ স্বাধীনতা’ সংগীতটি। অথবা সাঈদ আহমাদের গাওয়া ‘আমাদের এই দেশে স্বাধীন মানে হলো ভুরি ভুরি দুর্নীতি আর শূন্যতা’ গানটি।

ইসলামি সংগীতে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার উপস্থিতি বাড়লেও ইসলামি সংগীত শিল্পী ও গীতিকারদের মধ্যে সরাসরি একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাটা এখনো প্রবল। তবে তার ব্যতিক্রমও আছে। যেমন দেশের ঐতিহ্যবাহী ইসলামি সাংস্কৃতি সংগঠন দাবানল গেয়েছে,

স্বাধীনতা স্বাধীনতা স্বাধীনতা...
একটি সাগর রক্ত দিয়ে এনেছি এই স্বাধীনতা
লক্ষ তাজা জীবন দিয়ে এনেছি এই স্বাধীনতা
একাত্তরের যুদ্ধ শেষে পেয়েছি এই স্বাধীনতা।

দেশ, স্বাধীনতা নিয়ে অনেক গান সংগীত থাকলেও সরাসরি একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধকে এড়ানোর একটা প্রবণতা ইসলামি ধারার সংগীতে লক্ষ করা যায়। এ সম্পর্কে ইসলামি ধারার একজন গীতিকার ও সংগীতজ্ঞের সঙ্গে কথা হয়। তিনি নাম না প্রকাশের শর্তে বলেছেন, ‘ভারতবর্ষ তথা পাকিস্তান আন্দোলনে উলামায়ে কেরামের সীমাহীন ত্যাগ এবং একাত্তর সালে বৃহত্তর আলেম সমাজের দ্বিধা ও নিরবতার ইতিহাস এখনো তরুণ প্রজন্মের সামনে রয়ে গেছে। ফলে তারা পূর্বসূরীদের মনস্তাত্বিক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারছেন না।’

এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কবি মুহিব খান। তিনি তার গানে দরাজ কণ্ঠেই বলেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্যয়ের পেছনে থাকা সব স্বাধিকার আন্দোলনের কথা। তিনি তার ‘এ মেরা ওতান’ গানে বলেছেন, ‘যার জন্যেই বায়ান্ন, উনসত্তর আর একাত্তরের সংগ্রাম।’

শুধু এ ক্ষেত্রে নয়, মুহিব খান ব্যতিক্রম তার গানের কথা, সুর, তাল ও লয় সবকিছুতেই। স্বাধীনতা রক্ষায় মুহিব খানের প্রত্যয়ও চোখে পড়ার মতো। তিনি তার ‘ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি’ গানে বলেছেন,

ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি সোনার চাইতে খাটি নগদ রক্ত দিয়ে কেনা
শত্রু বা হানাদার একটি কণাও তার কেড়ে নিতে কেউ পারবে না।
রঙ্গের তুলিতে আঁকা সবুজের ছায়া ঢাকা সুজলা সুফলা পরিপাটি
লক্ষ শহীদ গাজী রেখেছে জীবনবাজী করেছে স্বাধীন এই মাটি।

তার এ গানে রয়েছে দেশপ্রেম, স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও দেশ রক্ষার দৃঢ় প্রত্যয়। দেশ রক্ষার এমন প্রত্যয় ইসলামি ধারার দেশাত্মবোধক গানে প্রায় চোখে পড়ে। যেমন, স্বপ্নসিঁড়ির গাওয়া ‘বাংলাদেশের ছেলে মোরা’ গানটিতে বলা হয়েছে,

মোরা মানি নাকো পরাজয়
নিঃসংশয় নির্ভয়
মোরা মুক্ত বাঁধাহীন
মোরা নইতো পরাধীন
এ দেশকে ভালোবাসি
মোরা পরতে পারি ফাঁসি
করি নাকো তাবেদারি...।

