শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


চরমোনাই-তাবলীগ, দ্বন্দ্বটা কি জরুরি ছিল না অযথা?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

রোকন রাইয়ান
নির্বাহী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম

উপমহাদেশের কয়েকটি দেশে ইসলাম প্রচারকদের মধ্যে যে ধরনের দ্বান্দ্বিক মানসিকতা দেখা যায় পৃথিবীর আর কোথাও এমন নজির পাওয়া যায় না। প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যে এধরনের অবস্থান নেই বললেই চলে। সেখানে যে যেমন দর্শন চর্চা করেন তারা তারটা নিয়েই দিনরাত লিপ্ত থাকেন। এখানে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ ও আশপাশের কয়েকটি দেশ। এর মধ্যে ভারত পাকিস্তান উল্লেখযোগ্য।

ভারতেও বিষয়টা খুব একটা নজরে পড়ে না। সেখানকার আলেমদের মধ্যে অনেক ক্যাটাগরি থাকলেও সবাই যার যার অবস্থান নিয়েই থাকেন। একে অপরের সঙ্গে দ্ব্ন্দ্ব লাগিয়ে সাধারণের দ্বিধা বিভক্তি বাড়ানোর কাজ একেবারেই নেই। বরং দীন, দাওয়াত ও ধর্মীয় ইস্যুগুলোতে তারা যেভাবে একতার হাত ধরে গণমুখী কথা বলেন তা নজিরবিহীন।

বাংলাদেশের উলামায়ে কেরাম বা দীনি দাওয়াতের যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের মধ্যে একে অপরের যে দূরত্ব তা দিনদিন সাধারণের কাছে বিভক্তির পথ স্পষ্ট করছে। দেখা যায় খুব সাধারণ একটা বিষয় পেলেই সেটাকে হাতিয়ার করে একে অপরের মানহানিকর দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। অথচ বিষয়টি আদতেই অতি সাধারণ যা সমাজ বাস্তবতায় সংগঠিত হওয়া খুব একটা অপ্রত্যাশিত নয়। মূল বিষয় হলো আমাদের ভেতর সেটাকে ছেড়ে দেয়ার মানসিকতা নেই।

এসব দ্বন্দ্বের বেশ কিছু মৌলিক কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম- এক দলের ভারের সঙ্গে অন্য দলের ওজন করা। সেখান থেকে প্রায়োরিটির অভাববোধ এবং দ্বন্দ্বের সূচনা।

কিছুদিন আগেও মুভ ফাউন্ডেশনের একটি কোর্স নিয়ে দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়েছিল। সেখানে ইসলামী ঐক্যজোটের মাওলানা আনসারুল হক ইমরান ও লালবাগ মাদরাসার কিছু ছাত্র অংশ নিয়েছিলেন। সে কোর্সে নারীদের সঙ্গে কাজের বেশ কিছু চিত্র নিয়ে ফেসবুকে তুমুল সচালানা ছড়িয়ে পড়েছিল। সেটাকে কেন্দ্র করে অনেকেই লালাবাগ জামিয়া ও ইসলামী ঐক্যজোটকে জড়িয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। যা জনমনে ভ্রান্তির কারণ হয়েছে। অথচ বিষয়টি আদৌ অসৎ উদ্দেশ্যে ছিল না। কিন্তু এই দলাদলির ফলে মাঝখান থেকে ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে একটি ইসলামি দলের এবং ওই শিক্ষার্থীদের।

দেশে সম্প্রতি সময়ে সিলেটে ঘটে গেছে জঘন্য ঘটনা। এক ওয়াজ মাহফিলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ তারপর সেটা নিয়ে স্যোশাল মিডিয়া তোলপাড়। আর এসব তোলপাড়ে যে কাজটি সবচেয়ে বেশি হয় সেটি হলো অপপ্রচার, প্রোপাগাণ্ডা ও তুলনাহীন মিথ্যাচার। ফটোশপ করা ফাইলে ভরে যায় স্ট্যাটাস, টাইমলাইন।

