শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


তুরস্ক : উসমানি খেলাফতের সমাধি থেকে আজ (১)

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

turkey5

কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক
অতিথি লেখক, আওয়ার ইসলাম

নামকরণ :
তার্কি বা তুর্কি শব্দের অর্থ ল্যান্ড অব তুর্কস। ল্যাটিন টার্কিয়া (Turcia) এবং আরবি তার্কি-ই (Turkiyye) শব্দের উৎপত্তি। এটি একটি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নাম। এ নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী যে এলাকায় বসবাস করতো সে এলাকাটি তার্কি বা তুর্কি নামে পরিচিতি পায়। ‘(Turk) শব্দের অর্থ সৃষ্ট (created)। আল্লাহ তাআলা তুর্কি জাতিকে পরম যত্নে শ্রেষ্ঠ করে সৃষ্টি করেছেন। আর তারাও পরম যত্নে যে ভূখণ্ডটি সৃষ্টি করেছে সেটিই তার্কি বা তুরস্ক। দেশটির সরকারি নাম প্রজাতন্ত্রী তুরস্ক। [সূত্র : ড. মুহাম্মদ আমীন প্রণীত কী করে হলো দেশের নাম-ইউরোপ : পৃষ্ঠা ১৪৮]

ভৌগলিক অবস্থান :
তুরস্ক দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার আনাতোলিয়া উপদ্বীপের সম্পূর্ণ অংশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বলকান উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত। ফলে ভৌগলিকভাবে দেশটি একই সাথে ইউরোপ ও এশিয়ার অন্তর্ভুক্ত। তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারা আনাতোলিয়াতেই অবস্থিত। আনাতোলীয় অংশটি তুরস্কের প্রায় ৯৭% আয়তন গঠন করেছে। এটি মূলত একটি পর্বতবেষ্টিত উচ্চ মালভূমি। আনাতোলিয়ার উপকূলীয় এলাকায় সমভূমি দেখতে পাওয়া যায়। তুরস্কের দক্ষিণ-ইউরোপীয় অংশটি ত্রাকিয়া নামে পরিচিত; এটি আয়তনে তুরস্কের মাত্র ৩% হলেও এখানে তুরস্কের ১০% জনগণ বাস করে। এখানেই তুরস্ক ও গোটা ইউরোপের সবচেয়ে জনবহুল শহর ইস্তানবুল অবস্থিত (জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১৩ লক্ষ)। ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণ সাগরকে সংযুক্তকারী বসফরাস প্রণালী, মর্মর সাগর ও দার্দানেল প্রণালী ত্রাকিয়া ও আনাতোলিয়াকে পৃথক করেছে। [সূত্র : উইকিপিডিয়া]।

তুরস্ক মোটামুটি চতুর্ভুজাকৃতির। এর পশ্চিমে এজীয় সাগর ও গ্রিস; উত্তর-পূর্বে জর্জিয়া, আরমেনিয়া ও স্বায়ত্তশাসিত আজারবাইজানি প্রজাতন্ত্র নাখচিভান; পূর্বে ইরান, দক্ষিণে ইরাক, সিরিয়া ও ভূমধ্যসাগর। তুরস্কের ভূমিরূপ বিচিত্র। দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমে আছে উর্বর সমভূমি। পশ্চিমে আছে উঁচু, অনুর্বর মালভূমি। পূর্বে আছে সুউচ্চ পর্বতমালা। দেশের অভ্যন্তরের জলবায়ু চরমভাবাপন্ন হলেও ভূমধ্যসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলের জলবায়ু মৃদু।

নিকট অতীতের আয়নায় :
উসমানি খেলাফতের পতনের পূর্বে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ছিল খেলাফতের অধীনে। তাদের ইতিহাস ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধ। এ সময়েই ইউরোপের বিশাল একটি অংশ মুসলিম শাসনের অধীনে আসে এবং পৃথিবীজুড়ে ইসলাম একটি অপরাজেয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। কিন্তু মুসলিম শাসকদের ইসলামবিমুখতা, স্বেচ্চাচারিতা এবং নানামুখী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই উসমানি খেলাফতের পতন ঘটে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লিথুনিয়া থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত ৩০টি পয়েন্টে সমগ্র দুনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে উসমানী সেনাবাহিনী অসম বীরত্ব প্রদর্শনের পরেও হেরে যায়। পরবর্তীতে মাত্র ৩ বছরের বাবধানে তুরস্কের আলেমদের নেতৃত্বে বর্তমান তুরস্ক স্বাধীনতা লাভ করে। এর পর ইউরোপিয়ান দেশগুলো খেলাফতের ব্যাপারে আপত্তি করতে থাকে এবং তাদের দাবির মুখে ১ নভেম্বর ১৯২২ সালে তৎকালীন সুলতান; সুলতান ওয়াহদেদ্দিনকে তুরস্ক থেকে নির্বাসিত করা হয়। অবশেষে লোজান চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপিয়ান দেশগুলোর আপত্তির মুখে ২৯ শে অক্টোবর প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে এবং ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম মুসলিমগণ নেতৃত্ববিহীন হয়ে পড়ে।

