শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


দেওবন্দে উৎসবমুখর বিতর্ক অনুষ্ঠান

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

deubond11

হাওলাদার জহিরুল ইসলাম
দেওবন্দ থেকে

মসজিদে রশিদে এশার নামাজ শেষ হয়েছে কোবল৷ তড়িঘড়ি সবাই ছুটছে ঐতিহাসিক ভবন 'দারুত তাফসিরে'র দিকে৷ কৌতূহলি চোখে সবার সাথে এগোলাম আমিও৷ মাদানি গেটে আসতেই একটি ডিজিটাল ব্যানারে চোখ আটকে গেলো৷ বড় করে উর্দু হরফে লেখা 'শুবায়ে মুনাজারা৷ আজিমুশ শান এখতেতামি মজলিসে আম৷'

বুঝতে বাকি রইলো না আর৷ আজ তাহলে 'তর্ক বিভাগে'র সমাপনি অনুষ্ঠান! আরেকটু এগোতেই একটি সফেদ বোর্ডে আজকের আলোচ্য বিষয় ও অতিথিদের তালিকা নজরে পড়লো৷ অনুষ্ঠানের মধ্যমণি থাকবেন সম্মানিত মুহতামিম সাহেব আল্লামা আবুল কাসেম নোমানি দামাত বারাকাতুহুম৷ আগ্রহটা যেনো বেড়ে গেলো দ্বিগুন৷ বিভিন্ন আঞ্জুমান বা শিক্ষা বিভাগ আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানে মুহতামিম সাহেবের অতিথি হওয়া বছরে এটাই হয়তো প্রথম৷

ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের অন্যান্য শিক্ষা বিভাগের মতো 'শুবায়ে মুনাজারা' বা বিতর্ক বিভাগও একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ বিভাগ৷ দেওবন্দ থেকে দাওরায়ে হাদিস ও তাখাস্ সুস ফারেগ শিক্ষার্থীগণ (নির্দিষ্ট কোটায়) এ বিভাগে ভর্তির সুযোগ পায়৷ সারা বছর পৃথিবীর বিভন্ন ধর্ম, মতবাদের ওপর চলে গবেষণা৷

ওম্মা! অনুষ্ঠান শুরু হতে না হতেই দেখি কদিম দারুল হাদিসের বিশাল হল রুমটি কাণায় কাণায় পূর্ণ! জায়গা না পেয়ে তিন দিকের দরোজার সামনেও দাঁড়িয়ে আছে শিক্ষার্থীরা৷ ভীড় ঠেলে একটু সামনে যেতেই চোখ কপালে ওঠলো৷ মঞ্চ সামনে এত্তোগুলো পুরস্কার! এ কি পুরস্কার না পুরস্কারের পাহাড়!!

ওহহো! আজকের আলোচ্য বিষয়টি তো বলাই হয়নি৷ বিষয়টি সমসাময়িক না হলেও সমধিক গুরত্ত্বের দাবি রাখে৷ বিশেষত ইলমি ও আকিদার দৃষ্টিকোণ থেকে৷ আলোচ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে 'মিয়ারে হক কারা৷' অর্থাৎ শরিয়তে ইসলামিয়াতে সত্যের মাপকাঠি কারা এবং কেনো এ বিষয়টি নিয়েই আজকের বিতর্ক সভা৷

পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত, হামদ না'তের মাধ্যমে শুরু হলো অনুষ্ঠান৷ প্রথমেই সঞ্চালক সাহেব 'মুুনাজারা'র নিয়মাবলী সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করলেন৷ পরক্ষণেই আজকের প্রধান অতিথি আল্লামা মুফতি আবুল কাসেম নোমানি সাহেব হাফিজাহুল্লাহ(মুহতামিম সাহেব) উদ্বোধনি বক্তব্য পেশ করলেন৷ মওদূদী মতবাদ, আকিদার ক্ষেত্রে ঠিক কী কী কারণে আহলুস সুন্নত ওয়াল জামা'ত দ্বিমত পোষণ করে থাকেন তার মোটা মোটা বিষয়গুলো তুলে ধরে সারগর্ভপূর্ণ আলোচনা রাখলেন৷

এবার  মুনাজারা বিভাগের তরজুমান(ক্লাস ক্যাপ্টেন) বক্ততৃতা মঞ্চে আসলেন৷ মুজারা কী, কীভাবে, মুনাজারায় কী কী শর্ত মেনে চলতে হয় আলোচনা করলেন তার সবই৷