মুভ ফাউন্ডেশনের একটি কোর্স নিয়ে দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়েছিল। সেখানে ইসলামী ঐক্যজোটের মাওলানা আনসারুল হক ইমরান ও লালবাগ মাদরাসার কিছু ছাত্র অংশ নিয়েছিলেন। সে কোর্সে নারীদের সঙ্গে কাজের বেশ কিছু চিত্র নিয়ে ফেসবুকে তুমুল সচালানা ছড়িয়ে পড়েছিল

ফুলতলীর পীর ও কওমি উলামার মধ্যে সেই দ্বন্দ্ব না থামতেই শুরু হয়েছে আরেক দ্বন্দ্ব। চরমোনাই ও তাবলীগ জামাত। দল দুটির হক্কানিয়াত নিয়ে আলেম ওলামার মধ্যে দ্বন্দ্ব না থাকলেও ভারিক্কি নিয়ে মাঝে মাঝে ঈর্ষা জাগতে দেখা যায়। আর সেখানে থেকে বহু মানুষের রোষানলে পড়তে হয় দলগুলোর নেতাদের।

তাবলীগ জামাত ও চরমোনাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূচনা এরকম একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। ইসলামী আন্দোলনের নায়েবে আমির মুফতি সাইয়েদ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম একটি বয়ানে তাবলীগ জামাতের কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। আলোচনার ভিডিওটি ইউটিউব ও ফেসবুকজুড়ে ঘুরে ফিরছে। প্রথমে কিছু ইউজারের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকলেও বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে। কওমি মাদরাসার শিক্ষক ও সেলিব্রেটি ফেসবুকাররাও লিপ্ত হন ওই দ্বন্দ্বে।

বক্তব্যটির আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা জিনিস বলে নেই। খ্যাতিমান লেখক মুফতি হেমায়েত উদ্দীনের একটি বই আছে। চশমার আয়না যেমন। বইটা আগাগোড়া যারা পড়েছেন বুঝতে পারবেন একই বিষয় কতজন কতভাবে দেখেন। যে যেমন আয়না পরেন তার কাছে তেমন লাগে বিষয়টা।

পীর সাহেবের বক্তব্যটি শুনে এমনটিই বলতে হচ্ছে। এটাকে যদি আপনি ঐক্য প্রত্যাশী বক্তব্য বলতে চান তাহলে যথেষ্ট উপাদান রয়েছে এতে। আবার যদি বিপক্ষ বক্তব্য ধরেন সেটাও সম্ভব কারণ তার কণ্ঠ ছিল অতিরিক্ত জোরদার। আসলে তার অতীতের বয়ানগুলোতে দেখা যায় তিনি কথা বলেন এতটা শক্তি ও জোস নিয়েই। সুতরাং ওই ভিডিওটিকে তাবলীগ বিরোধী মনে করার কারণ খুব নগন্য থাকতে পারে আর এমন বয়ান পথে ঘাটে অহরহই পাওয়া যায়।

একটা প্রবাদ আছে। নেই কাজ তো খৈ ভাজ। এখনকার অধিকাংশ ফেসবুকারের তেমন কোনো কাজ নেই খৈ ভাজা ছাড়া। তাই তারা একটু কানা কোণা পেলেই খৈ ভাজতে বসে যান। আপনি যদি দীনের ভালোই চান তাহলে খোলা মাঠে দুই হকের বিরোধিতা কিভাবে করেন? আরো হাজারো বিষয় আছে আমাদের মধ্যে যা আমরা নিত্য দিন চেপে যাই, জাতীয় স্বার্থে এসব ছোট খাট মতপার্থক্যকে কি চাপানো যায় না?

ভিডিওর বক্তব্যটি আমি মনোযোগ দিয়ে কয়েকবার শুনেছি। আমার কাছে আদৌ মনে হয়নি কথাগুলো তাবলীগের বিরোধী। তিনি বরং তাবলীগ জামাত কেন চরমোনাইকে পছন্দ করে না সেই অভিযোগটাই তুলেছেন ভারাক্রান্ত মনে। তিনি দেখালেন ‘আপনারা যে ইসলাম করেন আমরাও সেই ইসলাম করি, আপনারা যে পাঞ্চাবি পরেন আমরাও তাই পরি, আপনারা দাড়ি রাখেন আমরাও রাখি, আপনারা নামাজ পড়েন আমরাও নামাজ পড়ি। সুতরাং দুটো সমান আকিদা বিশ্বাসী দলের মধ্যে কেন বিরোধের ফারাক!! ’