Solaiman sultan

একসময়কার মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বদানকারী তুরস্ক বর্তমানে ফের নেতৃত্বের ভূমিকায় উঠে আসছে- বলাটা অত্যুক্তি হলেও এটা মিথ্যে নয় যে, বর্তমান সমস্যা-সংকুল মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ়।

নিকট ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে চাই ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম মুসলিমগণ নেতৃত্ববিহীন হয়ে পড়লে তুরস্কের মসনদে আসীন হন মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক। তার ইমলামবিদ্বেষী কার্যকলাপ ইতিহাসপাঠকমাত্র জানেন। ১৯৩৮ সালে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক মৃত্যুবরণ করলে কোনো প্রকার জানাযা ছাড়াই দাফন করা হয়। ১৯৫০ সালের নির্বাচনে আদনান মেন্দ্রেসের দল ডেমোক্রেটিক পার্টি বিজয় লাভ করে। ১৯৬০ সালে বামপন্থী ও ইসলামবিদ্বেষী সেনাবাহিনী এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। এই সামরিক সরকার ৫ বছর তুরস্ককে শাসন করে। ১৯৬৪ সালে ডেমোক্রেট পার্টির অন্যতম সদস্য সোলেয়মান দেমিরেল আদালেত পার্টি প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬৫ সালে দেমিরেল ক্ষমতা গ্রহণ করে। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এই অবস্থা জারী থাকে।

১৯৬৯ সালে তুরস্কের রাজনীতিতে এক নতুন ধারার সূচনা হয়। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান আলেম উলামাদের পরামর্শে এবং ইসলামী চেতনায় উজ্জীবিত একদল মুসলমানকে নিয়ে ইসলামি আন্দোলনের সূচনা করেন। তিনি মিল্লি নিজাম নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য বিপদজ্জনক এই অভিযোগে ১ বছর পরেই এই দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। এই দল নিষিদ্ধ হওয়ার সাথে সাথেই নাজমুদ্দিন এরবাকান মিল্লি সালামেত নামে নতুন একটি দল গঠন করে ১৯৭৩ সালে সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং ৪৮ আসনে বিজয় লাভ করে নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান আলেম উলামাদের পরামর্শে এবং ইসলামী চেতনায় উজ্জীবিত একদল মুসলমানকে নিয়ে ইসলামি আন্দোলনের সূচনা করেন। তিনি মিল্লি নিজাম নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য বিপদজ্জনক এই অভিযোগে ১ বছর পরেই এই দলকে নিষিদ্ধ করা হয়

রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে তুরস্ক যখন সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল এটাকে সাম্রাজ্যবাদীরা ভাল চোখে দেখেনি। তারা ১৯৮০ সালে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায় সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের পর সকল দলকে নিষিদ্ধ করারা পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ নাজমুদ্দিন এরবাকানসহ আরও অনেক রাজনীতিবিদকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং তাদেরকে জেলে প্রেরণ করে। হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে জেলে পুরে এবং শত শত মানুষকে হত্যা করে। সেনাবাহিনী ডানপন্থী ও বামপন্থী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই সামরিক অভ্যুত্থানের প্রভাব এতটাই প্রকোপ ছিল যে, অনেক ঐতিহাসিক এই জন্য বলে থাকেন, আধুনিক তুরস্কের ২ টি ইতিহাস রয়েছে- ১টি হল ১৯৮০’র আগে আরেকটি ১৯৮০ সালের পরের ইতিহাস।

সামরিক শাসন ৩ বছর পর্যন্ত জারি থাকে। এইভাবে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তুরগুত অজালের নেতৃত্বে মাদারল্যান্ড পার্টি তুরস্ককে শাসন করে। ১৯৯৪ সালে তাঁকে বিষপানে হত্যা করা হয়। ১৯৯৪ সালের স্থানীয় নির্বাচনে রেফাহ পার্টি বিপুল বিজয় অর্জন করে। ১৯৯৭ সালে শুধুমাত্র ফাজিলেত পার্টি ছাড়া অন্য সকল দল মিলে সরকার গঠন করে কিন্তু তাদের দুর্নীতিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠতে শুরু করে। অর্থনীতিতে মারাত্মক ধস নামে এবং মুদ্রাস্ফীতি সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। রাষ্ট্রয়াত্ত্ব ব্যাংকগুলো দেওলিয়া হয়ে পড়ে।

অবশেষে ২০০২ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। এই নির্বাচনে রজব তাইয়্যেব এরদোগানের নেতৃত্বে একে পার্টি ৩৪.৩ শতাংশ ভোট পেয়ে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, এর পর ২০০৭ সালে ৩৮.৬ এবং ২০১১ সালের নির্বাচনে ৪৯. ৮ শতাংশ ভোট পান। গত ১ ২০১৫ নভেম্বর একেপি প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট এবং ৫৫০ আসনের মধ্যে ৩১৭টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে আবারও তুরস্কের মসনদে এরদোগান।

[চলবে]

লেখক: সম্পাদক, মাসিক দাওয়াতুল হক

এক লাখ মাদরাসায় টয়লেট তৈরি করবে মোদি সরকার

ক্যামব্রিজে পৃথিবীর প্রথম সবুজ মসজিদ


সম্পর্কিত খবর