Image may contain: one or more people, crowd and basketball court

এরপর মূল ভূমিকা হিসেবে চমৎকার বক্তব্য রাখলেন মুনাজারা বিভাগের অন্যতম যিম্মাদার, বিভিন্ন ধর্ম, মতবাদ নিয়ে গবেষণাকারী মুফতি রাশেদ সাহেব আজমি৷ অসাধারণ ভাষাশৈলী, দালিলিক ও বাস্তব ভিত্তিক যুক্তি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে তুলে ধরলেন মওদূদী মতবাদের অসারতাগুলো একটা একটা করে৷ আলোচনায় আসলো সমকালিন নানা ফেরকা-মতবাদও৷ আহলে হাদিস, লা-মাযহাবি ফেরকারও মুখোশ খুলে দিলেন খুব সহজেই৷ আরো বললেন, আজকের মুনাজারা কেবলই শিক্ষার জন্য৷ এখানে হার জিতের বিষয়টি সামনে না আনাই ভালো৷ পুরো আধা ঘণ্টা ছাত্ররা অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকলো এই বিজ্ঞ আলেমের দিকে৷ নিজেদের জ্ঞানভাণ্ডারে জমা করে নিলো আরো কিছু মুক্তদানা৷

নিয়মনুসারে বিতার্কিকগণ দু'পক্ষে  অবস্থান নিলেন৷ মঞ্চের ডানে দেওবন্দী বা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অনুসারী৷ আর বাঁপাশে মাওলানা মওদূদী সাহেবের মতবাদের অনুসারীগণ৷ প্রতি গ্রুপে ৫জন করে পরিচালকসহ মোট ১১জন৷ আবার প্রতি গ্রুপে একজন ছিলেন প্রধান হিসেবে৷

মওদূদীপন্থীদের সুযোগ দেয়া হলো প্রথমে৷ গ্রুপপ্রধান মওদূদী মতবাদের পক্ষে (মওদূদী সাহেবের কিতাব থেকে) দালিলিক ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য রাখলেন৷ তিনি সাব্যস্ত করে দিলেন সাহাবায়ে কেরামগণ মিয়ারে হক নন! একমাত্র রাসূল সা.-ই মিয়ারে হক বা সত্যের মাপকাঠি৷ তার দেয়া দলিল খণ্ডনের জন্য দেওবন্দীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে মাইক্রোফোন ছেড়ে নিজ আসনে ফিরলেন৷

দেওবন্দী গ্রুপপ্রধান জবাব দিতে শুরু করলেন অপর পক্ষের প্রতিটি দলিলের৷ কুরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস বাদ পড়লো না কোনোটাই৷ কিন্তু উপস্থাপনে তেমন পারঙ্গমতা দেখাতে পারলেন না৷

একটু পর ঠিক এই সুযোগটিই কাজে লাগালো মওদূদীপন্থীরা৷ সাথে কিছুটা চাতুরতারও আশ্রয় নিয়ে বললো, 'আমারাও সাহাবায়ে কেরামকে মিয়ারে হক মানি৷ তবে এনফেরাদিভাবে নয়৷ বরং এজতেমায়ীভাবে৷' দেওবন্দীদের মূল বক্তব্যকে পাশ কাটিয়ে শ্রোতাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করলেন৷ উপস্থাপন করলেন আজিব গরিব কিছু ইতিহাসকথা৷ বোধহয় অনেকটা সফলও হলেন৷ একটি মৌন শ্লোগানও তাদের পক্ষে দেখা গেলো৷

আমি ততোক্ষণে ভিড় ঢেলে হল রুমে প্রবেশ করেছি৷ যাদের সারা বছর এসব অনুষ্ঠানে আসতে দেখা যায়নি আজ তাদের অনেকেই নজরে পড়লো৷ মুগ্ধকর, শিক্ষণীয় অনুষ্ঠানের একটি আর্কাইভ রাখতে ইচ্ছে হলো বেশ৷ অমনি মোবাইলটা বের করে কাঁপা কাঁপা হাতে কয়েকটি ক্লিক করে নিলাম৷ আশপাশের কেউ কেউ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে৷

কেমন যেনো একটা নিরবতা ছেয়ে গেলো পুরো মজমায়৷ চিন্তার ভাজ দেখা গেলো কারো কারো ললাটে৷ ফের আসলেন দেওবন্দীরা৷ এবারও সুন্দর দালিলিক আলোচনা করলেন৷ কিন্তু প্রতিপক্ষের চাতুরতা সম্পর্কে শ্রোতাদেরকে সতর্ক করতে ভুলে গেলেন৷ মানে, মওদূদীপন্থীগণ যে দাবি করলেন, 'আমরা সাহাবায়ে কেরামকে এজতেমায়ীভাবে মিয়ারে হক মানি' কথাটি মওদূদী মতবাদের স্পষ্ট খেলাফ৷ কেনোনা, মাওলানা মওদূদী সাহেবের একাধিক বইয়ে লেখা আছে যে তিনি বা তার জামায়াত সাহাবায়ে কেরামকে হুজ্জত বা মিয়ারে হক মানেন না৷ সেখানে ইজতেমায়ী-ইনফেরাদির কোনো আলোচনা নেই৷