শুধু এটুকুই নয়, মুফতি মুহাম্মদ ফয়জুল করীম আরো বলেছেন, ‘আপনারা কেন আমাদের বিরোধিতা করেন, বিরোধিতা তো করবে লা মাজহাবীরা, বিরোধিতা করবে শিয়ারা, বিরোধিতা করবে নাস্তিক ও ইহুদিরা। আপনাদের আমাদের সাথে তো অমিল নেই।’

তিনি এটাও জোর দিয়ে বলেছেন, ‘তাবলীগের কিতাব ফাজায়েলে আমাল আমি অসংখ্যবার পড়েছি, অনেকে আমার ব্যাপারে এটাও বলেছেন, আপনি কি ফাজায়েলে আমালের হাফেজ হয়ে যাবেন? তো আমি তো এই কিতাবে কোনো এশকাল দেখি না। কখনো তো কোনো সমালোচনার কিছু পাইনি।’

তাবলীগ জামাত কেন পীর মুরিদি দেখতে পারে না সেটা নিয়ে তাদের ভুল ভাঙানোর জন্য তিনি বলেছেন, ‘হজরত ইলিয়াস রহ. আল্লামা শফী রহ. এর কাছে বায়আত হওয়ার জন্য গেছেন, তিনি গঙ্গোহী রহ. এর শাগরেদ ছিলেন এবং খেদমতও করতেন, তিনি ইয়াহইয়া রহ. এর শাগরেদ ছিলেন এবং খেলাফতও গ্রহণ করেছেন, ইয়াহইয়া রহ. এবং খলীল আহমাদ সাহরানপুরী রহ. সব তো গঙ্গোহী রহ. এর শাগরেদ, আল্লামা যাকারিয়া রহ. ইয়াইয়া রহ. এর শাগরেদ। সবাই যদি পীর মুরিদি পছন্দ করতেন বা গঙ্গোহী রহ. এর শাগরেদ হতে পারেন তাহলে তাবলীগি ওলারা কেন পীর মুরিদির কথা শুনতে পারেন না।’

আপনারা কেন আমাদের বিরোধিতা করেন, বিরোধিতা তো করবে লা মাজহাবীরা, বিরোধিতা করবে শিয়ারা, বিরোধিতা করবে নাস্তিক ও ইহুদিরা। আপনাদের আমাদের সাথে তো অমিল নেই

তাবলীগ জামাত নিয়ে ওই বক্তব্য দেয়ার কারণও তিনি শুরুতে স্পষ্ট করেছেন। বলেছেন, দুটি মসজিদের কথা যেখানে তাদের প্রবেশে বাধা দেয়া হয়।

চাইলে এই বয়ানে ভুলগুলো ধরে ঐক্যের প্রয়াসকে এগিয়ে নেয়া যেত। পজিটিভি এ দিকটি ফুটিয়ে না তোলে আমরা কেন দুই পক্ষের দ্বান্দ্বিক অবস্থায় যাচ্ছি। যদি সবার উদ্দেশ্য হয় দীন রক্ষা তাহলে নিশ্চয়ই না বাচককেও হা বাচকে পূর্ণ করা যেত এবং যাওয়া উচিত। রাসূল সা. তো সেই পাথরেই ফুল ফুটিয়ে তোলার দরদি শিক্ষা আমাদের অন্তরে বপন করে গেছেন তার মূল্যবান বাণীতে।

চরমোনাইপন্থীরা তাবলীগের বিরোধিতা করেন কিনা আমার কাছে প্রমাণ নেই। কারণ দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আমার সেভাবে উঠাবসা হয়ে উঠেনি। কিন্তু একটা বিষয় আমি আমার ঘর থেকেই জানি সেটা হলো, আমার বাবা চরমোনাইয়ের অন্ধভক্ত হওয়া সত্তেও দাওরায়ে হাদিস শেষ করার পর আমাকে চিল্লায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আরো বেশি এসলাহের জন্য। সুতরাং এই সত্যের ওপর দাঁড়িয়েও কি আমি বলতে পারবো চরমোনাইওলারা তাবলীগ বিরোধী।