দেশ ও স্বাধীনতা রক্ষার এমন প্রত্যয়; প্রকারান্তে দেশ নিয়ে তাদের আশংকা এতো বেশি কেনো? উত্তর পাওয়া যাবে মুহিব খানের আরেকটি গানে। তিনি তার প্রথম এ্যলবাম ‘সীমান্ত খুলে দাও’ এর একটি গানে বাঙালিকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন ‘সীমান্তে ঐ কেটা, কোন হারামির বেটা’ বলে। শুধু তাই নয়, তিনি তাদের মুগুর পেটাতেও বলেছেন। সরল বাংলায় বললে ‘ভারতভীতি’। ইসলামি ধারার লেখক, সাহিত্যিক, গীতিকার ও শিল্পীদের বড় একটি অংশ বিশ্বাস করে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা এক সময় বাংলাদেশকে আত্মস্থ করার জন্যই হয়েছিলো এবং তা হতে পারে যে কোনো সময়। এজন্য ইসলামি ধারার দেশাত্মবোধক গানের একটি বৈশিষ্ট্য ভারত বিরোধিতাও। যদিও শাসকগোষ্ঠির দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তা অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে। শুধু ভারত নয়, পৃথিবীর সব সম্রাজ্যবাদী শক্তির হস্তক্ষেপ থেকে দেশ রক্ষায় সোচ্চার ইসলামি সংগীত। পৃথিবীর যে কোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধেই এ দেশের ইসলামি সংগীত বার বার উচ্চকিত হয়েছে।

দেশ বলতে যদি আমরা ‍সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর বাইরে তার সমাজ, সভ্যতা ও মানুষকে বোঝায় তবে ইসলামি সংগীতেই তা সবচেয়ে বেশি স্থান পেয়েছে। মনুষ্যত্বের পতন ও অবিচারের বিরুদ্ধে ইসলামি সংগীত শিল্পীরাই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং তাদের গানেই সামগ্রিক দেশ উপস্থিত হয়েছে জোরালোভাবে। উদাহরণ হিসেবে কবি মুহিব খানের ‘কেনো কেনো’ গানটির কথা বলা যেতে পারে। এখানে দেশ ও সমাজের অসংগতির ব্যাপারে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে তাতে দেশপ্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

ইসলামি সংগীতে দেশ ও স্বাধীনতার স্বরব উপস্থিতিকে ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবেই দেখেন কলরবের শিল্পনির্দেশক তরুণ লেখক ও গীতিকার রোকন রাইয়ান। তিনি মনে করেন, ‘তরুণ প্রজন্ম যে দেশ নিয়ে ভাবছে, দেশ নিয়ে কাজ করছে এবং উঁচু গলায় বাংলাদেশকে আপন করে নেয়ার চেষ্টা করছে এটি অত্যন্ত ইতিবাচক। কারণ যখন একটি প্রজন্ম দেশকে আপন ভাববে, তার জন্য কাজ করবে, তখনই দেশ এগিয়ে যাবে।’

তবে তিনি একথাও স্পষ্ট করেন যে, ‘পূর্বে যারা দেশের গান এভাবে গাইতেন না, তারা যে দেশকে অনুভব করতেন না তা কিন্তু নয়। তাদের ভালোবাসার প্রকাশ তাদের কাজেই ঘটেছে।’

[caption id="" align="alignright" width="197"]Image result for শামসুল করিম খোকন শামসুল করীম খোকন[/caption]

যারা বয়সে একটু প্রবীণ তারাও এ পরিবর্তন মেনে নিয়েছেন এবং তাকে সময়ের দাবি বলেই বিবেচনা করেন। যেমন কবি ও গীতিকার শামসুল করীম খোকন। প্রায় আড়াই দশক ধরে ইসলামি সংগীত চর্চা করছেন। তিনি বলেন, ‘আজ ইসলামি সংগীতে যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা অবশ্যই প্রয়োজন এবং সময়ের দাবী। সময়ের এ দাবী মেনেই সামনে এগুতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘শৈশব থেকে দেশের গানে মুগ্ধ হলেও আমি দেশের গান লিখতে শুরু করি ১০ বছর আগ থেকে। কারণ, আমি যখন গান লেখতে শুরু করি তখন পরিবেশনটা ভিন্নরকম ছিল। সেখানে আধ্যাত্মিকতাকেই গুরুত্ব দেয়া হতো।’

সময়ের দাবিতেই হোক আর তারুণ্যের জাগরণেই হোক- এ পরিবর্তনে আমরা আশাবাদী হয়ে উঠি এবং বলতেই পারি, ‘জেগেছে বাংলাদেশ এখনই সময় তার...’

এআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