এ পক্ষ আসে, দলিল পেশ করে৷ ও পক্ষ এসে তার জবাব দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়৷ হলরুমের সবাই চরম উদ্দীপনার সাথেই উপভোগ করছিলো৷ এক পক্ষ যখন দলিল পেশ করতে শুরু  করে তখন মনে হয় অপর পক্ষ বুঝি কুপোকাত হয়ে গেলো৷ আবার অপর পক্ষ যখন জবাব দেয়া শুরু করে তখন মনে হয় প্রতিপক্ষ বুঝি একদম হেরেই গেলো৷ মাত্র ৩মিনিটেই একেক জন এতোটা সারগর্ভপূর্ণ আলচোনা করতে পারেন তা নিজ কানে না শুনলে বিশ্বাস হওয়া মুশকিল৷ মুহূর্তেই যেনো পুরো ইসলামি ইতিহাসের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছিলেন শ্রোতাদেরকে৷ প্রস্তুতিটা যে পূর্ণভাবেই নেয়া হয়েছে তা সহজেই বুঝা গেলো৷

সময় গড়ালো অনেক৷ রাত সোয়া ১২টার দিকে এসে মুনাজারার দৃশ্যপট ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করলো৷ দেওবন্দীগণ এগিয়ে যেতে লাগলেন৷ যুদ্ধের ময়দানটা যেনো তাদের মুঠোয় চলে আসছিলো৷ উপস্থিতদের সবাই ঠিক এ মুহূর্তটির জন্যই দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করছিলো৷ শেষ পর্যায়ে দেওবন্দীদের পক্ষে মাশাআল্লাহ, সহিহ কাহা-সহিহ কাহা, ঠিক হ্যায় ঠিক হ্যায় শ্লোগানে মুখরিত হলে পুরো হলরুমটি৷

একেক পক্ষের আলোচনার জন্য সময় দেয়া ছিলো ৬মিনিটি করে৷ ৩মিনিট গ্রুপপ্রধানের জন্য আর ৩মিনিট তার সহযোগির জন্য৷ সময় শেষ হতেই কলিং বেল চেপে ধরা হচ্ছিলো৷ সময়ের চমৎকার বণ্টন এবং বিতার্কিকগণ তার অনুসরণ করা অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছিলো বহুগুণে৷

অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন দেওবন্দে সম্মানিত নায়েবে মুহতামিম ও সিনিয়র মুহাদ্দিস হজরত আল্লামা আবদুল খালেক সাম্ভলী সাহেব দামাতা বারাকাতুহুম৷ অতিথি হিসেবে পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে ছিলেন মুফতি মুজ্জাম্মিল হক বাদায়ূনী সাহেবসহ কয়েকজন উস্তাদ৷ সবাই যেনো আজকের বিতার্কিকদের প্রতি মুগ্ধই হচ্ছিলেন৷

সর্বশেষ এলো পুরস্কারের পালা৷ তরজুমান সাহেব সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে ঘোষণা করলেন আজকের মুনাজারায় মোট ৬০রূপির কিতাব পুরস্কার হিসেবে দেয়া হচ্ছে৷ বিতর্কে অংশগ্রহণকারীদের জন্য রয়েছে বিশেষ পুরস্কার৷ অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের জন্যও থাকবে  সম্মাননা৷ পুরো মাদরাসার তরজুমান(ক্লাস ক্যাপ্টেন)দেরকেও সম্মানন পুরস্কৃত করা হবে৷

পুরস্কার তুলে দিলেন সভাপতি সাহেব৷ পরে দোয়ার মাধ্যমে সমাপ্ত হলো জমকালো ও শিক্ষণীয় আজকের বিতর্ক অনুষ্ঠানটি৷ তখন দেয়াল ঘড়ির কাটা বলছিলো 'এখন রাত ১টা৷'

আরআর

বুদ্ধিমানের নির্বুদ্ধিতা

লেখক প্রকাশক ও সম্পাদকদের মিলনমেলা

বিশ্বের কোথাও হাইকোর্টের সামনে মূর্তি দেখিনি: এরশাদ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