তবে একটা বিষয় বাহ্যিকভাবে দেখা যায়, চরমোনাইওলারা তাবলীগের অনুষ্ঠানে বা ইজতেমায় সাধারণত যান না। আবার একই বিষয় তাবলীগের মধ্যেও আছে, তারাও চরমোনাইয়ের কোনো মাহফিল-মজলিসে যান না। একই বিষয় অন্যান্য ইসলামী দল ও দাওয়াতি মারকাজগুলোর ক্ষেত্রেও সমান। কেউ কারো অনুষ্ঠানে যাওয়ার মানসিকতা সাধারণত রাখেন না। এ সমস্যা তো কোনো দল বা ব্যক্তির নয় সমগ্রের।

যখন সাধারণ মানুষ চরমোনাই এসে দ্বীনের পথ খুজে পায়, তখন সে মনে করে চরমোনাই দলই সঠিক। অন্যগুলো সব বাতিল। কারণ সে এখানেই এসে দ্বীন পেয়েছে। অাবার অারেকটা সাধারণ মানুষ যখন তাবলীগে গিয়ে দ্বীনের পথ খুজে পায়, তখন সে তাবলীগকেই সহিহ মনে করে

চরমোনাই আর তাবলীগ জামাত বিরোধী কিনা বা একে অপরকে কেন সহ্য করতে পারেন না তার একটা কারণ বলে গেছেন চরমোনাইয়ের মরহুম পীর মাওলানা ফজলুল করীম রহ.। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- অনেক সময় চরমোনাই ওয়ালারা তাবলীগ দেখতে পারে না, অাবার অনেক সময় তাবলীগ ওয়ালারা চরমোনাই দেখতে পারে না। এর কারণ কী?

মরহুম পীর সাহেব রহ. বলেছিলেন, যখন সাধারণ মানুষ চরমোনাই এসে দ্বীনের পথ খুজে পায়, তখন সে মনে করে চরমোনাই দলই সঠিক। অন্যগুলো সব বাতিল। কারণ সে এখানেই এসে দ্বীন পেয়েছে। অাবার অারেকটা সাধারণ মানুষ যখন তাবলীগে গিয়ে দ্বীনের পথ খুজে পায়, তখন সে তাবলীগকেই সহিহ মনে করে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তাবলীগ যেমন দ্বীনের একটি অংশ, চরমোনাইও তেমন দ্বীনের একটি অংশ।

সুতরাং এতকিছু জানার পরও যদি আন্দোলন, দলাদলি করতেই হয় তাহলে সবার ঐক্য হওয়ার আন্দোলনটাই করুন না। জাতি কিছু ফায়দা পাবে।

আর তাবলীগ জামাত প্রতিষ্ঠা বা সার্বজনীন হওয়ার পেছনে তাদের দরদি মেহনত, উদার চিন্তা এবং কবরের সেই অন্ধ ফেরেশতার মতো বাইরের কিছু না শুনে দীনের জন্য কাজ করে যাওয়ার মানসিকতাই অন্যতম। সেখান থেকে জামাতটি ভিন্ন পথ ধরে, বাইরের সমালোচনা ও দেনদরবারে বিশ্বাসী হয়ে উঠলে সেগুলো তাবলীগের মৌল কাজে বাধা ছাড়া কিছুই হবে না। দেওবন্দ এবং তাবলীগের মধ্যে যে সুক্ষ্ম মতপার্থক্য গত কিছুদিন ধরে চলছে তা তো কারোই কাম্য ছিল না।

তবে একটা বিষয় উপেক্ষার সুযোগ নেই, ইস্যুটা নিয়ে চরমোনাইয়ের কিছু অতি আবেগী মুরিদ যেভাবে ফেসবুকে কঠোর স্ট্যাটাস দিয়ে যাচ্ছেন দেখলে মনে হবে যুদ্ধ অত্যাসন্ন। আবেগী এইসব মুরিদের জন্য আলাদা ইসলাহি কোর্স না হলে ভবিষ্যত নষ্টের জন্য আর কারো প্রয়োজন হবে না।

এআরকে

যে ভিডিও নিয়ে সমালোচনা 


সম্পর্কিত খবর